জননেতা মোহাম্মদ ফরহাদ : জাতীয় রাজনীতির অকাল প্রয়াত কান্ডারী

৩৬তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধাঞ্জলি

কানাই দাশ | মঙ্গলবার , ১০ অক্টোবর, ২০২৩ at ১০:১২ পূর্বাহ্ণ

১৯৫৮ সাল থেকেই ১৯৮৭ সালে মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা ও সংগঠক ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির প্রয়াত সাধারণ সম্পাদক জননেতা কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ। তাঁর মৃত্যুর ৩৬ বছর পর আজও চলমান গণতান্ত্রিক সংগ্রামে তাঁর অভাব তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে।

গণতন্ত্রহীনতার এই দীর্ঘ সময়ে শাসকগোষ্ঠীর ভাবাদর্শিক প্রভাবে আমাদের দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে এই অপশাসনের উপজাত হিসেবে সাম্প্রদায়িকতা, জবরদস্তি, অসহিষ্ণুতা বিস্তার লাভ করেছে এবং গড়ে উঠেছে এক শক্তিশালী সাম্প্রদায়িক লুটেরা সামাজিক মনস্তত্ব। এরই প্রত্যক্ষ প্রভাবে ১৯৯১ সাল থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত সাধারণভাবে গ্রহণযোগ্য চারটি নির্বাচনে জনগণের সমর্থনে পর্যায়ক্রমে ক্ষমতায় আসা বৃহৎ দুটি দলের শাসন নির্বাচিত স্বৈরশাসনে রূপ নেয়। এ সময়ে শুধু দুটি পরস্পর সম্পর্কযুক্ত প্রপঞ্চ দ্রুতহারে বিকশিত হয়েছেধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা ও অবাধ লুটপাটতীব্র হয়েছে সমাজ ও রাজনীতির দুর্বৃত্তায়ন। একই সময়ে বিদ্যমান সমাজতন্ত্রের বিপর্যয়ের কারণে সারাবিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বামধারার রাজনীতি ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ায় সামগ্রিক জনজীবন চরম নিরাপত্তাহীনতায় পতিত হয়েছে। রাজনীতিতে বামপন্থার বিষেষ করে সিপিবি’র প্রভাব যা ’৮০ দশকেও দৃশ্যমানভাবে প্রবল ছিল তা প্রচলিত নিও লিবারেল রাজনৈতিক অর্থনীতির ফ্যাসিবাদী প্রবণতা ও জবরদস্তি, বাম নেতেৃত্বের সংকীর্ণতা, বিশুদ্ধবাদী অহংবোধসহ নানা কারণে দুর্বল হয়ে পড়াতে দেশের রাজনীতি ও অর্থনীতি বৃহৎ দুটি দলের একচেটিয়া মৃগয়াক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে।

এদেশে গণআন্দোলনের মাধ্যমে সামরিক স্বৈর শাসকদের বারবার ক্ষমতাচ্যুত করা গেলেও কার্যত তাদের প্রচলিত লুটেরা রাজনৈতিক অর্থনীতি ও তার ভাবাদর্শিক জঞ্জাল থেকে দেশ কখনো মুক্ত হয়নি। ফলে এরশাদ বিরোধী দীর্ঘ আন্দোলনে ১৫ দল মূল নেতৃত্বে থাকলেও সাম্প্রদায়িক সমাজ মানসের প্রাবল্যে বরং ’৯১ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিএনপি’র মতো ধর্মীয় জাতীয়বাদে বিশ্বাসী দল নির্বাচিত হয়ে সরকার গঠন করে। বিএনপি’র ভাবাদর্শ অনুযায়ী দেশ আর্থ রাজনৈতিকভাবে সামরিক শাসকদের অনুসৃত পথেই চলতে থাকে। ’৬০ থেকে ’৮০’র দশকের মতো সমস্ত প্রতিকূলতা উজিয়ে নিজের পার্টিকে সংহত করে প্রকৃত গণতন্ত্রের লক্ষে বৃহত্তর ঐক্য ও সংগ্রাম গড়ে তোলার জটিল রাজনীতির সুদক্ষ কারিগর কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদের মতো প্রজন্মের একজন শ্রেষ্ঠ ও নিবেদিত নেতার শূন্যতা এখনো তীব্রভাবে অনুভূত হচ্ছে প্রগতিশীল মহলে।

কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ ১৯৩৮ সালে পঞ্চগড় জেলার বোদায় জন্মগ্রহণ করেন। দিনাজপুরের সুরেন্দ্রনাথ কলেজে ছাত্র থাকাবস্থায় তিনি ছাত্র ইউনিয়নের সংস্পর্শে আসেন এবং নিজ যোগ্যতা বলে জেলা ও কেন্দ্রের নেতায় পরিণত হন। ছোট খাট কিন্তু বুদ্ধিদীপ্ত এই মানুষটি তখন থেকেই কমিউনিস্ট নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন তাঁর প্রত্যুৎপন্নমতিত্ব, ধীশক্তি ও মার্কসীয় প্রজ্ঞার কারণে। মাত্র ১৬ বছর বয়সে ১৯৫৪ সালে তিনি আত্মগোপনে থাকা কমিউনিস্ট পার্টির তখনকার দিনে সদস্য পদ পাওয়ার দুর্লভ সম্মান লাভ করেন। ১৯৫৮ সালে তিনি ছাত্র ইউনিয়ন কেন্দ্রীয় কমিটির কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েই তিনি পাকিস্তানের সেনা প্রধান দোর্দণ্ড প্রতাপশালী আইয়ুব বিরোধী ছাত্র গণআন্দোলন সংগঠিত করার কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েন পার্টির নির্দেশে। ১৯৬২ সালে তাঁর বিরুদ্ধে প্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়। সেই থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত হুলিয়া মাথায় নিয়ে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘ ছাত্র গণআন্দোলনের পেছনে মূল ভূমিকা পালন করে আন্দোলনকে সমস্ত আপোষ কামিতা ও হঠকারী প্রবণতা থেকে রক্ষা করে সঠিক ও শুদ্ধ ধারায় চূড়ান্ত পরিণতির দিকে নিয়ে যান। ’৬৯এর গণঅভ্যূত্থানের প্রকাশ্যে মূল নেতা যদি হন তোফায়েল আহমদ ও সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক সেই অভূতপূর্ব মৃত্যুঞ্জয়ী গণঅভ্যুত্থানের প্রতিমুহূর্তের বুদ্ধিদাতা, কৌশল প্রণেতা ও কান্ডারী ছিলেন আত্মগোপনকারী কমিউনিস্ট নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ।

