প্রতিমা বিসর্জনের মধ্য দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার শেষ হয়েছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা। সকালে বিজয়া দশমীর পূজা শেষে অশ্রুসিক্ত নয়নে দেবী দুর্গাকে বিদায় জানান ভক্তরা। সেই সঙ্গে আগামী বছর ‘মা’ আবারও এই মর্ত্যলোকে ফিরে আসবেন–এই আকুল প্রার্থনাও জানিয়েছেন তারা। গতকাল মঙ্গলবার প্রতিমা বিসর্জনের আগে সকালে মণ্ডপে মণ্ডপে শুরু হয় দশমীর পূজা–অর্চনা। সকাল ৮টা ৩০ মিনিটের মধ্যে শুরু হয় দশমীবিহিত পূজা। পূজা সমাপনান্তে ভক্তরা ভক্তি–শ্রদ্ধার্ঘ্য দিয়ে দুর্গা মায়ের চরণে শেষবারের মতো প্রণাম জানিয়ে আশীর্বাদ গ্রহণসহ শান্তির জল গ্রহণ করেন। পূজা শেষে দেওয়া হয় দর্পণ বিসর্জন। এসময় পরম ভক্তি নিয়ে নিজ নিজ মনের বাসনা জানিয়ে দেবীর পায়ে সিঁদুর ছোঁয়ান নারীরা। লাল রঙকে শক্তির প্রতীক হিসেবে মনে করে নারীরা একে অপরের মাথায় সিঁদুর ছোঁয়ান। দীর্ঘায়ু কামনা করেন পরিবারের সদস্যদের। সধবা নারীরা বিসর্জনের জন্য দেবীকে সাজান ফুল, সিঁদুর ও নানা অলঙ্কার দিয়ে। পুরোহিতরা দেবীর জন্য সাজান সেদ্ধ চালের নৈবেদ্য, কচু–ঘেচু আর শাপলা দিয়ে। এরপর শেষ মন্ত্রোচ্চারণের মধ্যদিয়ে বিদায় জানানো হয় দেবীকে। অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে শুভ–কল্যাণ ও সব সমপ্রদায়ের মানুষের মধ্যে নিরন্তর শান্তি–সমপ্রীতির আকাঙ্খা নিয়ে গত শুক্রবার ষষ্ঠীপূজার মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনের দুর্গাপূজা শুরু হয়েছিল। গতকাল মঙ্গলবার বিজয়া দশমীতে দেবী বিসর্জনের মধ্যদিয়ে পাঁচদিনের শারদীয় দুর্গোৎসব সম্পন্ন হয়। দশমীর দিনটিতে বিষাদের পাশাপাশি আনন্দমুখর হয়ে উঠেছিল চট্টগ্রামসহ সমগ্র দেশ। ঢাাক–ঢোল বাজিয়ে অশ্রুসিক্ত নয়নে দুর্গা প্রতিমাকে বিসর্জন দেওয়া হয়। মণ্ডপে–মণ্ডপে হিন্দু সমপ্রদায়ের মানুষ একে অপরের সঙ্গে বিজয়ার শুভেচ্ছা বিনিময় করেন। আবারও মঙ্গলবার্তা নিয়ে আগামী বছর যেন মা দুর্গা আগমন করেন, বিসর্জনকালে সেই প্রার্থনা করেন ভক্তরা।
এবার বৈরী আবহওয়ার কারণে দুপুরের পর থেকে বিকেলের মধ্যে দেবী দুর্গা ও অন্যান্য দেব–দেবীর বিসর্জন দেওয়া হয়। এর মধ্য দিয়ে দেবী মর্ত্যলোক ছেড়ে স্বর্গে ফিরে যান।
বিজয়া দশমীর পূজার পরপরই দুপুরের পর থেকে নগরীর প্রতিটি মণ্ডপ থেকে ট্রাকে করে প্রতিমাগুলো বিসর্জনের জন্য নেয়া হয় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে। এরপর সুশৃক্সখলভাবে একে একে প্রতিমা নিরঞ্জন দেয়া হয়। বৈরী আবহাওয়ার মাঝে প্রতিবছরের মতো এবারও পতেঙ্গা সৈকতে দেবীকে শেষবারের মতো দর্শনে লোকে লোকারণ্যে পরিণত হয়। বাঙালি হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বিশ্বাস অনুযায়ী, দেবী শরতে পৃথিবীতে আসেন তার পিত্রালয়ে। র বিসর্জনের মাধ্যমে তিনি ফিরে যান হিমালয়ের কৈলাসে স্বামী শিবের সান্নিধ্যে। এবার দেবী মর্ত্যলোকে (বাবার বাড়ি) এসেছিলেন ঘোটকে। আর গতকাল বিজয়া দশমীর পূজা শেষে আবারো কৈলাসে ফিরে গেছেন ঘোটকে।
প্রতিবছরের মতো এবারও নগরীর পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রতিমা নিরঞ্জনের ব্যবস্থা করেছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। সিটি কর্পোরেশনের ব্যবস্থাপনায় পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে প্রতিমা নিরঞ্জন অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী। এদিকে, চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী ও শিক্ষ উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বৈরি আবহাওয়ার মধ্যেও বৃষ্টিতে ভিজে প্রতিমা নিরঞ্জন কার্যক্রম তদারকি করেন।
