‘ধাঁধার বই আছে?’ শিশুপ্রকাশ এর স্টলে এসে প্রশ্ন করে ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্রী মুনতাহা। উত্তরে বিক্রয়কর্মী ‘না’ বলতেই মন খারাপ করে সে। চেহেরায় যার ছাপ স্পষ্ট। এবার ভূতের গল্পের বই আছে কীনা জানতে চায় মুনতাহা। তখন ইমদাদুল হক মিলনের ‘অনেকগুলোর ভূতের গল্প’ এবং জসীম আল ফাহিমের ‘ভূচং ও চূচং’ বই দুটি বের করে দেয় শিশুপ্রকাশ এর স্বত্বাধিকারী আরিফ রায়হান। এবার মুখে হাসি এনে মুনতাহা বলে, ‘আর নাই’?
গতকাল শুক্রবার সন্ধ্যায় এ দৃশ্য দেখা গেছে নগরের এম এ আজিজ স্টেডিয়াম সংলগ্ন জিমনেশিয়াম মাঠে, বইমেলায়। মুনতাহার বাবা শওকাত হোসাইন দৈনিক আজাদীকে বলেন, আমরা স্বামী–স্ত্রী দুজনই চাকরিজীবী। পুরো সপ্তাহে অফিসের কাজে ব্যস্ত থাকি। তাই চেষ্টা করি ছুটির দিনে একমাত্র মেয়েকে সময় দিতে। প্রায় সময় বিভিন্ন বিনোদন কেন্দ্রে নিয়ে যাই। কিন্তু বইমেলা শুরু হওয়ার পর থেকে এখানেই এসেছি। অন্য কোথাও যাইনি। মুনাতাহাকে তার পছন্দের বইগুলো কিনে দিয়েছি। তার পছন্দ ভূত ও রূপকথার গল্প। এর মধ্যেও শিক্ষণীয় গল্পের বই কিনে দেয়ার চেষ্টা করেছি।
মুনতাহার মত সায়মা, ঈশিকা, নওশীন, আরশি, সিনান, আরওয়া, আব্রাহামও মেলায় এসছে পছন্দের বই কিনতে। এদের কারো পছন্দ গল্প, কারো ছড়া, কারো বা কমিকস। বিজ্ঞান ও গণিতের বইও আছে কারো কারো পছন্দের তালিকায়। এদের অবিভাবকের সঙ্গে আলাপাকালে তারা জানিয়েছেন, শুক্রবার ছেলে–মেয়েদের স্কুল বন্ধ থাকে। তারাও (অবিভাবক) ফ্রি থাকেন। তাই বইমেলায় নিয়ে আসেন সন্তানদের। প্রযুুক্তির যুগে ছেলে–মেয়েকে বইমুখী করতেই চেষ্টা করছেন তারা।
আড়াই বছরের আফরিনের জন্য বর্ণমালার দুটি বই কিনেছেন পারভেজ আলম। তিনি বলেন, মেয়ে একটু একটু কথা বলতে পারে। বর্ণমালার বই হলেও সেখানে পশু–পাখি এবং ফলমূলের রঙিন ছবি আছে। এসব ছবির সঙ্গে এবং বর্ণমালার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিতেই বইটি কিনেছি। ছবি দেখতে দেখতেই হয়তো একদিন বইকে ভালোবাসবে আফরিন। এমনটাই বিশ্বাস পারভেজের।
মেলা ঘুরে দেখা গেছে, ওমর কায়সারের ‘গল্পে শেখো বাংলা ভাষা’, জাহেদ মোতালেবের ‘রামানুষ’, শিবুকান্তি দাশের ‘মিলিটারি এলো গ্রামে’ এবং বিভা ইন্দুর ‘ছুটির দিনে বনবাদাড়ে’সহ বেশ কিছু বই বিক্রির তালিকায় এগিয়ে আছে।