আওয়ামী লীগ স্বীকার না করলেও ঐতিহাসিক সত্য হলো ১৯৭১ সালে সেদিনের পরাক্রান্ত পরাশক্তি সোভিয়েত ইউনিয়নকে মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সর্বাত্মকভাবে নিয়ে এসে বিজয় নিশ্চিত করার গুরু দায়িত্ব পালন করে সেদিনের সিপিবি। সেই যুগান্তকারী ভূমিকার অন্যতম নায়ক ছিলেন মোহাম্মদ ফরহাদ। তিনি ছিলেন ন্যাপ সিপিবি’র নেতৃত্বাধীন বিশেষ গেরিলা বাহিনীর কেন্দ্রীয় যুগ্ম কমান্ডার। মুক্তিযুদ্ধের পরে ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সিপিবি’র দ্বিতীয় কংগ্রেসে মণি সিং প্রমুখ বয়োজ্যেষ্ঠ কমিউনিস্ট নেতারা তাঁদের পুত্রসম মোহাম্মদ ফরহাদকে অসাধারণ যোগ্যতার কারণে মাত্র ৩৫ বছর বয়সে পার্টির সাধারণ সম্পাদকের গুরুত্বপূর্ণ পদে নির্বাচিত করেন। নির্বাচিত হয়েই তাঁকে একের পর এক ক্রমাবনতিশীল ও জটিল রাজনৈতিক পরিস্থিতি মোকাবিলা করে পার্টিকে এগিয়ে নিতে হয়। ১৯৭৮ সালে সামরিক শাসক জিয়া তাঁর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা দায়ের করে তাঁকে গ্রেপ্তার করেন এবং পার্টিকে নিষিদ্ধ করেন। তাঁর উদ্যোগে ১৯৮৩ সালে এরশাদ বিরোধী ১৫ দলীয় জোট গঠন ও সেই আন্দোলনে সিপিবি’র বিশাল ভূমিকার ফলে পার্টি ও গণসংগঠনসমূহের ব্যাপ্তি ঘটে। ১৯৮৬ সালে আন্দোলনের এক পর্যায়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে ১৫ দলের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার পূর্ব সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার “রনো মেননদের” আকস্মিক সিদ্ধান্ত ও তাতে বৃহত্তর গণতান্ত্রিক আন্দোলনের ক্ষতি সাধন মোহাম্মদ ফরহাদ মানতে পারেননি, যা কৌশলগত পরাজয় এড়াতে এরশাদকে সাহায্য করে। পূর্ব প্রতিশ্রুতিমতো বিএনপিসহ সবাই নির্বাচনে ঝাঁপিয়ে পড়লে ১৯৮৬ সালেই দুই তৃতীয়াংশ আসন না পেয়ে এরশাদকে পদত্যাগ করতে হতো। ৮ দলীয় জোট একাই প্রয়োজনীয় ১১১টি আসনের মধ্যে ১০০’র কাছাকাছি আসন পেয়েছিল। সেই কঠিন পরিস্থিতিতে আসন সংখ্যা নিশ্চিত করতে বাধ্য হয়ে ন্যাপ সিপিবিকে নৌকা প্রতীকে নির্বাচন করতে হয়েছিল। কারণ তা ছিল তখনকার মূর্ত পরিস্থিতিতে গৃহীত একটি মূর্ত সিদ্ধান্ত। অথচ ফরহাদের কথিত “আওয়ামী প্রীতি’র” অভিযোগ যারা করেন তাঁরা ভুলে যান যে তাঁর সময়ে ১৯৭০, ’৭৩, ’৭৯ ও ’৮১ সালসহ প্রায় সব নির্বাচন ন্যাপসিপিবি নৌকায় নয় নিজেদের প্রতীকে করেছে। মূল লক্ষ্য ঠিক রেখে ঃৎরধষ ধহফ বৎৎড়ৎ পদ্ধতিতে এগিয়ে চলাই হলো মার্কসীয় পদ্ধতি। মার্কসবাদ কোনো বিধিবদ্ধ সিস্টেম নয়। ১৯৮৬ সালের সংসদে সিপিবি’র ৬টি আসন ছিল। মোহাম্মদ ফরহাদ ছিলেন জাতীয় সংসদে প্রথম সিপিবি সংসদীয় গ্রুপের নেতা। বাজেটসহ বিভিন্ন ইস্যুতে সেদিন তাঁর বক্তব্য জাতীয়ভাবে প্রশংসিত হয়। সিপিবি জাতীয় দলের মর্যাদা পায়।

