ছাত্র জীবন থেকে ডা. মোঃ আফছারুল আমীনের জনকেন্দ্রীয় মন–মানসিকতা তাঁকে জনগণের খুব কাছাকাছি নিয়ে যায়। ছাত্র জীবনের শুরুতে বাবার পাশাপাশি এলাকার মানুষের সুখে দুঃখে উনি সব সময় এগিয়ে আসতেন। যে কোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এলাকার মানুষের সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতেন। স্বাধীনতাকামী ডা. মোঃ আফছারুল আমীন শৈশবের সেই দিনগুলোতে স্বাধীনতার লড়াকু সৈনিক হিসেবে নিজেকে ধাপে ধাপে তৈরি করতে থাকেন। স্কুলের গণ্ডি পাড় হয়েই সিটি কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকে অধ্যয়নকালে ১৯৬৭ সাল থেকে তিনি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যান। সেই সময় তার আপন ছোট চাচা সিরাজুল আমীন সিটি কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন। চাচার সাথে থেকে থেকে কলেজ জীবনের শুরুতেই রাজনীতিতে দীক্ষা নেন। স্বাধীনতা বিরোধী যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামে নিজেকে জড়িয়ে আস্তে আস্তে রাজনীতির বিভিন্ন ধারায় প্রবেশ করতে থাকেন। পাকিস্তান সরকারের যে কোনো অন্যায় দাবির বিরুদ্ধে তিনি যে কোনো আন্দোলন সংগ্রামের অগ্রভাগে ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর ছয় দফা আন্দোলন; ছাত্রদের ১১ দফাসহ তৎকালীন বিভিন্ন দাবি–দাওয়া নিয়ে ছাত্র রাজনীতিতে সক্রিয় ছিলেন। ৬৯–এর গণঅভ্যুত্থান থেকে শুরু করে ‘পাকিস্তান’ দেশ ও কৃষ্টির পুস্তক বিরোধী আন্দোলন সংগ্রামের মিছিলে সমাবেশে ছাত্র আফছারুল আমীন সব সময় সক্রিয় থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। ১৯৭১ সালের ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। তার দুঃসাহসিক অভিযানগুলো মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য হয়ে আছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক মুক্তিযুদ্ধে ডা. মোঃ আফছারুল আমীনের সরাসরি অংশগ্রহণ চট্টগ্রামের ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় পাকিস্তান বর্বর সেনাবাহিনী থেকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা সূর্য ছিনিয়ে আনার জন্য তিনি মুক্তিযুদ্ধে অস্ত্র হাতে তুলে নেন। যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রগুলো গোপনে সংরক্ষণ করার দায়িত্বও তিনি পালন করতেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে হালিশহর কেন্দ্রিক সকল ধরনের কার্যক্রমে তিনি গোপনীয়তা রক্ষা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা করতেন। বিশেষ করে চট্টগ্রাম শহরের ঝাউতলা, টাইগার পাস, আশেপাশের এলাকায় আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা সেবা দেওয়ার জন্য তিনি সকলের সাথে কাজ করে গেছেন। মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের বিশেষ টিমের সাথে চিকিৎসা সেবা দিয়ে গেছেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন তার দুঃসাহসিক অভিযানগুলো অনেক বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর পাশাপাশি এদেশের কতিপয় আলবদর আলশামস বাহিনী মীরজাফরের ভূমিকা পালন করে। স্বাধীনতা সূর্যকে ছিনিয়ে আনার ক্ষেত্রে সেই সব ঘৃণিত মীরজাফরদের বিরুদ্ধে সূর্য সন্তানদের লড়তে হয়েছে। ঘরের ও বাইরের শত্রুদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময় সরাসরি