নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইন্সে মেট্রোপলিটন শুটিং ক্লাবে অনুষ্ঠিত ছিন্নমূল শিশু ও কিশোর অপরাধ প্রতিরোধ ও প্রতিকার বিষয়ক দিনব্যাপী সেমিনারে সভাপতির বক্তব্যে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার হাসিব আজিজ বলেছেন, ছিন্নমূল শিশু–কিশোরদের সম্ভাব্য অপরাধী না ভেবে কীভাবে সমাজের মূল স্রোতধারার সাথে তাদের সম্পৃক্ত করা যায় তা নিয়ে সমাজ সেবা অধিদপ্তর, এনজিও ও পুলিশ অফিসারসহ সংশ্লিষ্টদের কাজ করতে হবে।
গত বুধবার আয়োজিত সেমিনারে বক্তারা ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসন ও কিশোর অপরাধ দমনে তাদের মূল্যবান মতামত প্রদান করেন। যা ছিন্নমূল শিশু–কিশোরদের অপরাধ প্রতিরোধে সহায়ক। শিশু কেন ছিন্নমূল হয় এমন প্রশ্ন রেখে বক্তারা বলেন, দেখা যাচ্ছে, শিশুরা পথে পথে বেড়ে উঠছে। মূলত দারিদ্র, মা–বাবার বিচ্ছেদ, বিবাহপূর্ব সন্তানের জন্ম, অকালে মা–বাবার মৃত্যু, মা–বাবার অসচেতনতার কারণেই এমন অবস্থা। মাদক কারবারিরাও এর পেছনে রয়েছে। দেখা যায়, ছিন্নমূল শিশু–কিশোরেরা মাদক সেবন করছেন। সেই মাদক থেকে তারা নানা অপরাধে লিপ্ত হচ্ছেন। বক্তারা বলেন, ছিন্নমূল শিশু–কিশোররাও এদেশের মানুষ। তাদের প্রতি আমাদের দৃষ্টি দিতে হবে। তাদের কথা ভাবতে হবে। তারা যাতে মাদক গ্রহণ না করে, তারা যাতে অপরাধে জড়িয়ে না পড়ে সে বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে।
বক্তারা আরো বলেন, আমাদের একজনের সাথে একজনের বন্ধন বাড়াতে হবে। স্বামীর সাথে স্ত্রীর, বাবার সাথে ছেলে–মেয়ের, মায়ের সাথে ছেলে মেয়ের বন্ধন থাকতে হবে। একজনের প্রতি আরেকজনের যত্ন নিতে হবে, খোঁজ রাখতে হবে। জন্মের পর সন্তানকে সাথে রাখতে হবে। বাবা–মা না থাকলে স্বজনদের এ দায়িত্ব নিতে হবে। সর্বোপরি রাষ্ট্রেরও দায়িত্ব রয়েছে। যারা ছিন্নমূল শিশু–কিশোর রয়েছে তাদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে রাষ্ট্র। যেখানে তারা ছিন্নমূল জীবন পরিত্যাগ করে স্বাভাবিক শিশু–কিশোরদের মতো সমাজে বেড়ে উঠবে। সেমিনারে বক্তব্য রাখেন ইউনিসেফ চট্টগ্রাম বিভাগীয় প্রধান মাধুরী ব্যানার্জী। শিশু–কিশোরদের পরিবার ও সমাজ থেকে বিছিন্ন করে দেয় এমন কার্যকলাপ থেকে অভিভাবকদের বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। অন্যথায় ছিন্নমূল শিশু–কিশোররা বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়ার আশংকা রয়েছে, সে বিষয়ে হুঁশিয়ার করে দেন মাধুরী ব্যানার্জী।
আসলে দিন দিন অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠছে কিশোর অপরাধীরা। নানা ধরনের অপরাধে কিশোররা জড়িয়ে যাচ্ছে। এই প্রবণতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরাধের পরিধিও বেড়েছে। কিশোরদের অপরাধে জড়ানোর কারণ বেশ কিছু গবেষণা থাকলেও সেগুলোর প্রতি নজর বা তা থেকে প্রতিকারের ব্যবস্থা নেওয়ার আগ্রহ সরকারের বাস্তবায়নকারী সংস্থাগুলোর নেই। আইন ও নীতিমালা থাকলেও তার বাস্তবায়ন হচ্ছে না। পত্রিকান্তরে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে, কিশোরদের মধ্যে পড়াশোনার চাপ ও আগ্রহ দুটিই কমে গেছে। এতে পাড়ায়–মহল্লায় চায়ের দোকানে কিশোরদের আড্ডা বেড়ে গেছে। এ সুযোগকেই কাজে লাগাচ্ছে এলাকাভিত্তিক গ্রুপগুলো। তারা নিজেদের দল ভারী করতে এসব কিশোরকে দলে টানছে। এর মধ্য দিয়েই কিশোররা জড়িয়ে পড়ছে মাদক–ইভটিজিং–ছিনতাইসহ নানা অপরাধে। এলাকায় আধিপত্য বিস্তার করতে জড়িয়ে পড়ছে খুনোখুনিতেও।
বিশেষজ্ঞরা কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধের বিরুদ্ধে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে তরুণ সমাজের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন, ‘আজকাল প্রায়ই বিভিন্ন গণমাধ্যমে কিশোর গ্যাংসহ বিভিন্ন অপরাধের খবর প্রচারিত হয়। এতে অনেকের ভবিষ্যৎ নষ্ট হওয়ার পাশাপাশি সমাজে এর বিরূপ প্রভাব পড়ছে। এ ব্যাপারে তরুণ সমাজকে দৃঢ় পদক্ষেপ নিতে হবে। তরুণদের উৎপাদনশীল কর্মকাণ্ডে ব্যাপকভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে। শুধু নিজে ভালো থাকলে চলবে না, অন্যরাও যাতে ভালো থাকে সে চেষ্টাও করতে হবে। সন্তান যেন লেখাপড়ার পাশাপাশি কোনো অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়াতে না পারে সেদিকে খেয়াল রাখতে মা–বাবা এবং অভিভাবকদের পরামর্শ দেন তাঁরা। বিশেষজ্ঞদের মতে, যেখানে কিশোররাই হবে মানবতার অগ্রদূত, আমাদের দুঃখ, সেখানে তারা হয়ে উঠছে যমদূত। এদের নির্মূলে খুব দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে অদূর ভবিষ্যতে মানুষের মনে সন্ত্রাস, নৈরাজ্য, হত্যা, ধর্ষণ ভীতি বাড়তেই থাকবে।