এর মধ্যে ওমর কায়সারের ‘গল্পে শেখো বাংলা ভাষা’ বাংলা ভাষার কলাকৌশল নিয়ে লেখা চমৎকার একটি বই। এ যেন ভাষা শেখার আনন্দপাঠ। ছোট ছোট গল্প পাঠের আনন্দের ভেতর দিয়ে ছোটরা বাংলা ভাষার মজার অনেক কিছু জানবে। ‘গল্পে শেখো বাংলা ভাষা’ পাওয়া যাচ্ছে ‘প্রথমা’র স্টলে।
ছোটদের জন্য আরেক চমৎকার বই জাহেদ মোতালেবের ‘রামানুষ’। আচ্ছা, কোনো রাক্ষস কি মানুষ হয়ে যেতে পারে? কীভাবে? এর উত্তর মিলবে ‘রামানুষ’ এ। বইটি পাওয়া যাচ্ছে ঝিলমিলের স্টলে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছে অনেক কিশোরও। এদের একজন ভোলা। তার চোখের সামনেই পাকিস্তানি মিলিটারি গুলি করে মেরেছে তার মা–বাবাকে। সুযোগ পেয়ে ভোলা দুই জিপ গাড়ির এক ডজন মিলিটারির প্রাণবায়ু উড়িয়ে দেয়। তার সঙ্গে ছিল একদল বিচ্ছুবাহিনী। কিভাবে ভোলা মিলিটারির উপর আক্রমণ করল? সে গল্প জানা যাবে শিবুকান্তি দাশের ‘মিলিটারি এলো গ্রামে’ পড়ে। বইটি পাওয়া যাচ্ছে শিশুপ্রকাশ এর স্টলে।
ছুটির দিনে বনবাদাড়ে কি করেছিল নিতু, রাহাত ও শীলা? নিতুর চুলের বেণীতে হেঁচকা টান দিয়েছে কে? শুকনো দুধ পাউডার গলায় আটকে মীমের কি দশা হয়েছিল? এসব জানা যাবে বিভা ইন্দুর ‘ছুটির দিনে বনবাদাড়ে’ এ। বইটি পাওয়া যাচ্ছে শৈলীর স্টলে।
শিশুতোষ আরো কিছু বই : শিশুদের পছন্দের তালিকায় থাকা আরো কিছু গ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– কামরুল হাসান বাদলের ‘কাকবন্ধু ও লকডাউন’, জাহেদ মোতালেবের ‘তোমায় বড় ভালোবাসি’, শুকলাল দাশের ‘আনন্দপুরের দিন’ ও ‘তুহিনের স্বাধীন দেশ’, রুনা তাসমিনার ‘নাম ছিলো তার রাসেল’, সুমন্ত আসলামের ‘রূপংকর ভয়ংকর’, হাসান হাফিজের ‘মন মাতানো রূপকথা’, মঈনুস সুলতানের ‘নানাদেশের হানাবাড়ি ও রহস্যময় ঘোড়ারগাড়ি’, জসীম ওমরের ‘আমার পড়া পাখির ছড়া, হিমেল বরকতের ‘পেনসিল ও রাবারের গল্প’, মোহাম্মদ জোবায়েরের ‘আমাদের ফুলবাগানে’, সুব্রত কুমার নাথের ‘যতীন স্যার’, আকতার হোসাইনের ‘ইহানের জন্য ছড়া’, আ ফ ম মোদাচ্ছের আলীর ‘জয় বাংলা’, জসিম উদ্দিন খানের ‘মন রাঙাবো নতুন করে’, মাইনুল এইচ সিরাজীর ‘বাসার স্যারের বাকি রহস্য’, কাশেম আলী রানার ‘অমুক ভাই তমুক ভাই’, আনোয়ারুল হক নুরীর ‘হাসিখুশির জোনাক জ্বলে’, তহুরীন সবুর ডালিয়ার ‘ছড়ার সাথে পড়ার সাথে’, চন্দ্রশিলা ছন্দার ‘তিতলির ভালো কাজ’, লিটন কুমার চৌধুরীর ‘রঙ মাখানো স্বপ্ন বুনি’, কাসেম আলী রানার ‘আরুল পারুল জারুল ফুল’, শান্তময় দাশের ‘স্বপ্নের মতো দেশ’, সৈয়দা সেলিমা আক্তারের ‘মনের সাথে যাই হারিয়ে’, নান্টু বিকাশ বড়ুয়ার ‘পায়রা ডাকে বাকুম বাকুম’, সনজেত দের ‘পঙ্খিরাজের ডানায় চড়ে’, কল্যাণ বড়ুয়ার ‘মেঘ রোদ্দূর বাজায় নূপুর’, আজিজ রাহমানের ‘রাঙা আলো রঙ ছড়ালো’, ইমদাদুল হক মিলনের ‘অনেকগুলো ভূতের গল্প’, নাসের রহমানের ‘আকাশে রঙিন ঘুড়ি’, সনজীব বড়ুয়ার ‘পাহাড় নদী বন পেরিয়ে’, মাহফুজুর রহমানের ‘গল্পে পড়ে শিখি’, মাহবুব এ রহমানের ‘ভূত স্যার যখন বিজ্ঞান ক্লাসে’, আখতারুল ইসলামের ‘গণিতের ধাঁধা’ ও ‘আলোকধারা সূর্য তারা’, কেশব জিপসীর ‘বাঙালির ধ্রুবতারা’, শামীম খান যুবরাজের ‘ফুল পাখিদের বন্ধু আমি’ ও ‘আমি দূরন্ত এক ছেলে’, লুৎফর রহমান রিটনের ‘ফেল্টুস? চড় খাবি!’ ও ‘দাবায়া রাখতে পারবা না’, আমীরুল ইসলামের ‘রাসেল আমার ভাই’, রণজিৎ সরকারের ‘পরির সাথে দেশ ঘুড়ি’, আবেদীন জনির ‘কে কতটা হাসতে পারো’, জাহাঙ্গীর আলম জাহানের ‘ঘড়া ভরা কড়া ছড়া’, ইলিয়াস হোসেনের ‘নীলপরী’, আবুল হোসেন আজাদের ‘সব হতে পারি আমি’, শিক্ষামূলক গল্প ‘দিঘির জলে বিশাল দৈত্য’, অরুণ বর্মনের ‘ছোটদের জন্য বঙ্গবন্ধুর জীবন ও দর্শন’ উপল মাহবুবের ‘প্রমিতির শাথায় কুমিরের ছানা’, তানজিনা আক্তারের ‘কাঠুরে রাজপুত্র’, আনিসুল হকের ‘আমাদের সাথে একটা ভূত পড়ত’, সৈয়দ নজমুল আবদালের ‘আমাদের বন্ধু গাছ’, সজীব সেনের ‘বাবার পোষা ড্রাগন’, অমিত কুমার কুণ্ডুর ‘ভূতবাংলো রহস্য’, এবং মাসুদ রানা আসিকের ‘বাঘের ঘাড়ে ভর করেছে ভূত’।
বইমেলা মঞ্চে রবীন্দ্র উৎসব : গতকাল বইমেলা মঞ্চের আয়োজন ছিল ‘রবীন্দ্র উৎসব’। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এ টি এম পিয়ারুল ইসলাম। তিনি বলেন, রবীন্দ্রনাথের গান, কবিতা, সাহিত্য, উপন্যাস ও ছোট গল্পে মানবিক বোধের বিষয়টি উঠে এসেছে। আমাদের তাঁর গানের চর্চার পাশাপাশি মানবিক বোধের চর্চা চালিয়ে যেতে হবে।
সাংবাদিক নাজিমুদ্দীন শ্যামলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে প্রধান বক্তা ছিলেন অধ্যক্ষ রীতা দত্ত ও আলোচক ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের অধ্যাপক ড. সুকান্ত ভট্টাচার্য। স্বাগত বক্তব্য দেন, বই মেলা কমিটির আহ্বায়ক কাউন্সিলর ড. নিছার উদ্দিন আহমেদ মঞ্জু। উপস্থিত ছিলেন চসিক প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম ও শিশুসাহিত্যিক শুকলাল দাশ।