যুদ্ধ করে একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তিনি কখনো আলাদাভাবে কোন ধরনের সহযোগিতার জন্য আবেদন করেননি। ২০২০ সাল থেকে দুরারোগ্য জটিল রোগ ক্যান্সারের চিকিৎসা জন্য কোনও সরকারি সহায়তা নেননি। বরং অন্য মুক্তিযোদ্ধাদের স্বীকৃতির জন্য কাজ করে গেছেন। বিশেষ করে এলাকার কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধাকে তিনি স্বীকৃতি থেকে শুরু করে সরকারি সুযোগ–সুবিধা লাভের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয় লাভের পর ডা. মোঃ আফছারুল আমীন আবার লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন। চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজে লেখাপড়ার পাশাপাশি ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িয়ে যান। ছাত্র রাজনীতির এক পর্যায়ে ১৯৭৩ সালে তিনি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ শাখা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এভাবে ধাপে ধাপে কেন্দ্রীয় রাজনীতির দিকে এগোতে থাকেন। ১৯৭৫ সালে ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কালো অধ্যায় শুরু হয়। সেই সময় এই ঘৃণ্য হত্যাকারদের প্রতিবাদ করার তখন কেউ সাহস পাননি। সেই পরিস্থিতিতে নিজের অস্তিত্বের জন্য অনেক বড় বড় মাপের নেতারা তেমন প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেননি। কিন্তু পরবর্তীতে ১৯৭৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও জাতীয় চার নেতার হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে আস্তে আস্তে প্রতিবাদ সমাবেশ শুরু হয়। সেই সব হত্যাকাণ্ডের ও বাংলাদেশের ইতিহাসের কালো অধ্যায়ের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম আরো বেগবান হতে থাকে। সেই দিনগুলোর প্রতিবাদ সমাবেশে আফছারুল আমিন সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ফলে তাঁকে অনেক ভাবে হেনস্তার স্বীকার হতে হয়। রাজনৈতিক জীবনযাত্রায় অনেক ছন্দ পতন ঘটে। তৎকালীন সামরিক সরকারের নির্দেশে তিনি গ্রেফতার হন। গ্রেফতার হওয়ার পর তিনি ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারে কারাভোগ করেন। ডা. মোঃ আফছারুল আমীন দেশের রাজনৈতিক বিষয়গুলো নিয়ে কখনো আপস করেননি। তাঁর দৃঢ় আপসহীন মনোভাব তাঁকে স্বীয় অবস্থানে অনড় থাকতে সহায়তা করে। কোনো ধরনের অসংগতি ও অন্যায়ের কাছে মাথা নত করেননি। বরং সব সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে কঠোরতা অবলম্বন করেন। ফলে কারো কারো কাছে অপ্রিয় হয়েছেন, সমালোচিত হয়েছেন। তবুও নিজের সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। বাংলাদেশের রাজনীতির ধারাবাহিকতায় রাজনীতিবিদ ডা. মোঃ আফছারুল আমীন অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তার অবস্থান পাকাপোক্ত করেন। বাস্তবতায় সরকারি চাকরি করার ক্ষেত্রে সরাসরি রাজনীতি অনেকটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। ১৯৭৫ পরবর্তী সময়ে তৎকালীন শাসক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও জেনারেল এরশাদের শাসনামলে অযাচিত হস্তক্ষেপের সম্মুখীন হতে হয়। বেশ কয়েক বার সেনাবাহিনীর জবাবদিহি করতে হয়। কিন্তু কোনও ধরনের ঘাত প্রতিঘাত ডা. মোঃ আফছারুল আমীনের অবস্থান থেকে সরাতে পারেনি।
