কক্সবাজারে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়নের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক। ব্যস্ততম এই সড়কে দিন দিন বাড়ছে যানবাহনের চাপ। ২০১৭ সালে কক্সবাজারে এক জনসভায় দুই লেনের সড়কটি চার লেনে উন্নীত করার ঘোষণা দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তবে ভবিষ্যৎ চিন্তা করে এই মহাসড়ককে চার লেন করার পরিকল্পনা থেকে সরে এসেছে সরকার।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, বর্তমানে মহাসড়কটি ছয় লেন বা আট লেন করতে বুয়েট বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্টাডি চালাচ্ছে সরকার। স্টাডি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হলে জানা যাবে মহাসড়কটি কয় লেনের হবে। সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ২০১৯ সালে সরকার চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়কটি চার লেনের বদলে ছয় লেনের ‘এক্সেস কন্ট্রোল এক্সপ্রেসওয়ে’ নির্মাণ করার পরিকল্পনা করে করে সরকার। কক্সবাজার ঘিরে সরকারের জ্বালানি উৎপাদন অঞ্চল, সাবরাং ও সোনাদিয়ায় বিশেষায়িত পর্যটন অঞ্চল এবং মহেশখালীর মাতারবাড়িতে সমুদ্রবন্দর নির্মাণসহ ব্যাপক উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের ফলে অনেক গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে কক্সবাজার। সেই সুফল পেতে দুটি ইমার্জেন্সি লেনসহ ছয় লেনের এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণ ছাড়াও ধীরগতি এবং স্থানীয় গাড়ি চলাচলের জন্য দুটি সার্ভিস লেন নির্মাণেরও সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। তবে এই মহাসড়ককে নিয়ে ভবিষ্যতের জন্য আরো সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা করছে সরকার। এজন্য বার বার সিদ্ধান্ত বদল করে নতুন নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে হচ্ছে।
ছয় বা আট লেন যা-ই হোক, কর্ণফুলী সেতুর পর থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত ১৩৬ কিলোমিটার দীর্ঘ এই এক্সপ্রেসওয়ে হবে টোল রোড। অর্থাৎ এই রোডে চলতে গেলে মাশুল দিতে হবে। সড়কের গতিসীমা ঠিক রাখতে বাইরে থেকে এক্সেস কন্ট্রোল বা যান প্রবেশ নিয়ন্ত্রিত থাকবে। দীর্ঘ সড়কের দুই পাশে থাকবে নেট ফেন্সিং বা ঘেরা দেওয়া। সড়কের গুরুত্বপূর্ণ বাজার ও স্থানে নির্মিত হবে ওভারপাস কিংবা আন্ডারপাস। যাতে মূল সড়কের চলাচল নিরবচ্ছিন্ন থাকে। আর কম গতির গাড়ির জন্য মূল লেনের বাইরে দুই পাশে থাকবে দুটি সার্ভিস লেন। নির্ধারিত স্থান থেকে গাড়ি মূল সড়কে ওঠার সুযোগ থাকবে। দুর্ঘটনা বা বিপদের সময় বের হওয়ার জন্য দুপাশে দুটি জরুরি এক্সিট লেন বা বের হওয়ার পথ রাখা হবে। অর্থাৎ সর্বশেষ প্রযুক্তি নিয়ে এই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মিত হবে। গতি হবে ঘণ্টায় একশ কিলোমিটার।
প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, প্রাইভেট-পাবলিক পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রকল্পের আওতায় জিটুজি (সরকারের সঙ্গে সরকারের) ভিত্তিতে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হবে। প্রাথমিকভাবে জাপানের বিখ্যাত প্রতিষ্ঠান মারুবেনি কর্পোরেশনকে নির্মাণ কাজ দেওয়ার লক্ষ্য নিয়ে এগোচ্ছে সরকার। সেটি চূড়ান্ত হতে কত সময় লাগবে তা এখনো নিশ্চিত হওয়া না গেলেও ফিজিবিলিটি স্টাডির প্রতিবেদন পরবর্তী সরকারের পরিকল্পনার ওপর নির্ভর করছে কবে নাগাদ নতুন পরিকল্পনায় এই সড়ক নির্মাণ হচ্ছে।
