চট্টগ্রামকে জলাবদ্ধতামুক্ত পরিচ্ছন্ন শহর গড়ে তোলার পাশাপাাশি সিটি কর্পোরেশনকে (চসিক) স্বাবলম্বী করে তোলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মেয়রের দায়িত্ব নেন ডা. শাহাদাত হোসেন। সেই দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিন পূর্ণ হচ্ছে আজ বৃহস্পতিবার। দায়িত্ব পালনকালীন নিজের প্রতিশ্রুতির কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন মেয়র? এ প্রশ্নই এখন নগরবাসীর। অবশ্য নাগরিকরা নিজেরাই প্রাপ্তি–অপ্রাপ্তির হিসাব মেলাচ্ছেন। তবে সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন বলে আজাদীকে জানিয়েছেন ডা. শাহাদাত হোসেন।
মেয়র জানান, বেদখলে থাকা প্রিমিয়ার ভার্সিটি উদ্ধার, জলাবদ্ধতা নিরসনে খাল খননসহ নানা পদক্ষেপ গ্রহণ, দিনের পরিবর্তে রাতে বর্জ্য অপসারণ, চসিককে স্বাবলম্বী করতে বন্দর থেকে মাশুল এবং পঞ্চবার্ষিকী কর পুনর্মূল্যায়নের আলোকে পৌরকর আদায়ের উদ্যোগ, খেলার মাঠ নির্মাণ, সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিত, বিপ্লব উদ্যানকে বাণিজ্যিকীকরণের হাত থেকে রক্ষা, কর্মস্থলে পরিচ্ছন্নকর্মীদের উপস্থিতি নিশ্চিতে ওয়ার্ডে ওয়ার্ডে পরিদর্শন ও পরিচ্ছন্নকর্মীদের হাজিরা নেয়াসহ নাগরিক সেবা নিশ্চিতে নানা উদ্যোগ নিয়েছেন। বাস্তবায়নের অপেক্ষায় আছে নগরের দীঘিগুলোকে উন্মুক্ত করে দেয়াসহ শহরকে সাজাতে নিজের নানা পরিকল্পনাও। এরপরও কিছু অসন্তুষ্টি আছে মেয়রের। চসিকের প্রকৌশল বিভাগের ধীরগতির কারণে সড়কের সংস্কার করতে না পারায় এ অসন্তুষ্টির কারণ বলে জানান তিনি।
দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিন উপলক্ষে গতকাল বুধবার দৈনিক আজাদীর সঙ্গে একান্ত আলাপ হয় মেয়রের। এসময় নিজের কাজের উপর নিজে কতটুকু সন্তুষ্ট আছেন? এমন প্রশ্নে ডা. শাহাদাত আজাদীকে বলেন, জনগণ কতটুকু সন্তুষ্ট হয়েছে তার উপর নির্ভর করছে আমার সন্তুষ্টি। আমি পার্সোনালি আরো অনেক বেশি কাজ করতে চেয়েছি। আসলে আমার যতটুকু ইচ্ছে শক্তি ছিল সেই অনুযায়ী হয়তো পারিনি। কিন্তু আমার আন্তরিকতার কোনো কমতি ছিল না।
মেয়র বলেন, একটা কাজ করে খুব আনন্দ পেয়েছি। সেটা হচ্ছে, চকবাজারে একসময় রাস্তায় বাজার বসে যেত। এতে সেখানে যানজট লেগে থাকত। সাধারণ মানুষের চলাচল করতে খুব কষ্ট হত। বাজারের জন্য বাকলিয়া সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়, বাকলিয়া গার্লস হাইস্কুল, বিএড কলেজের শিক্ষার্থীদের তাদের প্রতিষ্ঠানে যেতে সমস্যা হত। এ সমস্যা নিরসন করেছি। রাস্তা থেকে বাজারটা তুলে ব্যবসায়ীদের চকবাজার মার্কেটের দ্বিতীয় ও তৃতীয় তলায় পুনর্বাসন করে দিয়েছি। এতে চকবাজার এলাকা পরিষ্কার হয়ে গেছে। এলাকার মানুষ অনেক খুশি। তাই এখানে আমারও সন্তুষ্টি আছে।
