পঁচাত্তর বছর আগে, টলিডোর চেরি স্ট্রিটে অবসরপ্রাপ্ত এক দম্পতির উদ্যোগে খুবই ভালো একটা কাজের জন্ম হয়েছিলো, যা এখনো চলছে। শুধু চলছে বলা ভুল হবে, বর্তমানে এই এলাকার (নর্থওয়েস্ট ওহাইহো + সাউথইস্ট মিশিগান) গরীব–দুস্থ ও গৃহহীনদের জন্যে সবচেয়ে বড় শেল্টার ও স্যুপ–কিচেন। গড়ে প্রতিদিন ৭০০–৯০০ জনকে এখান থেকে তিনবেলা খাবার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য, কাপড়–চোপড় দেওয়া হয়; এবং তাদের রাতযাপনের জন্যে মহিলা–পুরুষদের আলাদা হোস্টেলের ব্যবস্থাও আছে।
১৯৪৭ সালে, জেসী ও বার্থা ফ্লেক রিটায়ার করে অবসরজীবনে বসে বসে অলস সময় কাটানোর বদলে, নিজেদের বাড়ি–বিষয়–সম্পত্তি সব বেচে দিয়ে, সেই টাকায় শেল্টার খুললেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে, অনেক দুস্থ–গৃহহীন তখন ভীষণ মানবেতর দিন কাটাচ্ছিলো। অনেকে যুদ্ধের বিভীষিকা কাটিয়ে উঠতে না পেরে মানসিকভাবে দিকভ্রান্ত (PTSD পোস্ট–ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিস্অর্ডার; নামটা না থাকলেও, মানুষতো তখনও সেই রোগে ভুগতো)। ফ্লেক–দম্পতি নিজেদের আরাম–আয়েস বিসর্জন দিয়ে, নিজেরাই সেই শেল্টারে থাকা শুরু করলেন ভোর থেকে শুরু করে রাত অবধি নিজেদের হাতেই দুস্থদের সেবা করার জন্যে। শুরু করেছিলেন 5S দিয়ে স্যুপ (soup ), সোপ (soap ), শেল্টার (shelter ), সোল (soul ) এবং স্যালভেশান (salvation )। মানে খাবার, নিত্যপ্রয়োজনীয় শারীরিক পরিচ্ছন্নতার দ্রব্যাদি, রাত কাটাবার ব্যবস্থা এবং উপাসনার মাধ্যমে মানসিক প্রশান্তি ও ঈশ্বরপ্রাপ্তি। ফ্লেক–দম্পতি এতই প্রচারবিমুখ ছিলেন যে, নিজেদের নামে বা পরিবারের কারো নামে এটা করেন নাই কারণ এরকম করলে, মনে অহঙ্কার দানা বাঁধে। আপনি ঈশ্বর, আল্লাহ্ বা ভগবান যাই–ই বলেন তিনি মানুষের মাঝে অহঙ্কার ও শো–অফের পরিবর্তে নম্র–বিনীতভাবকেই সবচেয়ে বেশী মূল্য দিয়ে থাকেন। মিশনটার শুরু যেই রাস্তায়, তার নামেই হলো চেরি স্ট্রিট মিশন। এই রাস্তার আশেপাশে আরো অনেক উপাসনালয়ও আছে। এমনকি অ্যামেরিকার সবচাইতে পুরানো মসজিদগুলোর একটা (সম্ভবত তৃতীয় পুরাতন), এখনো সেখানেই আছে; নাম আল–ইসলাম মসজিদ। আমিও মাঝে মাঝে জুম্মা পড়তে সেখানে যাই।
এখন অবশ্য এটা আর চেরি স্ট্রিটের উপরে নাই। বড় হয়ে যাওয়ার ফলে ছোট বিল্ডিং থেকে বেশ কয়েকবার স্থান পরিবর্তন করতে হয়েছে। আমি নিজেই প্রথম যখন গিয়েছিলাম, সেটার থেকে এখন একটা ভালো বড় জায়গায় এসেছে। এদেশে হাইস্কুলে ছাত্রদেরকে সমাজের নানান জায়গায় ভলান্টিয়ার কাজ করতে হয় চার্চ, মসজিদ, পার্ক, বৃদ্ধাশ্রম, হাসপাতাল যে কোনো ধরনের ভালো কাজ। আমার ছেলেমেয়ে দু‘জনেই মসজিদের সঙ্গে অনেক কাজ করেছে। তারপরে স্কাউটে যোগ দিয়ে, ভলান্টিয়ার কাজ আরো বেশী করতে হতো। প্রায়সময়ই বাবা–মাকে সঙ্গে থাকতে হয়। আমাদের ছেলে আরাফাসহ চেরি স্ট্রিট মিশনে কাজ করবার সময়ে আমরা জানলাম এর ব্যাপারে। এখানে একজন গৃহহীনকে গৃহহীন হিসাবে দেখা হয় না, দেখা হয় একজন মানুষ হিসাবে। এবং চেষ্টা চালানো হয় যাতে সে গৃহহীনতা ও দরিদ্র্যতার নাগপাশ থেকে বেরিয়ে, নিজের জীবন পুনরায় গড়ে তুলতে পারে। সেজন্যেই নাম লাইফ রিভাইটালাইজেশান সেন্টার। গৃহহীন ও দুস্থদের দারিদ্রের শিকল (বৈষয়িক দারিদ্র ও মনের দারিদ্র) ভেঙ্গে ফেলতে সাহায্য করা হয়।