এ সময় অহর্নিশ টানা পরিশ্রমে ক্লান্ত জননেতা ফরহাদ হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং চিকিৎসার জন্য মস্কো গিয়ে ১৯৮৭ সালের ৯ অক্টোবর আকস্মিকভাবে মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর মৃত্যুর খবর পেয়ে সেদিন আমি প্রিয় নেতার বিয়োগ ব্যথায় শুধু নয় এর ফলে সৃষ্ট শূন্যতায় রাজনীতির অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা ভেবে মুষড়ে পড়েছিলাম। এ মৃত্যু তখনি আমার কাছে দেশের প্রগতিশীল শক্তির জন্য এক আসন্ন ভয়াবহ বিপর্যয়ের অশনি সংকেতের মতো বাজছিল। বাস্তবে ঘটেছেও তাই। রাজনীতিতে কৌশলগত ভুল হয়তো তিনি করেছিলেন কিন্তু কখনো মৌলিক ভুল করেননি। অন্ধ আওয়ামী লীগ বিরোধিতার হঠকারী বাম বিচ্যুতি যেমন করেননিঅবশ্য তখন আওয়ামী লীগ ভাবাদর্শিকভাবে আজকের তুলনায় অনেক উন্নত ছিল, আবার আওয়ামী লীগের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে গিয়ে জিয়ার অধীনে গণতান্ত্রিক সুযোগ ও পরিবেশ সৃষ্টির তাগিদে পার্টির সিদ্ধান্তে ১৯৭৯ সালে জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছেন। ১৯৮১ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে আওয়ামী প্রার্থীর বিরুদ্ধে ন্যাপসিপিবি আলাদাভাবে প্রার্থী করেছিল প্রবীণ বাম নেতা অধ্যাপক মোজাফফর আহমদকে। আমার মনে হয় তাঁর জীবনের অনন্য অর্জন হলো ১৯৬৬ থেকে আমৃত্যু প্রায় ২১ বছর ধরে দৃঢ় ভাবাদর্শিক লড়াইয়ের মাধ্যমে অন্যান্য দেশের মতো আমাদের দেশেও চীন সোভিয়েত মতাদর্শিক দ্বন্দ্বে সৃষ্ট এক অতিবাম রাজনীতির বহুরূপী অপচ্ছায়া, লেনিন কথিত ‘ইনফেন্টাইল ডিজঅর্ডারকে রাজনীতিতে অপ্রাসঙ্গিক করে দিয়ে প্রকৃত বাম রাজনীতিকে প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছিলেন। অন্যদিকে গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার লেনিনীয় সাংগঠনিক শৃঙ্খলা মেনে সিপিবিকে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পেরেছিলেন। সিপিবি’র এই শুদ্ধ রাজনীতি ও শক্তির প্রভাবে ’৭০ ও ’৮০’র দশকে আমাদের দেশে শ্রেণিপেশার আন্দোলনে শুধু নয়, সামাজিকসাস্কৃতিক বলয়ে, বৌদ্ধিক জগতে তথা দেশের প্রথম সারির প্রগতিশীল শিক্ষক, শিল্পী, কবি লেখকদের মধ্যে সিপিবির সমর্থক এক বিশাল বলয় গড়ে উঠেছিল, যা যেকোনো বিপ্লবী পার্টির রাজনৈতিক ও সামাজিক শক্তি বিন্যাসের জন্য গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

তিনি আমৃত্যু বিপ্লবের স্বপ্ন দেখেছেনসেই স্বপ্নে দেশব্যাপী কর্মী সমর্থকদের তাড়িত করতে পেরেছিলেন। সেই স্বপ্ন কোন মেটাফিজিক্যাল বা আধিভৌতিক আবেগ ও উচ্চাশা নির্ভর ছিল না। সেই স্বপ্নের পিছনে ছিল বাংলাদেশের বিষয়গত বাস্তবতা পরিবর্তনের বিরাজিত সম্ভাবনা। প্রয়োজন ছিল বিষয়ীগত বা সাবজেক্টিভ শক্তি সমাবেশ। তা গড়ে তুলতেও তিনি অনেকদূর অগ্রসর হতে পেরেছিলেন। যদি প্রশ্ন করা হয় আজকের এই সর্বগ্রাসী সামাজিক রাজনৈতিক সংকটের কারণ কিদ্বিধাহীন উত্তর হবে শক্তিশালী ও নিষ্ঠ বাম আন্দোলন তথা প্রভাবশালী একটি কমিউনিস্ট পার্টির অনুপস্থিতি। যদি জিজ্ঞাসা করা হয় কেন এই শক্তির দুর্বলতাজনিত আজকের এই সংকট? এর আংশিক উত্তর হবে পার্টিতে মনি সিং, খোকা রায়, জ্ঞান চক্রবর্তী, আবদুস সাত্তারদের মতো সর্বস্ব ত্যাগের মন্ত্রে উজ্জীবিত এবং তাঁদের সার্থক উত্তরসূরী মোহাম্মদ ফরহাদের মতো গুণেমানে, প্রজ্ঞায়, আন্তরিকতায় একাধিক স্বাপ্নিক নেতার অভাব। আসুন সামষ্টিক প্রচেষ্টায় সে অভাব বিদূরিত করার কাজ করি। নিজেদের গড়ে তুলি বিপ্লবী মানবতার পথে। কমরেড মোহাম্মদ ফরহাদ অমর রহে।

লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট, অবসরপ্রাপ্ত কলেজ শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধস্মরণ : ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী
পরবর্তী নিবন্ধজেলা পর্যায়ে জুডো প্রশিক্ষণ ক্যাম্প ১২ অক্টোবর শুরু