জনকেন্দ্রিক ডা. মোঃ আফছারুল আমীন ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হালিশহরসহ উপকূলীয় অঞ্চলের প্রতিটি ঘরে ঘরে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন। তছনছ হয়ে যাওয়া উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষের অমানবিক ও অসহায় অবস্থায় একজন মহা মানবের প্রয়োজন ছিল। সেই সময় ঘরে ঘরে সাহায্য সামগ্রী পৌঁছে দেওয়ার জন্য তিনি সকলকে নিয়ে একত্রে কাজ করেন। সকলের সাহায্যের হাত একত্রিত করে একটি বিশাল সাহায্য সেবা কার্যক্রম পরিচালনা করেন। উপকূলীয় অঞ্চলের মানুষরা এখনো ১৯৯১ সালের সেই ঘূর্ণিঝড়ের স্মৃতি বয়ে বেড়াবেন। এই অঞ্চলের জনগণ সাহায্য সহযোগিতার জন্য তাঁর অদম্য সাহসী ভূমিকা কখনো ভুলবে না। একজন চিকিৎসক হিসেবে শুধুমাত্র নয়; একজন মানব দরদী রাজনীতিবিদ হিসেবে সকলের জন্য সাহায্যের হাত প্রসারিত থাকতো। যেকোনো সামাজিক ও পারিবারিক সমস্যার কারণেও অনেকেই তাঁর কাছে ছুটে আসতেন। তিনি তাদের সমস্যার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। যাকে যেভাবে পারেন সেভাবেই সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকতেন। বাবা ডাক্তার মো. ফজলুল আমীনের মত এই এলাকার জনগণের স্বাস্থ্য সেবায় নিজেকে নিয়োজিত করেন। আর্থিকভাবে যারা খুবই দুর্বল ছিল তাদেরকে ব্যবস্থাপত্র ও টাকা পয়সা দিয়ে সাহায্য করতেন। যারা শিক্ষিত এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গেছেন তাদেরকে সঠিকভাবে পরিচালিত করে দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সুপ্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করেন। তাঁর দূরদৃষ্টি সম্পন্ন মনোভাবের ফলে অনেকে নিজেদের অবস্থানে সফলতা লাভ করেন। তিনি অনেক স্কুল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। দক্ষিণ কাট্টলীর মত এক অজপাড়া গাঁয়ে শিক্ষার বিষয়টি মাথায় রেখে ডা. ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রি কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। শিক্ষা চিকিৎসা ও অন্যান্য ক্ষেত্রে এলাকার মানুষের পাশে সব সময় ডা. মোঃ আফছারুল আমীনের অবস্থান ছিল মানবিক ও সহযোগিতাপূর্ণ। সাধারণ মানুষের জন্য তাঁর হৃদয়ে ছিল অফুরন্ত ভালোবাসা। হাঁটি হাঁটি পায়ে শৈশবের সেই ছাত্র জীবন থেকে স্বীয় মহিমায় মহিমান্বিত হয়ে সকলের হৃদয়ের স্থান করে নিয়েছেন। দক্ষিণ কাট্টলীর ইতিহাসে দ্বিতীয় আর কোনও ডা. মোঃ আফছারুল আমীনের জন্ম হবে কী না সন্দেহ আছে। হয়তো কতশত বছর অপেক্ষা করতে হবে। কারণ তার মত একজন নির্ভীক নির্লোভ নিরহংকার মানবিক মানুষ বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে খুবই বিরল। অনেক অনেক সুযোগ–সুবিধা থাকা সত্ত্বেও উনি নিজের এবং সন্তানদের জন্য তেমন কিছু করে যাননি। জীবনযুদ্ধে এগিয়ে যাওয়া একজন সাধারণ বাবার মতই তিনি তার সন্তানদের মন মানসিকতা তৈরি করেছেন। এই সাধারণ মানবিক গুণাবলীই তাকে অসাধারণ করে তুলেছে। বর্তমান প্রজন্ম এই মানবিক গুণাবলীর অসাধারণ মানুষটির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যগুলোকে অনুসরণ করে এগিয়ে চলুক। দেশের প্রতিনিধিত্ব করুক। ডা. মোঃ আফছারুল আমীন আগামী প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হিসেবে বেঁচে থাকুক।
লেখক : অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রি কলেজ, চট্টগ্রাম