ঈদকে ঘিরে চোরাই পণ্য আমদানির ব্যবসা জমে উঠেছে চট্টগ্রাম জুড়ে। মাঝেমধ্যে র্যাব পুলিশের অভিযানে দুই একটি চালান ধরা পড়লেও মূল হোতাদের গ্রেপ্তারে বরাবরই ব্যর্থ আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো।
অভিযোগ রয়েছে, অনেক সময় চোরাকারবারিরাই উদ্যোগী হয়ে একটা দুইটা চালান ধরিয়ে দেয়। আর তার ফাঁক গলে চলে আসছে বড় চালানগুলো। ট্রেনে, বাসে, ইঞ্জিনচালিত নৌকায়, ট্রাকে, সিএনজি টেক্সিযোগে, প্রাইভেট কার অথবা মাইক্রোবাসে করে নগরী হয়ে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাচার হচ্ছে এসব কাপড়। বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি), র্যাব, পুলিশ, কাস্টমস, কোস্টগার্ড, নৌবাহিনী, রেলওয়েসহ অন্যান্য বিভাগকে চোরাচালান বিরোধী অভিযান আরো জোরদারের নির্দেশ দিয়েছেন আঞ্চলিক টাস্কফোর্সের আহ্বায়ক চট্টগ্রাম বিভাগীয় কমিশনার মো. তোফায়েল ইসলাম।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, অপরাধীদের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান রয়েছে। সব কিছু মাথায় রেখে র্যাব নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা নজরদারি বৃদ্ধি করেছে। র্যাবের সাইবার মনিটরিং টিম সার্বক্ষণিক অনলাইনে নজরদারি করছে। প্রতি বছর ঈদ ও পূজাকে টার্গেট করে অবৈধ পথে শুল্ক না দিয়ে শত শত কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়। এবারো তার ব্যতিক্রম নয়। নগরীর প্রতিটি ছোট–বড় শপিংমল, মার্কেট, বিপণি বিতান এখন ভারতীয় পণ্যের দখলে। লাখ টাকা দামের শাড়ি, লেহেঙ্গা, থ্রিপিস থেকে শুরু করে সব বয়সীদের শার্ট, প্যান্ট, পাঞ্জাবি, জুতা, সেন্ডেল প্রকাশ্যে বিক্রি হচ্ছে। বাহারি নামের এসব পোশাকের চাহিদা ও লাভ অনেক বেশি হওয়ায় ব্যবসায়ীরা এসব পণ্য মজুদ ও বিক্রিতে বেশি আগ্রহী।
আমদানিকৃত পোশাকের ৮০ ভাগই ভারতীয় : ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদ উপলক্ষে এ বছর কয়েক হাজার কোটি টাকার পণ্য আমদানি হয়েছে। এর ৮০ ভাগই ভারত থেকে এসেছে। শুল্ক ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অবাধে ঢুকছে ভারতীয় পণ্য। অবৈধ পথে আমদানিকারকদের শুল্ক পরিশোধ করতে হয় না। ভারত–বাংলাদেশের শক্তিশালী একাধিক সিন্ডিকেট এ কাজে জড়িত। রাজনৈতিক প্রভাব থাকায় ভারতীয় পণ্য এ দেশে বাজারজাতকরণে তাদের খুব একটা বেগ পেতে হয় না। পুলিশ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে লাখ লাখ টাকার শাড়ি নিয়ে যাওয়া হচ্ছে চট্টগ্রাম শহরের তামাকুমন্ডি লেইন, রিয়াজ উদ্দিন বাজার, টেরি বাজারসহ বিভিন্ন বিপণী বিতানে। এ কাজে জড়িত রয়েছে একাধিক সিন্ডিকেট।