দুপুর থেকেই পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে নগরের প্রায় দুই শতাধিক মণ্ডপের প্রতিমা বিসর্জন দেয়া হয়েছে বলে জানান পূজা উদযাপন পরিষদ নেতৃবৃন্দ।
প্রতিমা নিরঞ্জন অনুষ্ঠানে সিটি মেয়র মো. রেজাউল করিম চৌধুরী প্রধান অতিথি ছিলেন। সন্ধ্যার মধ্যে যাতে বঙ্গোপসাগরে সুষ্ঠু ও শান্তি শৃক্সখলার মধ্যে পূজারীগণ প্রতিমা নিরঞ্জন করতে পারেন সে লক্ষ্যে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকতে আলোকবাতি, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা, সাজসজ্জা, মঞ্চ নির্মাণ, মাইকিং, পানীয় জলের ব্যবস্থাসহ সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করে। বিপুল সংখ্যক–পুলিশ আনসার সদস্যের পাশাপাশি মোতায়েন করা হয় র্যাব ও গোয়েন্দা সদস্যদেরও।
অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে চসিক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম সামপ্রদায়িক সমপ্রীতির অন্যতম পাদপীঠ। এই নগরীতে জাতিগত কোন ভেদাভেদ নেই। শারদীয় দুর্গাপূজা উৎসব অত্যন্ত সুষ্ঠু ও শান্তি–শৃঙখলার সাথে সম্পন্ন হওয়া তারই একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে শান্তিপূর্ণভাবে দুপুর থেকেই পূজারী ও ভক্তরা শ্রদ্ধার সাথে তাদের প্রতিমা নিরঞ্জন দেয়ার জন্য গাড়িতে করে পতেঙ্গায় প্রতিমা নিয়ে আসেন। এলাকায় হাজার হাজার ভক্ত ও পূজারীর উপস্থিতিতে কোথাও তিল মাত্র ঠাঁই ছিল না।
শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সামপ্রদায়িক শক্তির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষায় কাজ করতে হবে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এসময় অনুষ্ঠানে আরো উপস্থিত ছিলেন চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম, কাউন্সিলর ছালেহ আহম্মদ চৌধুরী, নুরুল আমিন, আবদুস সালাম মাসুম, ওয়াসিম উদ্দিন চৌধুরী, মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি লায়ন আশীষ কুমার ভট্টাচার্য, সাধারণ সম্পাদক হিল্লোল সেন উজ্জ্বলসহ চসিকের কর্মকর্তাবৃন্দ ও চট্টগ্রাম মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের নেতৃবৃন্দ। এ বছর নগরের জেএমসেন হলসহ ১৬ থানায় ব্যক্তিগত–ঘট পূজাসহ ২৯৩টি পূজামণ্ডপ এবং চট্টগ্রাম জেলার ১৫ উপজেলায় ২ হাজার ১৭৫ মণ্ডপে শারদীয় দুর্গাপূজা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি লায়ন আশীষ কুমার ভট্টাচার্য বৈরী আবহাওয়ার কারণে আমরা প্রতিটি পূজা মণ্ডপকে বলেছি দুপুরের মধ্যে প্রতিমা বির্সজন দিয়ে দেওয়ার জন্য। প্রতি বছরের মতো এবারও পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত ছাড়াও অভয়মিত্র ঘাট, বারুণী স্নান ঘাট, কর্ণফুলী নদীর বিভিন্ন ঘাট, কাট্টলী সৈকত, কালুরঘাটসহ নগরীর কয়েকটি বড় বড় দীঘিতেও দেয়া হয় প্রতিমা বির্সজন।
চট্টগ্রাম জেলা পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক সুগ্রীব মজুমদার দোলন আজাদীকে বলেন, বৈরী আবহাওয়ার কারণে উপজেলা পর্যায়ে বেশির ভাগ প্রতিমা গ্রামের দীঘিতে এবং পুকুরে বিসর্জন দেয়া হয়েছে। সকালে দশমী পূজার পর দুপুরের পর থেকে প্রতিটি উপজেলায় প্রতিমা বির্সজন শুরু হয়েছে। পূজার মতো শান্তিপূর্ণভাবে বিসর্জনও শান্তিপূর্ণভাবে সম্পন্ন হয়েছে বলে জানান তিনি। তিনি পাঁচদিনব্যাপী শারদীয় দুর্গোৎসবের শান্তিশৃক্সখলার দায়িত্বে নিয়োজিত পুলিশসহ আইন শৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রত্যেক সদস্যদেরকে অভিনন্দন এবং কৃতজ্ঞতা জানান।