হুট করে এখানে কাজ করা যায় না সকল ভলান্টিয়ারদেরই ওরিয়েন্টেশান করতে হয়। রাস্তায় ভবঘুরে হোমলেস্ দেখলে আমাদের একেকজনের মনে একেক ধারণা জন্মে। তার কিছু সঠিক, কিছু হয়তো সঠিক নয়। তৃতীয়–বিশ্ব থেকে আসা আমাদের অনুমান তো আরো প্যাঁচালো। সেই ভুলগুলো ভাঙিয়ে দেয়, তা না হলে আমরা তাদের সঙ্গে সঠিকভাবে আচরণ না–ও করতে পারি। আগের থেকেই যদি তাদের সম্পর্কে খারাপ ধারণা থাকে, তাহলে তাদেরকে সেবা করবো কী করে? হোমলেস্নেস্ একধরনের মানসিক রোগ। অনেকেই হয়তো টাকার অভাবেই গৃহহীন; কিন্তু তাই বলে সকলেই তা নয়। এইটা একটা রোগ। আর গৃহহীন বলেই যে তারা উগ্র বা ভায়োলেন্ট, তা–ও কিন্তু নয়। তবে তাই বলে আমরাও যে সেইফটি প্রটোকল মেনে চলবো না তা নয়। অনেক সেইফটি রুল্স্ শিখতে হয়। ঘন্টা দু–তিনেক ধরে সব্বাইকে ভলান্টিয়ার ওরিয়েন্টেশান করায়।
আমরা ভলান্টিয়াররা তো শুধুমাত্র ঘন্টাখানেকের জন্যে যাই; কিন্তু সেন্টারটা চলে ফুলটাইম বেতনভুক্ত স্টাফ দিয়েই। বোর্ড এবং এডমিনিস্ট্রেশান ছাড়াও, সিকিউরিটি গার্ড থেকে শুরু করে অফিস এসিস্ট্যান্ট, ভলান্টিয়ার কো–অর্ডিনেটর, হোমলেস্েদর কাউন্সেলর বা গাইড, কিচেনের সেফ, এসিস্ট্যান্ট–কুক ইত্যাদি সবই আছে। ভলান্টিয়াররা ঘন্টাখানেক মাত্র কাজ করলেও, তারও একটা গুরুত্ব রয়েছে। এভাবেই সমাজের সকল স্তরের মানুষকে ভালো কাজে সম্পৃক্ত ও উদ্বুদ্ধ করে তুলে। এবং আমরাও তাদের ব্যথা–বেদনায় সমব্যথী হতে পারি।
আগেই বলেছি, তাদের জীবনকে পুনরায় গড়ে দেওয়ার প্রচেষ্টায় থাকে লাইফ রিভাইটালাইজেশান সেন্টার। কেউ যখন প্রথম সেখানে আসে, তার সঙ্গে কথাবার্তা বলে তার একটা মূল্যায়ন করা হয়। তারপর, তাকে তার সাধ্যের মধ্যে লক্ষ্য ঠিক করে দেওয়া হয়। যাদের কাজ করার ক্ষমতা ও দক্ষতা রয়েছে, তাদেরকে সেই অনুযায়ী কর্মক্ষেত্রে নিয়োগ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কেউ কিছু শিখতে চাইলে, তাকে সেগুলো শিখানোর ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। লোকাল বিজ্েনস্ ও লোকাল কারিগরী শিক্ষাকেন্দ্র এসমস্ত ব্যাপারে চেরি স্ট্রিটকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। অনেকেই কম্পিউটার, ওয়েল্ডিং, মেশিনিস্ট, মেকানিক, প্লাম্বার, ইলেক্ট্রিশিয়ান, অফিস–স্পেশালিস্ট, ইত্যাদির ট্রেনিং নিয়ে চাকরি শুরু করে। যারা হয়তো পুরাপুরি হাইস্কুল পাশ করে নাই, তাদেরকে এডাল্ট এডুকেশানে জি.ই.ডি. করায়। আবার অনেককে এই সেন্টারের কাজেই নিয়োগ করে। বিল্ডিং পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন করা থেকে শুরু করে, লাইব্রেরি, অফিস ও কিচেনের অনেক কাজ হোমলেসরাই করে। একটু আগে বলেছিলাম বেতনভুক্ত কর্মচারীদের কথা। শেল্টারে আশ্রিতরা, বেতনভুক্তদের এভাবে অনেক সাহায্য করে।