দায়িত্বপালনকালীন কোনো প্রতিবন্ধকতা বা সীমাবদ্ধতা ছিল কীনা জানতে চাইলে ডা. শাহাদাত বলেন, সীমাবদ্ধতা অবশ্যই আছে। রাস্তাঘাটের যে কাজগুলো করার কথা ছিল, সেখানে মেজর (প্রধান) কাজগুলো তিন মাসেও ধরতে পারিনি। এটার কারণ হচ্ছে প্রকৌশল বিভাগের স্লোনেস (ধীরগতি বা মন্দগতি)। আমার অসন্তুষ্টির জায়গা হচ্ছে রাস্তাঘাটের সংস্কার করতে পারিনি। আমার ইচ্ছে ছিল আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকার রাস্তাটি সংস্কার করে দেয়ার। সেটা পারিনি। আমার এখানেই দুঃখ, যেভাবে চেয়েছি সেভাবে রাস্তাগুলো করতে পারিনি। দুইদিন আগে প্রকৌশলীদের সঙ্গে বসে কড়া নির্দেশও দিয়েছি। এখন অবশ্যই ইঞ্জিনিয়াররা আশস্ত করছেন, কাজ শুরু হয়েছে। মেয়র বলেন, কিছু প্রতিবন্ধকতাও আছে। যেমন ওয়াসা। তারা জাইকার প্রকল্প, ওই প্রকল্প বলে আমাদের সুন্দর সুন্দর রাস্তাগুলো কেটে ফেলে, এটা আমিও অনেক সময় জানি না। রাস্তা কেটে ফেললে মানুষের দুর্ভোগ হয়, এতে আমার খারাপ লাগে।
সেবা সংস্থাগুলোর সঙ্গে সমন্বয় নিশ্চিত করা যাচ্ছে কীনা জানতে চাইলে মেয়র বলেন, আগে সেবা প্রদানকারী সংস্থাগুলোর মধ্যে সমন্বয় ছিল না। এখন সেটা করতে পারছি। এখন আমরা রেগুলার বসছি, বিশেষ করে মাসে একবার বসা হয়। আমরা কর্মপরিকল্পনাও ঠিক করেছি, কে কি কাজ করবে সেটা অগ্রিম জানিয়ে দেয়া।
১০০ দিনে উল্লেখযোগ্য সাফল্যগুলো জানতে চাইলে মেয়র বলেন, ২০১৬ সাল থেকে বেদখলে থাকা প্রিমিয়ার ইউসিভার্সিটি উদ্ধার করেছি। বেদখল হওয়ার পর দুইজন মেয়র এবং একজন প্রশাসক ছিলেন কর্পোরেশনে। তারা কেউ উদ্ধার করতে পারেননি। তিনি বলেন, বিপ্লব উদ্যানও অনেকটা দখল করে বাণিজ্যিকভাবে দোকানপাট নির্মাণ করা হচ্ছিল। সেগুলো ভেঙে দিয়েছি। এখন গ্রিন পার্ক করা হবে বিপ্লব উদ্যানে। এছাড়া প্রতিটি ওয়ার্ডে সবুজায়ন করার উদ্যোগ নিয়েছি। সেজন্য দরপত্র আহ্বান করেছি। ৪০০ জন আবেদন করেছেন। সিটি কর্পোরেশন, সিডিএ এবং জেলা প্রশাসন যৌথভাবে পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে সৌন্দর্যবর্ধন করেছি। সেখানে টলয়েট ফ্যাসিলিটি নিশ্চিত করা হয়েছে। লাইটিং করা হয়েছে, যেন সাধারণ মানুষ রাতের বেলায়ও সেখানে যেতে পারেন। যানজট নিরসনের জন্য আগ্রাবাদে পে–পার্কিং সিস্টেম করে দিয়েছি।
নিজের প্রতিশ্রুত খেলার মাঠ নির্মাণে গৃহীত উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহাদাত বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে ৪১টি খেলার মাঠ করার প্রতিশ্রুতি ছিল আমার। এর মধ্যে ৭টির ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছি। আগ্রাবাদ জাম্বুরি মাঠ শিশু পার্কের ভেতর ছিল, সেখান থেকে বের করে সর্বসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে কাজ চলছে। সেখানে দৃষ্টিনন্দন ওয়াকওয়ে থাকবে।
