দেশের দক্ষিণ–পূর্বাঞ্চলের প্রকৌশল শিক্ষা ও গবেষণার একমাত্র উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠান চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)। চট্টগ্রাম জেলার রাউজান উপজেলার পাহাড়তলি ইউনিয়নের চট্টগ্রাম–কাপ্তাই মহাসড়কের পাশে উনসত্তরপাড়া মৌজায় অবস্থিত। মূলশহর থেকে বেশ দূরে গ্রামীণ জনপদে অবস্থান ও নানাবিধ সীমাবদ্ধতার সত্ত্বেও সীমিত বাজেটের মধ্যে চুয়েট উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় নানা সাফল্য অর্জন করে ইতোমধ্যে দেশে–বিদেশে সকলের প্রশংসা কুড়িয়েছে।
সরকারের রূপকল্প অনুসরণে স্মার্ট বাংলাদেশ ও ভিশন ২০৪১ বাস্তবায়নের নিত্যনতুন কার্যকরী উদ্যোগ গ্রহণ চুয়েটের উল্লেখযোগ্য সাফল্য হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। জাতীয় উন্নয়ন ও আর্থ–সামাজিক উন্নয়নে পেশাদার প্রকৌশলীদের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে এবং প্রকৌশল ও প্রযুক্তি শিক্ষা–গবেষণাকে জনকল্যাণে বিস্তৃত করতে নিরন্তর কাজ করে যাচ্ছে চুয়েট। পাশাপাশি বিশ্ববাজারের চাহিদার সাথে সমন্বয় ও বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার লক্ষ্যে প্রকৌশল ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে যথোপযুক্ত মানব সম্পদ তৈরিতে প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে চুয়েট কাজ করে যাচ্ছে। প্রসঙ্গত, ১৯৬৮ সালে ‘চট্টগ্রাম ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ’ হিসেবে মাত্র ৩টি বিভাগ এবং ১২০ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু করে পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে ‘বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (বিআইটি), চট্টগ্রাম’ হিসেবে উন্নীত হয়। দীর্ঘ আন্দোল–সংগ্রামের মাধ্যমে ২০০৩ সালের ১লা সেপ্টেম্বর ‘চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়’ নামে একটি স্বায়ত্তশাসিত পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু করা প্রতিষ্ঠানটি মাত্র দুই দশকের পথচলায় আজকে দেশের প্রকৌশল শিক্ষা ও গবেষণার অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত কিউএস র্যাংকিংয়ে পরপর দুইবার ঈর্ষণীয় পেয়েছে। সর্বশেষ প্রকাশিত কিউএস র্যাংকিংয়ে এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৪০১–৪৫০ এর মধ্যে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৯২তম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্থান অর্জন করেছে। এছাড়া সারাদেশের মধ্যে শীর্ষ ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫ম, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২য় সেরা এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ৩য় সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে র্যাংকিংয়ে স্থান পেয়েছে চুয়েট।
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সফল উদ্যোক্তা তৈরি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা এবং ইন্ডাস্ট্রি–একাডেমিয়া কোলাবোরেশনকে আরও সম্মৃদ্ধ করার লক্ষ্যে প্রায় ১১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে নির্মিত সর্বপ্রথম ‘চুয়েট শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর জননেত্রী শেখ হাসিনা’র হাত ধরে শুভ উদ্বোধনের মাধ্যমে দৃশ্যমান অগ্রগতি ও চুয়েটের সাফল্যের ধারায় নতুন পালক যুক্ত করেছে।
দেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ভিত্তিক আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর চুয়েটে: দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সর্বপ্রথম বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এবং বাংলাদেশ হাইটেক পার্ক কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে প্রায় ১১৮ কোটি টাকা ব্যয়ে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে সফল উদ্যোক্তা সৃষ্টি, বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা ও উদ্ভাবনী কার্যক্রমকে উৎসাহিত করা এবং ইন্ডাস্ট্রি–একাডেমিয়া কোলাবোরেশনকে আরও সম্মৃদ্ধ করার পাশাপাশি স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ এবং এই খাতে বিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের লক্ষ্যে দেশের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে সর্বপ্রথম ‘শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর’ স্থাপন চুয়েটের দৃশ্যমান অগ্রগতি সাফল্যের ধারায় নতুন পালক যুক্ত করেছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় তথ্যপ্রযুক্তি খাতে দক্ষ গ্র্যাজুয়েট তৈরির মাধ্যমে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণে এই ইনকিউবেটর ভূমিকা রাখবে বলে প্রত্যাশা করা হচ্ছে। ইনকিউবেটর নিয়ে চুয়েট শিক্ষার্থীদের মাঝেও ব্যাপক উৎসাহ–উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। চুয়েটের নির্মাণাধীন আইটি বিজনেস ইনকিউবেটর প্রজেক্ট তরুণদের জন্য অপার সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে তরুণরা দেশের প্রযুক্তি বিপ্লবে নেতৃত্ব দেবেন বলে বিশ্বাস চুয়েটের মাননীয় ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ রফিকুল আলম। উল্লেখ্য যে, প্রায় ৫ একর আয়তনজুড়ে স্থাপিত শেখ কামাল আইটি বিজনেস ইনকিউবেটরে ১০ তলাবিশিষ্ট একটি ইনকিউবেশন ভবন এবং ৬ তলাবিশিষ্ট একটি মাল্টিপারপাস প্রশিক্ষণ ভবন রয়েছে। যেখানে থাকছে স্টার্টআপ জোন, আইডিয়া/ইনোভেশন জোন, ইন্ডাস্ট্রি–একাডেমিক জোন, ব্রেইনস্ট্রর্মিং জোন, এক্সিবিশন সেন্টার, ই–লাইব্রেরি জোন, ডাটা সেন্টার, রিসার্চ ল্যাব, ভিডিও কনফারেন্সিং কক্ষ, সম্মেলন কক্ষ প্রভৃতি।
চুয়েট যেখানে অনন্য : চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫টি অনুষদের অধীনে ১৮টি বিভাগের পাশাপাশি ৩টি গবেষণা ইনস্টিটিউট, ৩টি গবেষণা সেন্টার এবং একটি কেন্দ্রীয় ব্যুরো অব রিসার্চ, টেস্টিং অ্যান্ড কনসালটেন্সি রয়েছে। সেন্টারটির মাধ্যমে সারাদেশে বিবিধ শিল্প এবং প্রতিষ্ঠানকে প্রযুক্তি সংক্রান্ত সেবা ও পরামর্শ প্রদান করা হচ্ছে। চুয়েটে রয়েছে ‘ইনস্টিটিউট অব আর্থকোয়েক ইঞ্জিনিয়ারিং রিসার্চ’ নামে দেশের একমাত্র ভূমিকম্প প্রকৌশল গবেষণা ইনস্টিটিউট। এছাড়া ‘সেন্টার ফর রিভার, হারবার অ্যান্ড ল্যান্ড–স্লাইড রিসার্চ’ নামে দেশের একমাত্র পোতাশ্রয় ও ভূমিধস বিষয়ক গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে। অন্যদিকে চুয়েটে বছর জুড়েই বিভিন্ন বিভাগের আয়োজনে আন্তর্জাতিক সেমিনার ও কনফারেন্স আয়োজন করে।
সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে চুয়েট: প্রকৌশল শিক্ষা অন্যান্য শিক্ষা পদ্ধতির চেয়ে ব্যতিক্রম হওয়ায় চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–ছাত্রীদের সারাবছরই একাডেমিক শিউিউলের মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু তাই বলে চুয়েটিয়ানরা সামাজিক–সাংস্কৃতিক অঙ্গনে দমে থাকতে পারে না। শুনে অবাক হতেও পারেন যে, চুয়েটের ১৭১ একরের ভূমিতে নিবন্ধনকৃত সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের সংখ্যা অন্তত ২৫টি।
এরমধ্যে আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় সাংস্কৃতিক উৎসবে ‘জয়ধ্বনি’ ২০১২, ২০১৪, ২০১৭ এবং ২০১৮ সালে চ্যাম্পিয়ন ও ২০১০ রানার্স আপ হওয়ার গৌরব অর্জন করে। চুয়েট ডিবেটিং সোসাইটিও সম্প্রতি জাতীয় বিতর্ক উৎসব ‘চঈউঋ–২০১৯’এর চ্যাম্পিয়ন, বাংলাদেশ টেলিভিশন আঞ্চলিক বিতর্ক প্রতিযোগিতা–২০১৯ এর চ্যাম্পিয়নসহ বিভিন্ন পর্যায়ে মোট ৭বার চ্যাম্পিয়ন ও তিনবার রানাস–আপ হয়। এছাড়া গ্রীন ফর পিস’র বছরজুড়েই পরিবেশ সচেতনতামূলক কার্যক্রম তো আছেই। পাশাপাশি বহিঃর্বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে রোবটিক চর্চা এবং মহাকাশ ও রোবটিক গবেষণার সাথে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছে আরএমএ এবং অ্যাসরো’র শিক্ষার্থীরা। বিশেষ করে, রোবট গবেষণায় চুয়েট শিক্ষার্থীরা প্রতিবছরই দেশ–বিদেশ হতে কোনো না কোনো সাফল্য নিয়ে আসছেন।
চুয়েটের সাম্প্রতিক সময়ের অর্জনসমূহ:-
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক বিশ্ববিখ্যাত কিউএস ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটি র্যাংকিংয়ে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট) ২০২৪ সালের জন্য প্রকাশিত তালিকায় এশিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর মধ্যে ৪০১–৪৫০ এর মধ্যে এবং দক্ষিণ এশিয়ার ৯২তম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে স্থান অর্জন করেছে। এছাড়া সারাদেশের মধ্যে শীর্ষ ১৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ৫ম, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ২য় সেরা এবং পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ৩য় সেরা বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে র্যাংকিংয়ে স্থান পেয়েছে চুয়েট। পাশাপাশি বৈশ্বিক র্যাংকিংয়ে ১২০১–১৪০০ এর মধ্যে এবং বিষয়ভিত্তিক পেট্রোলিয়াম ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাটাগরিতে ১০১–১৫০ এর মধ্যে অবস্থান করেছে চুয়েট। গত ২৭শে জুন ২০২৩ খ্রি. এই র্যাংকিং প্রকাশিত হয়েছে।
আমেরিকান কংক্রিট ইন্সটিটিউটের এসিআই ‘এক্সিলেন্ট’ বিশ্ববিদ্যালয়ের তালিকায় চুয়েট: চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়কে (চুয়েট) আবারও ‘এঙিলেন্ট ইউনিভার্সিটি’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে পুরকৌশলীদের আন্তর্জাতিক পেশাজীবী সংগঠন আমেরিকান কংক্রিট ইনস্টিটিউট (এসিআই)। গত ১০ই ফেব্রুয়ারি ২০২৩ খ্রি. যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানভিত্তিক এই সংগঠনটি আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দিয়ে চুয়েট কর্তৃপক্ষ এ তথ্য জানায়। তালিকায় স্থান পাওয়া ৫৫টি বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে বাংলাদেশ থেকে চুয়েট ছাড়াও ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) আছে। এছাড়াও ৫৩টি বিশ্ববিদ্যালয়কে আউটস্ট্যান্ডিং বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দিয়েছে সংগঠনটি। এ তালিকায় বাংলাদেশ থেকে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) স্থান পেয়েছে। শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ধারাবাহিক সাফল্যের বিষয় বিবেচনায় নিয়ে এঙিলেন্ট ইউনিভার্সিটির তালিকাটি প্রস্তুত করা হয়।
চুয়েটে প্রথম ‘জাতীয় গবেষণা মেলা’ আয়োজন: চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট) ‘স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে জ্ঞান অন্বেষণ’ স্লোগানে প্রথমবারের মতো ‘গবেষণা মেলা–২০২৩’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। চুয়েটের গবেষণা ও সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে গত ২৮শে আগস্ট ২০২৩ খ্রি. দিনব্যাপী নানা কর্মসূচির মাধ্যমে এই গবেষণা মেলার অনুষ্ঠিত হয়। মেলায় দেশের ৪০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় ৩৫০ জন শিক্ষক, গবেষক, প্রকৌশলী, উদ্যোক্তা, প্রফেশনাল ও শিক্ষার্থীদের মিলনমেলা বসে। যেখানে চূড়ান্তভাবে বাছাইকৃত মোট ১৩১টি গবেষণা প্রবন্ধ (৯৪টি পোস্টার ও ৩৭টি প্রজেক্ট) উপস্থাপন করা হয়।
লেখক: সহকারী রেজিস্ট্রার (সমন্বয়), উপাচার্য মহোদয়ের দপ্তর,
চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।