ভূমিকা: ছন্দ কবিতা ও সঙ্গীতের অবিচ্ছেদ্য অংশ। তা শ্রুতিমধুরতার মাধ্যমে পাঠক–শ্রোতাকে বিশেষ অনুভূতি দান করে। হৃদয় তথা হৃৎপিণ্ডেরও আছে নিজস্ব ছন্দ। হৃৎপিণ্ড লাব্–ডাব্ শব্দে ছন্দে ছন্দে স্পন্দিত হয়। হৃৎপিণ্ডই প্রথম অঙ্গ যা মানব দেহে কাজ শুরু করে। ভ্রুনের উৎপত্তি থেকে আমৃত্যু হৃৎপিণ্ডের এই ছন্দায়িত কাজ অবিরাম চলমান থাকে। হৃদস্পন্দন দিয়ে জীবনের আরম্ভ। আর এই স্পন্দন থেমে যাওয়াতেই জীবনের অবসান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘প্রকৃতি’ কাব্য গ্রন্থের ‘হৃদয়ের গীতধ্বনি’ কবিতায় লিখেছেন, ‘একি সুরে গান গাস হৃদয় আমার? শীত নাই, গ্রীষ্ম নাই, বসন্ত শরৎ নাই, দিন নাই রাত্রি নাই–অবিরাম অনিবার–একি সুরে গান গাস্ হৃদয় আমার?’ এইভাবে তিনি হৃৎস্পন্দনকে গীতধ্বনির সাথে তুলনা করেছেন। দেহ মনের সামগ্রিক সুস্থতার জন্য প্রয়োজন সুস্থ হৃৎযন্ত্র। আর সুস্থ হৃৎযন্ত্রের লক্ষণ হচ্ছে নিয়মিত ও নির্বিঘ্ন হৃৎস্পন্দন বা হার্ট বিট। হৃৎযন্ত্র সুস্থ রাখতে প্রয়োজন তার প্রতিটা স্পন্দনের প্রতি যত্নবান হওয়া। হৃৎস্পন্দন হৃৎযন্ত্রের সামগ্রিক সুস্থতার বহি:প্রকাশ। তা বিবেচনা করে বিশ্ব হার্ট দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য “Don’t miss a beat” (ভাবার্থ: ছন্দে থাকুক আপনার হৃৎস্পন্দন)।
কেন প্রতিটি হৃৎস্পন্দন গুরুত্বপূর্ণ?
হৃৎস্পন্দনই জীবন। হৃৎপিণ্ড তার প্রতিটি স্পন্দনের মাধ্যমে জীবন বা প্রাণের অস্তিত্বকে প্রকাশ করে। প্রতি স্পন্দনের মাধ্যমে দেহের কার্যক্ষমতা বজায় রাখার জন্য প্রয়োজনীয় রক্ত ও অক্সিজেন সরবরাহ হয়। শরীরের সামগ্রিক সুস্থতা ছাড়াও হৃৎস্পন্দন দেহকলার বিপাকজনিত ক্ষতিকারক উপাদান সমূহ শিরার মাধ্যমে বহন করে এনে তা বিশুদ্ধ করতে।
হৃৎস্পন্দনে বিঘ্ন সৃষ্টি হয় যেভাবে:
হৃৎপিণ্ডের ছন্দপতন তথা অ্যারিথমিয়ার প্রধান কারণ হার্ট অ্যাটাক। ছন্দপতন জনিত এই মৃত্যুর কারণেই হার্ট অ্যাটাক বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ। হৃৎপিণ্ড, যা সারা শরীরে রক্ত সরবরাহ করে তার নিজস্ব রক্ত সরবরাহ বন্ধ হয়ে পড়লে যা ঘটে তাই হার্ট অ্যাটাক। হৃদরোগের ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান গুলো দীর্ঘদিন ধরে ক্রিয়াশীল থাকলে হৃৎপিণ্ডের করোনারি রক্তনালীতে সৃষ্টি হয় প্রতিবন্ধকতা। তার উপর রক্ত জমাট বেঁধে রক্ত প্রবাহ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে ঘটে হৃৎপেশীর পচন তথা হার্ট অ্যাটাক। তা এমন এক সময়ে ঘটে যখন আক্রান্ত ব্যক্তি তার উৎপাদনশীলতার শীর্ষে অবস্থান করে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ সমূহে তুলনামূলকভাবে কম বয়সীরা এই প্রাণঘাতি রোগের