গৃহহীন যারা এখানে রেজিস্টার্ড, তাদের প্রত্যেকের ক্রেডিট কার্ডের মতই একটা আইডি থাকে। সেটায় সব বৃত্তান্ত থাকে, আর থাকে পয়েন্ট। তারা যত ভালো ভালো কাজ করবে, তত পয়েন্ট পাবে। সেই পয়েন্ট ব্যবহার করে তারা এক্সট্রা খাওয়া খেতে পারে। সেন্টারে তিনবেলাই খাবার সার্ভ করা হয়, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের চাহিদা ও পুষ্টির দিকে খেয়াল রেখে। এছাড়াও বিশেষ দিনগুলোতে (ক্রিস্টমাস, থ্যাঙ্কসগিভিং ডে) স্পেশাল ডিনার দেয়। একবার আমরা তাদেরকে নদীর ধারে ডকসাইডে, টলিডোর সবচাইতে দামী রেস্টুরেন্টে খাবার দিয়েছিলাম।
বুঝতেই পারছেন, এই সেন্টার প্রধানত চলে ডোনেশানের পয়সাতেই। আর শুধু টাকাপয়সা নয়, মহিলা–পুরুষের নিত্যব্যবহার্য জিনিসপত্র থেকে শুরু করে, চেয়ার– টেবিল, বিছানা, বালিশ, টাওয়েল সেই সঙ্গে খাওয়া–দাওয়া তো অবশ্যই। বিশেষ করে শুকনা খাওয়ার ক্যান্ড্ ফুড, পাস্তা, রুটি, ফলমূল। একটা তুলনা দেওয়ার চেষ্টা করি সেন্টারে একজন মানুষকে একবেলা খাওয়াতে তিন কি চার ডলার লাগে। আর আমরা বাংলাদেশীরা যখন উইকএন্ডে কারো বাসায় পার্টি করি, সেখানে প্রতি প্লেটে লাগে প্রায় ১৫ থেকে ৩০ ডলার। বিয়ের অনুষ্ঠান হলে আরো বেশী। বিবেকের কাছে প্রশ্ন করি প্রতি সপ্তাহেই কী পার্টি করতে হবে? নাকি এক সপ্তাহেরটার খরচ এখানে বা অন্য কোনো ফুড–ব্যাঙ্কে দান করা যায়?
আমরা ভলান্টিয়াররা টাকা না শ্রম দিই; প্রধানত কিচেনে এবং ক্যাফেটেরিয়াতেই কাজ করি। যে–সমস্ত ডোনেশান আসে, সেগুলো শেল্ফে গুছিয়ে রাখা, রান্নার আয়োজন করা, কাটাকুটি, বাছাবাছি ইত্যাদি করা, খাবার সার্ভ করা, সবশেষে কিচেন স্যানিটাইজ করে দেওয়া। সেফ এবং এসিস্ট্যান্ট কুকরা রান্না করে রাখে; আর আমরা গিয়ে সেগুলোকে প্লেটে বেড়ে বেড়ে সার্ভ করি। যারা খেতে আসে, তাদেরকেও নিশ্চয়ই আমাদের মতই ওরিয়েন্টেশান টাইপের কিছু দিয়ে ভালান্টিয়ারদের সম্পর্কে শিক্ষা দেওয়া হয়। কারণ আমরা তো প্রফেশানাল সার্ভার নই। আনাড়ির মত সার্ভ করি, ভুলভাল করি। তারা যাতে এতে করে ক্ষিপ্ত না হয়। আমরাও চেষ্টা করি মুখে একটা হাসি রেখে, “হ্যালো” বলে সার্ভ করে, “হ্যাভ এ নাইস ডে” বলতে।
এখানে কাজ করলে অটোম্যাটিকালিই মনের মাঝে একটা পরিবর্তন আসা শুরু হয়। যখন দেখি তাদের তুলনায় আমরা কত সুখে আছি, তখন নিজেদের লাক্সারি, মাত্রাতিরিক্ত বৈষয়িক লোভ–লালসা, শো–অফ, মিথ্যা দম্ভ–আড়ম্বর এগুলোর মূল্যহীনতা সহজেই বুঝা যায়। অনেককেই দেখি সকাল–বিকাল অফিস, সন্ধ্যায় টিভি, রাতে ঘুম, উইকএন্ডে পার্টি, ফেসবুক ও ফটোসেশানে ব্যস্ত থাকে। তাদেরকে এসমস্ত স্যুপ–কিচেনে বা ফুড–ব্যাঙ্কে আসতে বললে, অনেক ব্যস্ততার কারণে নাকি আসতে পারেন না। সপ্তাহে বা মাসে নিদেনপক্ষে মাত্র ঘন্টাদেড়েক সময় দিতেও আমাদের কার্পণ্য হয়।
আমাদের শহরে মুসলিমরাও এরকম বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। বেশ কয়েকটা ফুড–ব্যাঙ্ক, স্যুপ–কিচেন চালায়। আগামীতে, সেটা নিয়ে লিখবো। সকলের মনেই যেন জেগে থাকে “জীবে দয়া করে যেই জন, সেই জন সেবিছে ঈশ্বর”।
টলিডো, ওহাইও, ২০২৩