ছড়ায় জাদু থাকে। সেই জাদুগুণে মোহিত হন পাঠক। তার সৌন্দর্যে তাঁরা বিভোর হন, সুরে আন্দোলিত হন। নানা রকম ছড়া লেখা হয় আমাদের বাংলা ভাষায়। ছোটোদের ছড়া, বড়োদের ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া–নানা রকম ছড়া। ছড়াশিল্পীরা স্বপ্ন দেখেন, স্বপ্ন দেখান। তাঁরা স্বপ্নের আলো জ্বালানোর পাশাপাশি বাস্তবের আগুনও জ্বালান। তাই সাম্প্রতিক ছড়া মানে স্বপ্নময়, আলোময়, জ্বালাময়– বিচিত্রধর্মী রচনা।
হুমায়ুন আজাদ ছোটোদের উদ্দেশে লিখেছিলেন: ‘তোমরা হেমিলনের বাঁশিঅলার কথা শুনেছো। আজ সে–মায়াবী বাঁশিঅলা আর নেই। তাই তোমরা যাবে কার সাথে? যদি জিজ্ঞেস করো, তবে বলবো, নিশ্চয়ই যাবে ছড়ার সাথে। তার বাঁশি আছে, তার জাদু আছে। তার সুর আছে, তার নূপুর আছে।’
ইদানীং বাংলাদেশে ছড়া আর কার্টুনের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে। পাঠক যেভাবে একটা দৈনিক পত্রিকায় তরতাজা সংবাদ প্রত্যাশা করে, তেমনি কার্টুনও দেখতে চায় প্রতিদিন। কার্টুনের ছোট চিত্রের মাধ্যমে ফুটে ওঠে একটা পরিপূর্ণ ক্যানভাস। তাতে খোঁচানো যায়, ব্যঙ্গ করা যায়, বিদ্রূপ করা যায়। ছড়াও এক ধরনের কার্টুন। তার মাধ্যমে দু–চার কথায় অনেক কিছু বলা যায়, ব্যঙ্গ করা যায়, প্রতিবাদ করা যায়। তাই এখনকার অনেক দৈনিকে কার্টুনের পাশাপাশি ছড়াকেও প্রায় গুরুত্বের সঙ্গে উপস্থাপিত হতে দেখা যাচ্ছে। সামপ্রতিক ঘটনাবলির ওপর রচিত এসব ছড়ার বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এগুলো ছোটো এবং আঁটোসাঁটো। ছন্দ–মিলে–বিন্যাসে এগুলি সহজ ও উজ্জ্বল। তবে কখনো যেন তরল হয়ে না পড়ে–সেদিকে ছড়াশিল্পীরা থাকেন খুবই সচেতন। কৌতুকের বক্রতায় এবং বক্তব্যের সাবলীলতায় ছড়াগুলি সুসম্পূর্ণ। এগুলো রচনার পেছনে আবেগ যতটুকু কাজ করে না, তার চেয়ে বেশি করে কৌতুক। এটুকু বলতে পারি–ছড়াগুলি পাঠকের ততো ভালো লাগাতে না পারলেও তার চোখ–কান–কৌতূহলকে উদ্দীপ্ত করে এবং কল্পনার উৎসুকতাকে দেয় পূর্ণ বিকশিত বুদ্ধির আনন্দ।
সামপ্রতিক বিষয় মানে একেবারে তরতাজা ঘটনার চিত্রায়ন। এখন যা ঘটেছে, তার ওপরই লেখা হয়ে থাকে ‘সমকালীন ছড়া’। বক্তব্যের তাৎক্ষণিকতা অনেক সময় লেখার শিল্পগুণকে নষ্ট করে ফেলে। সামপ্রতিক ঘটনার ওপর নির্মিত বলে ছড়াগুলোর স্থায়িত্ব সম্বন্ধেও সন্দেহ জাগতে পারে। অস্বীকার করার উপায় নেই যে, কালের চাকা ঘোরার সাথে সাথে এসব ছড়ার অধিকাংশই স্থান পাবে ডাস্টবিনে। তবে আমরা মনে করি, সাময়িকতার আমেজ কেটে গেলেও ঘটনার পরম্পরা কালের ইতিহাস হিসেবে নির্ণিত হবে। মনে রাখতে হবে ‘সাময়িকতার দিকে ছড়ার স্বাভাবিক উন্মুখতা দুর্নিবার’। চলমান ঘটনার ওপর নির্মিত ছড়া বা কবিতাকে বুদ্ধদেব বসু ‘পদ্য–সাংবাদিকতা’ হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তবে তাকে তিনি সাহিত্যের মর্যাদায় অভিষিক্ত করতে চেয়েছেন। তিনি বলেছেন, ‘কেউ যদি একে কবিতা বলতে না চান, না–ই বললেন, না হয় এ পদ্য–সাংবাদিকতাই হলো, কিন্তু সাংবাদিকতা–শুধু পদ্যে নয়, গদ্যেও কখনো কখনো সাহিত্যের এবং স্থায়ী সাহিত্যের আসন পেয়েছে, ইতিহাসে এর দৃষ্টান্ত অত্যন্ত বিরল নয়। মূল্যটা যেখানে মতের– সেখানেই অচিরতার আশঙ্কা, কিন্তু