শিকার হচ্ছে। তা থেকে রেহাই পেতে তা আগে ভাগে শনাক্ত করা ও চিকিৎসাগ্রহণ জরুরি। বিলম্বে বিপদ ঘনীভূত হয়। তীব্র বুক ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, অস্থিরতা, প্রচুর ঘাম, বমি–এসব হার্ট অ্যাটাকের সচরাচর উপসর্গ। সাথে রক্তচাপ কমে যাওয়া, শরীর ফ্যাকাসে হয়ে পড়া ইত্যাদি থাকতে পারে। এ ধরনের লক্ষণ দেখা যাবার ১০ মিনিটের মধ্যে ইসিজি পরীক্ষা করে হার্ট অ্যাটাক শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা ব্যবস্থা গ্রহণ আবশ্যক। সাথে রক্তের ট্রোপোনিন ও অন্যান্য আনুষাঙ্গিক পরীক্ষাও প্রয়োজন। হার্ট অ্যাটাক হঠাৎ ঘটলেও সচরাচর তার কিছু পূর্বাভাস থেকে থাকে। তা সনাক্ত করে হার্ট অ্যাটাক প্রতিরোধ সম্ভব। মাঝে মাঝে বুক ব্যথা কিংবা শ্বাসকষ্ট এ রোগের পূর্বাভাস হিসাবে কাজ করে। হার্ট অ্যাটাকের দ্রুত চিকিৎসা আবশ্যক। অন্যথায় তা ছন্দপতন জনিত হঠাৎ মৃত্যুর কারণ হয়। আক্রান্ত ব্যক্তি জ্ঞান হারিয়ে ফেললে তৎক্ষণাৎ সিপিআর শুরু করতে হবে। দ্রুত রোগীকে নিকটস্থ সিসিইউতে স্থানান্তর জরুরি। সিসিইউতে কার্ডিয়াক মনিটর এর মাধ্যমে ছন্দপতন (অ্যারিথমিয়া) সনাক্ত করে ডিসি শক্ এবং প্রয়োজনীয় জীবন রক্ষাকারী ওষুধ চিকিৎসা আবশ্যক। হার্ট অ্যাটাকের রোগীদের সম্ভাব্য স্বল্পতম সময়ের মধ্যে এনজিওগ্রাফী পরীক্ষা করে বেলুন ফুলিয়ে এবং স্টেন্ট বসিয়ে বন্ধ হয়ে পড়া করোনারী রক্তনালী খুলে দিয়ে রক্ত প্রবাহ পুন:স্থাপিত করাই সবচেয়ে উপযোগী ও আধুনিক ব্যবস্থা। হার্ট অ্যাটাক ছাড়া অন্যান্য হৃদরোগেও হৎস্পন্দন বিঘ্নিত হতে পারে। তা শনাক্ত করে ওষুধ, পেসমেকার এবং ক্ষেত্র বিশেষ অন্যান্য ইলেকট্রনিক ডিভাইসের মাধ্যমে তা সারিয়ে তোলা সম্ভব। তবে এক্ষেত্রে সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা হলো হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য হৃদরোগের প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে হৃৎস্পন্দন সুচারু রাখা।
এক্ষেত্রে নিম্নবর্ণিত ১০ (দশ) টা টিপস্ মেনে চলুন:
১. কর্মমুখর থাকুন– এতে হৃদরোগের ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানগুলো নিয়ন্ত্রণে থাকে। ২. খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনুন–কম চর্বি, কম শর্করা ও ট্রান্সফ্যাট বিহীন খাবার গ্রহণ করুন। ৩. খাবারে লবণ সীমিত করুন–এতে উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে থাকে। ৪. ধূমপান ও তামাকদ্রব্য বর্জন করুন। ৫. রক্তের কোলেষ্টেরলের মাত্রা জেনে নিন। তা নিয়ন্ত্রণে রাখুন। ৬. শরীরের ওজন প্রত্যাশিত সীমায় বজায় রাখুন। ৭. নিয়মিত রক্তচাপ মাপুন। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করুন। ৮. রক্তের গ্লুকোজ মেপে দেখুন। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখুন । ৯. মানসিক চাপ কমান। মেডিটেশন অভ্যাস করুন। ১০. নিয়মিত চেকআপ করুন–আপাত সুস্থ প্রাপ্তবয়সীরা বছরে একবার আর হৃদরোগগ্রস্তরা চিকিৎসকের পরামর্শ সাপেক্ষে।