প্রকল্পের পিপিপি কর্তৃপক্ষের পরিচালক (প্রশাসন) মোহাম্মদ আনোয়ার হোসাইন ইতোপূর্বে বলেছিলেন, চার লেন প্রকল্পের স্টাডি রিপোর্টের ওপর নতুন কিছু ফিচার যুক্ত করেই এক্সপ্রেসওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা ছিল। এজন্য বুয়েট বিশেষজ্ঞদের দিয়ে ফিজিবিলিটি স্টাডি করতে গত বছরের জুলাই মাসে চুক্তি হয়। বুয়েট বিশেষজ্ঞরা প্রকল্পের ডিজাইন ও অর্থায়ন চূড়ান্ত করে রিপোর্ট দেবে। এরপর প্রকল্প প্রস্তাবনা চূড়ান্ত করে অনুমোদনের জন্য কেবিনেট কমিটি অব ইকোনমিতে পাঠাবেন। কমিটির সভাপতি অর্থমন্ত্রী অনুমোদন দিলে কাজটি শুরুর জন্য চুক্তি হওয়ার কথা ছিল। তবে ফিজিবিলিটি স্টাডির বর্তমান কী অবস্থা তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
তিনি বলেন, জাপান সরকার এই প্রকল্পে প্রাথমিকভাবে মারুবেনি কর্পোরেশনের নাম প্রস্তাব করেছে। তবে সেটি চূড়ান্ত হবে ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট দেওয়ার পর। আর সরকার প্রকল্প বিনিয়োগ করবে কিনা তা-ও চূড়ান্ত হবে রিপোর্ট পাওয়ার পর। তাই এখনই বলা যাচ্ছে না কবে এক্সপ্রেসওয়ের কাজ শুরু হবে।
বর্তমানে মহাসড়কের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত দুই লেনের সড়ক। দোহাজারী থেকে চন্দনাইশ পর্যন্ত দেড় থেকে দুই লেনের সড়ক। পটিয়া থেকে শিকলবাহা ক্রসিং পর্যন্ত দেড় লেনের সড়কটি সবচেয়ে খারাপ, আঁকাবাঁকা ও ঝুঁকিপূর্ণ।
এদিকে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন এজেন্সি (জাইকা) কক্সবাজারের মাতারবাড়িতে গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করছে। বন্দর চালুর আগেই তারা চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ক গতিশীল করতে চায়। সড়কটি চার, ছয় কিংবা আট লেনে নির্মিত হওয়ার আগেই পাঁচটি সেতু নির্মিত হচ্ছে, যেগুলো ছয় লেনের। এসব সেতু ঘিরে যাতে কোনো যানজট না হয় সেজন্য আগেভাগে অন্তত পাঁচটি গুরুত্বপূর্ণ ও যানজটপ্রবণ স্থানে মাটির উপরে ওভারপাস, মাটির নিচে আন্ডারপাস নির্মাণ করবে জাইকা।
জাইকার এক কর্মকর্তা আজাদীকে বলেন, পাঁচটি স্থানে যান চলাচল নির্বিঘ্ন করতে আগেভাগে ওভারপাস-আন্ডারপাস নির্মাণের জন্য জাইকার অর্থায়নে ফিজিবিলিটি স্টাডি হচ্ছে। জাইকার ফান্ড থেকেই সেটি বাস্তবায়িত হবে। মাতারবাড়ি সমুদ্রবন্দর চালুর আগেই এটি নির্মাণ করতে চাই। এজন্য আমরা এক মুহূর্তের জন্যও পিছিয়ে থাকতে চাই না।
এ প্রসঙ্গে কক্সবাজার-১ আসনের সংসদ সদস্য জাফর আলম আজাদীকে বলেন, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছিলেন এই মহাসড়ক চার লেনে রূপান্তর করতে। বর্তমানে কক্সবাজার ঘিরে মেগা উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব মেগা প্রকল্পের সুফল পেতে সরকার সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের পরিকল্পনা নিয়ে এগোচ্ছে। তাই আগামী ৫০ বছরে কক্সবাজারের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড কোন পর্যায়ে উন্নীত হবে সেই ভাবনা মাথায় রেখেই মহাসড়কটি নিয়ে নতুন করছে ভাবা হচ্ছে। তিনি বলেন, বুয়েট বিশেষজ্ঞদের ফিজিবিলিটি স্টাডি রিপোর্ট না পাওয়ার আগে এই মুহূর্তে নিশ্চিত করে বলা যাবে না সড়কটি ছয় লেন নাকি আট লেনের হবে।
সড়কটির প্রকল্প পরিচালক (ফোকাল পয়েন্ট) শ্যামল ভট্টাচার্য গতকাল বিকালে আজাদীকে বলেন, কক্সবাজার ঘিরে মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্রকল্পের কারণে ভবিষৎ চিন্তা করে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার মহাসড়ককে চার লেন রূপান্তন করা থেকে সরে এসেছে সরকার। তিনি বলেন, সড়কটি ছয় লেন বা আট লেনে রূপান্তর করতে বর্তমানে বুয়েট বিশেষজ্ঞদের মাধ্যমে ফিজিবিলিটি স্টাডি চলমান রয়েছে। মহাসড়কের পাঁচটি পয়েন্ট পটিয়া, দোহাজারী, কেরানীহাট, লোহাগাড়া ও চকরিয়ায় জোর দেওয়া হচ্ছে। এসব পয়েন্টে যানজট হয় এবং বাজার রয়েছে। এসব পয়েন্টে প্রয়োজন অনুপাতে আন্ডারপাস-ওভারপাস নির্মাণ করা হবে। তাই কবে নাগাদ নতুন করে সড়কটির নির্মাণ কাজ শুরু হবে তা এই মুহূর্তে বলার সময় আসেনি।