ছোট চালান ধরতে গিয়ে বড় চালান হাতছাড়া : অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রশাসনের কড়াকড়ি ও কঠোর নজরদারির সময় চোরাচালানিরা নিজেরাই দু’একটি চালান ধরিয়ে দেয়। প্রশাসনের পক্ষ থেকে আটককৃত চালানটি নিয়ে ব্যস্ত থাকার সুযোগে সহজেই বড়ো বড়ো চালানগুলো পৌঁছে যায় নির্দিষ্ট গন্তব্যে। সূত্র মতে ভারতীয় চোরাই শাড়ির সবচেয়ে বড়ো সিন্ডিকেট রিয়াজ উদ্দিন বাজার কেন্দ্রিক। প্রতিবছর ঈদ ও পূজার দুই তিন মাস আগে থেকে সিন্ডিকেটটি প্রশাসন ও থানার পদস্থ কর্মকর্তাদের ম্যানেজ করে কোটি কোটি টাকার ভারতীয় শাড়ি নিয়ে আসছে চট্টগ্রামে। চমকপ্রদ আরেকটি তথ্য হলো তিন ক্যাটাগরিতে ভারতীয় শাড়ি চোরা পথে নগরীতে আসছে। কম মূল্যের শাড়িগুলো ট্রাকে ও বেশি মূল্যের শাড়িগুলো প্রাইভেট কার ও মাইক্রোবাসে।
যে পথে বেশি আসছে : জানা গেছে মীরসরাইয়ের ভারতীয় সীমান্ত দিয়ে চোরা পথে অবাধে আসছে ভারতীয় পণ্য। ৫ কিলোমিটার সীমান্ত এলাকায় কাঁটাতারের বেড়া না থাকায় নির্বিঘ্নে এসব পণ্য নিয়ে আসছে চোরাকারবারিরা। শাড়ি, কাপড়, থ্রি–পিস, বিভিন্ন প্রসাধনী সহ নানা পণ্য। নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, ফটিকছড়ি, হেঁয়াকো, মীরসরাইয়ের করেরহাট, বারইয়াহাট এবং ভারতের দক্ষিণ ত্রিপুরার সাব্রুমের একাধিক চোরাকারবারি সিন্ডিকেট দীর্ঘ দিন ধরে সীমান্ত দিয়ে ভারতীয় পণ্য পাচার করছে। এ ছাড়া বনভূমি বেষ্টিত হওয়ায় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর তৎপরতাও কিছুটা সীমিত। ফলে চোরাকারবারি সিন্ডিকেট অরক্ষিত ওই সীমান্ত এলাকাকে নিরাপদ রুট হিসেবে বেছে নিয়েছে। মীরসরাইয়ের করেরহাট এলাকায় পণ্য ঢোকার পর ঢাকা–চট্টগ্রাম মহাসড়ক দিয়ে তা সিন্ডিকেটের মাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
কুমিল্লা জেলার ৫টি উপজেলার সীমান্তের অর্ধশতাধিক পয়েন্ট দিয়ে অবাধে দেশে আসছে ভারতীয় পণ্য সামগ্রী। জানা যায়, এ জেলার আদর্শ সদর, বুড়িচং, ব্রাহ্মণপাড়া, সদর দক্ষিণ ও চৌদ্দগ্রাম উপজেলায় ১২৫ কি.মি. এলাকাজুড়ে ভারত সীমান্ত। কাঁটাতারের বেড়া থাকলেও চোরাকারবারিরা বিকল্প রাস্তা তৈরি করেছে। এসব এলাকা দিয়ে প্রতিদিনই অবাধে আসছে ভারতীয় ঈদ পণ্য।
ফেনীর ৩৮ কিলোমিটার সীমান্তজুড়ে চোরাকারবারিরা সক্রিয়। প্রতিদিন এ সীমান্ত পথ দিয়ে ভারতীয় শাড়ি ও থ্রি–পিসসহ বিভিন্ন কাপড়ের চালান আসছে। ফেনীর ছাগলনাইয়া সীমান্তহাটে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা দেদার বিক্রি করছে সে দেশে তৈরি শাড়ি, থ্রি–পিসসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী। এছাড়া রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, নওগাঁ, জয়পুরহাটসহ উত্তরাঞ্চলের সীমান্ত পথে আসছে ভারতীয় ফেব্রিঙ, শাড়ি, বাচ্চাদের জামা–কাপড়, ধুতি, পাঞ্জাবির কাপড়, গেঞ্জি, শার্ট ইত্যাদি। প্রায় দু’শ কিলোমিটার জুড়ে কাঁটাতার বেষ্টিত সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাট। এ কাঁটাতার গলিয়েই দেদারসে আসছে ভারতীয় কাপড়।