‘কর্পোরেশনের অন্যতম প্রধান কাজ হচ্ছে সড়কবাতি স্থাপনের মাধ্যমে আলোকায়ন করা। সেক্ষেত্রে কি কাজ করেছেন জানতে চাইলে মেয়র বলেন, সড়কবাতি স্থাপনে ১৮ কোটি টাকার একটি টেন্ডার হয়ে গেছে। ৩৪ কোটি টাকার আরো দুটো টেন্ডার হবে।
‘কর্পোরেশনের অন্যতম প্রধান কাজ বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিষয়ে কী উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে শাহাদাত বলেন, আগে দিনের বেলা পরিচ্ছন্ন কার্যকক্রম পরিচালনা করা হত। এতে পথচারী এবং নগরবাসীর সমস্যা হত। তাই সময় পরিবর্তন করেছি। এখন দিনের পরিবর্তে রাতে পরিচ্ছন্ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে। একইসঙ্গে এ কার্যক্রমে গতি আনা হচ্ছে। পরিচ্ছন্নকর্মীরা যাতে কাজে ফাঁকি না দেয় সেজন্য বিভিন্ন ওয়ার্ডে আমি সরেজমিন পরির্দশন করেছি। পরিচ্ছন্নকর্মীদের হাজিরা নিয়েছি। কোথাও অনিয়ম পেলে সতর্ক করেছি এবং ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।
নির্বাচনী ইশতেহারে থাকা জলাবদ্ধতা নিরসনে গৃহীত উদ্যোগ সম্পর্কে জানতে চাইলে ডা. শাহাদাত বলেন, চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় সমস্যা জলাবদ্ধতা নিরসনের উপর মনোযোগ বেশি দিচ্ছি। তাই খালগুলো পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করে পানি প্রবাহ সচল রাখার ব্যবস্থা করছি। এতদিন যে খালগুলো কেউ পরিষ্কার করেনি সেগুলোর দিকে নজর দিচ্ছি। যেমন কৃষি খাল, বিকল্প খাল ও গুপ্তা খাল। তিনি বলেন, আমার দায়িত্ব পালনকালীন তিন মাসে জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দিচ্ছেন। একইসঙ্গে জলাবদ্ধতা নিরসনে চলমান মেগা প্রকল্প বহির্ভূত ২১টি খালকেও জলাবদ্ধতা প্রকল্পে আনার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এই ৫৭টি খাল ছাড়া জলাবদ্ধতা নিরসন সম্ভব নয়, এটা আমিই ভয়েস রেইস করেছি।
দায়িত্ব নেয়ার সময় ৪১১ কোটি টাকার দেনা ছিল চসিকের। দেনামুক্ত করে চসিককে স্বাবলম্বী করতে কি উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানতে চাইলে মেয়র বলেন, কর্পোরেশনকে স্বাবলম্বী করার জন্য মাশুল হিসেবে বন্দরের কাছে তাদের আয়ের ১ শতাংশ অর্থ চেয়েছিলাম। ওটা হলে সাড়ে ৫০০ কোটি টাকা পাওয়া যেত। কিন্তু এটা তাদের আইনের কারণে দেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাই তাদের কাছে পঞ্চবার্ষিকী করপুনর্মূল্যায়নের আলোকে প্রস্তাবিত ১৬০ কোটি ১৬ লাখ ৪১ হাজার টাকার পৌরকর চেয়েছি। সেটা দেয়ার জন্য বন্দরও নীতিগতভাবে একমত হয়েছেন। অথচ বর্তমানে বন্দরের পৌরকর ধার্য আছে মাত্র ৪৫ কোটি টাকায়।