মূল্যটা যেখানে রূপের – সেখানে অনেকটা নির্ভর হওয়া যায়। কোনো সাংবাদিক–রচনা সাহিত্যের স্তরে পৌঁছালো কিনা, সেটা যাচাই করার একটা উপায় হলো নিজেকে এই কথা জিজ্ঞাসা করা যে লেখাটা আমার যে ভালো লাগলো, তা তথ্যের জন্য, না মতের জন্য, না রূপের জন্য। মনে মনে যদি এ কথা বলি যে লেখাটা যেমনই হোক, যেটা বলতে চাচ্ছে, সেটা খুব ভালো কথা, তাহলে তাকে আর যা–ই বলি সাহিত্য বলা চলে না। আর যদি মনে হয় যে, লেখক ভুল বলছেন, তাঁর কথা মানি না, কিন্তু লেখাটা ভালো লাগলো, তাহলেই বুঝতে হবে যে সাহিত্যের শক্তি তার মধ্যে কাজ করছে। আর যদি উভয়কে পাওয়া যায় একই সঙ্গে, তাহলে তো কথাই নেই’।
আমি জানি না, আমি যে সব অন্ত্যমিল বা ছড়া লিখেছি, আমার লেখাগুলি সময়ের বিবেচনায় কতোটা উত্তীর্ণ হতে পেরেছে। অসংখ্য ছড়া লিখেছি, যে–গুলো সমকালের। সময়ের সাথে সাথে লেখাগুলিও যে হারিয়ে যেতে পারে–নষ্ট হয়ে যেতে পারে তার আবেদন– সেই শংকা ছিলো শুরু থেকেই। তাই লেখা লিখেই দায়িত্ব শেষ করেছিলাম। খুব একটা গুরুত্ব দেওয়া হয় নি বলে পত্রিকার কাটিংও সংগ্রহে রাখি নি। মনে করেছিলাম সংবাদের মতোই আজ যা সঙ, তা কাল বাদ বা বাতিল বিবরণী হয়ে যাবে। কিন্তু দিন যতই যায়, আমার ছড়া–কলামের পাঠক বাড়তে থাকে। বাড়তে থাকে এর গুরুত্ব। কেননা, আমি আমার ছড়াগুলিতে মত আর রূপের সমন্বয় ঘটাতে চেষ্টা করেছি। মেদহীন অঙ্গের মাধ্যমে এবং উগ্রতাহীন ব্যঙ্গের মাধ্যমে আমি ডিঙোতে চেয়েছি সাময়িকতার সংকীর্ণতা। পাঠকের মন জয় করাই শুধু আমার লক্ষ্য নয়, সাহিত্যসেবাও আমার ব্রত।
১৯৯৫ সাল থেকে ২০১৮ টানা তেইশ বছরে প্রচুর ‘অন্ত্যমিল’ প্রকাশিত হয়েছে আজাদীর আজমিশালীতে। এখান থেকে বাছাই করা কিছু লেখা নিয়ে একটা গ্রন্থ প্রকাশের তাগাদা দেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক, কীর্তিমান কবি, প্রাবন্ধিক ও কথাসাহিত্যিক ড. ময়ুখ চৌধুরী। বস্তুত ২০১৬ সালে আদিগন্ত প্রকাশন থেকে আমার প্রকাশিত ‘অন্ত্যমিলসমগ্র :১’ তাঁরই উৎসাহের ফসল।
প্রায় চার দশকেরও বেশি সময় ধরে লেখালেখি করছি। এ পর্যন্ত ৮৪টি বই বেরিয়েছে। তন্মধ্যে কিশোরকবিতা, কিশোরগল্প, প্রবন্ধের বই বেশি। ছড়ার বই মাত্র দুটি। ‘অন্ত্যমিলসমগ্র :১’ গ্রন্থে কেবল সেইসব ছড়া স্থান পেয়েছে যেগুলো আজাদীর আজমিশালীতে প্রকাশিত হয়েছে। তার মধ্যে থেকেও কিছু ছড়া বাদ দেওয়া হয়েছে, আর কিছু ছড়া সংগ্রহে ছিলো না বলে অন্তর্ভুক্ত করা যায় নি। তবু আমি মনে করি, অন্ত্যমিলগুলির মাধ্যমে আমার সময়কে আমি ধরে রাখতে পেরেছি। অন্ত্যমিলসমগ্র আমার চলমান সময়ের চালচিত্র। জীবন–পথের নিবিড় পর্যবেক্ষণ। ব্যক্তি–অনুভূতিমালা। আজাদীর ‘আজমিশালী’ নাম পরিবর্তন করে এখন চলছে ‘খোলা হাওয়া’ নামে। ‘খোলা হাওয়া’য় যে সব ছড়া প্রকাশ পাচ্ছে, আগামীতে সে সব ছড়া নিয়ে ‘অন্ত্যমিলসমগ্র:২’ প্রকাশ করার ইচ্ছে রয়েছে।
শিশুসাহিত্যর নানা শাখায় আমি হাঁটাহাঁটি করার চেষ্টা করলেও ছড়াকে কখনো আমি এড়িয়ে যাই নি। ফলে ছড়া আমাকে পরিচিতি দিয়েছে, দিয়েছে সমৃদ্ধি। তাই আমি ছড়ার আনন্দ আর সুর থেকে কখনো বিচ্ছিন্ন হতে চাই না।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী;
ফেলো (নম্বর–৪২২), বাংলা একাডেমি।