ঈদ উপলক্ষে বাকিতেও পণ্য সরবরাহ! : জানা গেছে, বছরজুড়েই চোরাই পথে দেশে ঢোকে প্রায় শতাধিক ভারতীয় পণ্য। এর মধ্যে রয়েছে– পোশাক, মোটরসাইকেল, বাইসাইকেল, যন্ত্রাংশ, ইলেকট্রনিঙ, বিভিন্ন মশলা জাতীয় পণ্য, শিশুখাদ্য, শুঁটকি, চিনি, মাদকদ্রব্য, অস্ত্র ইত্যাদি। তবে ঈদকে সামনে রেখে ভারতীয় কাপড় (ফেব্রিঙ), শাড়ি, থ্রি–পিস, লেহেঙ্গা, ওড়না, শাল, পাঞ্জাবি, শার্ট, জুতা, সেন্ডেল ও বিভিন্ন কসমেটিকসের চোরাচালান এখন তুঙ্গে। কলকাতার বিভিন্ন মার্কেট চোরাচালানিদের শক্ত ঘাঁটি। ওই ঘাঁটি থেকে কয়েকটি সিন্ডিকেট এসব পণ্য পাচার নিয়ন্ত্রণ করে। সিন্ডিকেট আছে সীমান্তের এপারেও। তারা চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহরের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্ডার নিয়ে পণ্য সরবরাহ করে। ঈদ উপলক্ষে চোরাচালানি সিন্ডিকেট বাকিতেও পণ্য সরবরাহ করছে। ভারতীয় মহাজনরাও বাকিতে কোটি কোটি টাকার শাড়ি, থ্রি–পিস সরবরাহ করছে। এ ছাড়া লাগেজ ব্যবসায়ীরাও এসব পণ্য নিয়ে আসছে নির্বিঘ্নে। দেশের যে কোনো স্থানে তারা নিজ দায়িত্বে মালামাল পৌঁছে দিচ্ছে। এসব কারণে বৈধ পথে পণ্য আসা কমে গেছে।
নিরাপদে পারাপারের জন্য পথে থাকে নির্দিষ্ট লোক : নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একাধিক ব্যক্তি জানান, সীমান্তের জিরো পয়েন্ট পার হওয়ার পরই অপেক্ষমাণ দেশীয় ট্রাক, ভ্যান, বাইসাইকেলসহ নানা রকমের যানবাহনে পণ্য তুলে দেয়া হয়। নিরাপদে পারাপারের জন্য পথে থাকে সিন্ডিকেট সদস্যরা। জানা গেছে, একটি ট্রাকে ৯০ বেল শাড়ি, থ্রি–পিস থাকে। ৯০ বেল কাপড়ের দাম এক কোটি টাকা। আর এ পণ্যের আমদানি শুল্ক ৩০ থেকে ৪০ লাখ টাকা। কলকাতা থেকে বৈধভাবে ওই পণ্য আমদানি করতে কাস্টমস খরচ, বন্দর চার্জ, ট্রাক ভাড়া, সিএন্ডএফ কমিশন ইত্যাদি দিয়ে প্রায় দ্বিগুণ মূল্য পড়ে। তা ছাড়া সময়ও লাগে এক মাসের মতো।
জানা গেছে, পাচারকারী সিন্ডিকেট মাত্র কয়েক লাখ টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন পণ্য কলকাতা থেকে বাংলাদেশের যে কোনো স্থানে পৌঁছে দিচ্ছে মাত্র তিন থেকে চার দিনে। গুদাম ঘরে পণ্য পৌঁছে দেয়ার পর টাকা পরিশোধ করা হচ্ছে। এছাড়া লাগেজ পার্টি প্রতিদিন বিপুল পরিমাণ পোশাক আনছে। একজন ব্যাগেজ পার্টির সদস্য জানান, ভারতে গিয়ে একজন যাত্রী কয়েক লাখ টাকার মালামাল নিয়ে আসতে পারে। শুধু দুই পারের শুল্ক বিভাগ ও সীমান্তরক্ষীদের একটু ম্যানেজ করলেই কোনো সমস্যা হয় না।
মূল্য পরিশোধ যেভাবে : সূত্র মতে হুন্ডি অথবা অনলাইন ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে মূল্য পরিশোধ করা হয়। ভারতের কিছু এলাকায় বাংলাদেশের মোবাইল নেটওয়ার্ক থাকায় চোরাকারবারিদের বিশেষ সিগন্যাল দেয়া হয় মোবাইলেই। স্থানীয় সিন্ডিকেটের সহায়তায় মালামাল লোড–আনলোড করার পর তা কাভার্ডভ্যান, ট্রাক, মাইক্রোবাস, অটোরিকশা, ভ্যান ও রিকশায় কাছের কিংবা দূরের গন্তব্যে পৌঁছে যায়। লোড–আনলোডের কাজে থাকে শিশু থেকে বৃদ্ধরাও। মাঝে মধ্যে বিজিবি, পুলিশ, র্যাব ও মাদক দ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদফতর অভিযান চালিয়ে কিছু মালামাল আটক করে। কিন্তু অধিকাংশ অভিযানেই মূল হোতা আটক হয় না।