দায়িত্ব গ্রহণের দিন চসিকের স্বাস্থ্যখাতের উন্নয়নে দেয়া প্রতিশ্রুতির বিষয়ে জানতে চাইলে শাহাদাত বলেন, মেমন হাসপাতালকে ডেডিকেটেড হাসপাতাল করছি। একটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা চলছে; তাদের সহায়তায় সেখানে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সেবার ব্যবস্থা করা হবে। ডায়ালাইসিস, কার্ডিয়াক মেডিসিন, সার্জারি, গাইনি সব সেবা থাকবে। সেখানে জিরো ক্যাশ কাউন্টার সেবা হবে। এছাড়া আরবান ডিসপেনসারিগুলোকে সাজানোর পরিকল্পনা আছে। সেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে। সেখানে মেটারনাল এবং চাইল্ড ফ্যাসিলিটিজটা নিশ্চিত করতে চাচ্ছি।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে শাহাদাত বলেন, সবগুলো দীঘি উন্মুক্ত করে দেয়ার পরিকল্পনা আছে। বিশেষ করে আসকার দীঘি, ভেলুয়ার দীঘি এবং ডেবার পাড়। আসকার দীঘির মালিকের সঙ্গে কথা বলেছি। ওখানে ফার্নিচারের যেসব দোকান আছে তাদের মালিকের সঙ্গে নিয়মিত কথা হচ্ছে। সেখানে একপাশে একটা মার্কেট করে দোকানগুলো সেখানে স্থানান্তর করতে চাচ্ছি। দীঘির চতুর্দিকে ওয়াকওয়ে ও লাইটিং করা হবে। দীঘিটা উন্মুক্ত হলের ওখানকার দৃশ্যটা চেঞ্জ হয়ে যাবে। সবাই আসকার দীঘির নাম শুনেছে, কিন্তু দীঘিটা কেউ দেখে না। আমি চাই দীঘিটা সবাই দেখুক। ডেবার পাড় নিয়ে রেলওয়ে ও বন্দরের সঙ্গে কথা চলছে। আশা করছি সেখানেও কাজ শুরু করব।
উল্লেখ্য, ২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত হয় চসিকের ষষ্ঠ পরিষদের নির্বাচন। এতে ‘ধানের শীষ’ প্রতীকে বিএনপির প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন ডা. শাহাদাত। আওয়ামী লীগের মেয়র প্রার্থী মো. রেজাউল করিম চৌধুরীকে নির্বাচিত ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। একই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি শপথ নেন এবং ১৫ ফেব্রুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন রেজাউল করিম। ২০২১ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি ডা. শাহাদাত ৯ জনকে বিবাদী করে নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা করেন। গত ১ অক্টোবর চট্টগ্রামের প্রথম যুগ্ম জেলা জজ ও নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালের বিচারক খাইরুল আমিন ডা. শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করে এ মামলার রায় দেন। রেজাউল করিম চৌধুরীর মেয়র নির্বাচনের ফলাফল বাতিল করেন। এরপর ৮ অক্টোবর ডা. শাহাদাত হোসেনকে মেয়র ঘোষণা করে সংশোধিত প্রজ্ঞাপন জারি করে নির্বাচন কমিশন। সর্বশেষ ৩ নভেম্বর শপথ বাক্য পাঠ করেন এবং ৫ নভেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্বগ্রহণ করেন মেয়র শাহাদাত। ওই হিসেবে আজ দায়িত্ব গ্রহণের ১০০ দিন পূর্ণ হয়েছে তার।