হৃৎস্পন্দনের যত্নে চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন:
চট্টগ্রাম অঞ্চলে হৃদরোগের প্রকোপ বেশি বলে প্রতীয়মান। হৃদরোগ চিকিৎসা ব্যয়বহুল। তবে তার প্রাথমিক প্রতিরোধ ব্যবস্থা কার্যকর বলে প্রমাণিত। ২০২২ সালে চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা থেকে তা হৃদরোগ প্রতিরোধের বিভিন্ন জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করে আসছে। পাশাপাশি হৃদরোগের ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান নিয়ন্ত্রণসহ হৃদরোগে আক্রান্তদের স্বল্পব্যয়ে চিকিৎসা ও পরীক্ষায় এই প্রতিষ্ঠান হৃদরোগের বহি:বিভাগ সেবা ও ল্যাবরেটরী সেবা প্রদান করে আসছে। ইতিমধ্যে প্রায় ৩ হাজার জন হৃদরোগী এ সেবা গ্রহণ করেছেন। চট্টগ্রাম নগরী এবং পটিয়া ও সাতকানিয়া উপজেলায় এ পর্যন্ত ১০টা ফ্রি হৃদরোগ চিকিৎসা ক্যাম্প সম্পন্ন করা হয়েছে। বিশ্ব হার্ট দিবস, বিশ্ব উচ্চ রক্তচাপ দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে এই প্রতিষ্ঠান ফ্রি হার্ট ক্যাম্প ও জনসচেতনতামূলক কর্মসূচি গ্রহণ করে আসছে। চলমান এই সেবাসমূহের পাশাপাশি হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য জরুরি হৃদরোগ চিকিৎসা সেবা স্বল্পব্যয়ে প্রদানের নিমিত্তে গত ১৯ জুলাই ২০২৫ইং এখানে চালু হয়েছে চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন হাসপাতাল এন্ড রিসার্চ ইনস্টিটিউট এবং ২৪ ঘণ্টার সার্বক্ষণিক সিসিইউ। চলমান হৃদরোগ প্রতিকার ও প্রতিরোধ কর্মসূচির পাশাপাশি এই প্রতিষ্ঠান তার প্রতিশ্রুত হৃদরোগের গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে ‘হৃদরোগ সৃষ্টিতে চট্টগ্রাম অঞ্চলের খাদ্যাভ্যাস’ শীর্ষক গবেষণা কর্ম গত ফেব্রুয়ারি ২০২৫ইং মিশরের রাজধানী কাইরোতে অনুষ্ঠিত ৫১তম ইজিপশিয়ান কার্ডিওলজি কংগ্রেসে উপস্থাপিত হয়েছে। তা বর্তমানে বাংলাদেশ মেডিকেল রিসার্চ কাউন্সিল জার্নালে প্রকাশের জন্য গৃহীত হয়েছে।
প্রতি বছরের মতো এবারও ২৯ সেপ্টেম্বর সারাবিশ্বে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশনের উদ্যোগে পালিত হচ্ছে বিশ্ব হার্ট দিবস। এই দিবসের প্রতিপাদ্যের সাথে সঙ্গতি রেখে চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন “প্রতিটি হৃৎস্পন্দনই জীবন, তার যত্ন নিন” শিরোনামে এক জনসচেতনতা সৃষ্টিমূলক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। জনসাধারণের হৃৎ–স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ যেমন হৃদরোগ আগে ভাগে শনাক্তে জনসাধারণকে সচেতন করা, হৃদরোগের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ উপাদান চিহ্নিত করা, জীবন যাত্রা ও খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন সাধন ও তা মেনে চলতে জনসাধারণকে উদ্বুদ্ধ করা, জনসাধারণের ক্ষমতায়নে তাদের তথ্য সমৃদ্ধ করা, সামাজিক সহায়তা বৃদ্ধিতে হৃদরোগী ও তাদের পরিবার পরিজনকে সহায়তা, আর্থিকভাবে অসচ্ছল রোগীদের ওষুধ ও বিনামূল্যে চিকিৎসা প্রদান, তাদের উৎপাদনশীল জীবন যাপনে সহায়তা প্রদান ইত্যাদি এই কর্মসূচির অন্তর্ভুক্ত। হৃদরোগের বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ উপাদানের গোড়াপত্তন শৈশব ও কৈশোরে। বাংলাদেশে কম বয়সীদের মধ্যে হৃদরোগ উচ্চহারে দেখা দিয়েছে। নতুন প্রজন্মের মধ্যে এই রোগ প্রতিরোধে তার গ্রহণযোগ্য তথ্য প্রবাহ জরুরি। তাদের মধ্যে সনাতনী হৃদরোগ প্রতিরোধ ও প্রতিকারমূলক পদক্ষেপের প্রতি একধরনের সংশয় পোষণের প্রবণতা লক্ষ্যণীয়। তারা ডিজিটাল প্রযুক্তি গ্রহণে বেশি আগ্রহী। তারা এই প্রযুক্তিতে হৃদরোগ সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য বের করে এনে তা প্রয়োগের চেষ্টা করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারও দৃশ্যনীয় হয় কখনওবা। এই প্রযুক্তিতে বিভিন্ন ডিজিটাল ডিভাইস হৃদস্পন্দন সার্বক্ষণিক মনিটর করে ছন্দপতন শনাক্ত করে তার প্রতিকারে ব্যবস্থা নেয়। এছাড়াও এই প্রযুক্তি শারীরিক হার্টনেস, ব্যায়ামের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ এবং শরীরের সামগ্রিক সুস্থতা বিধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এসব বাস্তবতার নিরিখে চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশন হৃদরোগ প্রতিরোধে ডিজিটাল প্লাটফরমের সর্বোচ্চ ও বিজ্ঞানসম্মত ব্যবহারের মাধ্যমে হৃদরোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে সাফল্যমণ্ডিত করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
উপসংহার: হৃৎস্পন্দন মানে প্রাণের স্পন্দন। আর ছন্দায়িত হৃৎস্পন্দন মানে সুস্থ হৃৎপিণ্ড। এই হৃৎপিণ্ড সৃষ্টিকর্তার শ্রেষ্ঠ দান। তা সৃষ্টি করা হয়েছে আপনাকে দীর্ঘদিন সেবা দিতে এবং উপভোগ্য ও উৎপাদনশীল জীবনের নিশ্চয়তা দিতে। তাই আপনিও তার যথাযথ পরিচর্যা করুন। আপনার ছন্দবন্ধ ও স্বাস্থ্য সম্মত জীবন প্রণালীই হৃদরোগ প্রতিরোধ করে হৃৎ–স্পন্দন অটুট রাখতে পারে।
লেখক: হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ, সাবেক বিভাগীয় প্রধান, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ।