চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়ক ঘেঁষে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের অবস্থান। এই অভয়ারণ্যটি দক্ষিণ পূর্ব উপমহাদেশের জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ একটি চিরহরিৎ বনাঞ্চল। ভৌগলিক অবস্থানগত কারণে এটিকে সহজেই দেশের সম্ভাবনাময় প্রাকৃতিক পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করা যাবে। ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রকৃতির অপরূপ লীলাভূমি এই চুনতি অভয়ারণ্যের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারছেন না পর্যটকরা। অথচ ইকোপার্ক গড়ে উঠতে পারে ‘ইকুয়েটর’ জয়ী চুনতি অভয়ারণ্যে।
অভয়ারণ্য সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম জেলার লোহাগাড়া, বাঁশখালী ও কক্সবাজার জেলার চকরিয়াসহ ৭টি সংরক্ষিত বনভূমি নিয়ে অভয়ারণ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯২ সালে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের অধীনে প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। বনাঞ্চল সুরক্ষা, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল উন্নয়ন, শিক্ষা, গবেষণা ও চিত্তবিনোদনের সুযোগ সৃষ্টির জন্য ২০০৩ সালে এলাকায় চুনতি ও জলদী রেঞ্জের অধীনে ৭টি বিট অফিস স্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় করার জন্য অভয়ারণ্য এলাকায় বনপুকুর, প্রাকৃতিক গর্জন বনাঞ্চল, এশিয়া বন্যহাতির অবাধে বিচরণ, গয়ালমারা প্রাকৃতিক হ্রদ, বনপুকুর ফুটট্রেইল, জাঙ্গালিয়া ফুটট্রেইল, পর্যটন টাওয়ার, গোলঘর, স্টুডেন্ট ডরমিটরি, নেচার কনজারভেশন সেন্টার, গবেষণা কেন্দ্র, ইকোকর্টেজসহ বিভিন্ন প্রতিবেশ পর্যটন বা ইকো ট্যুরিজম স্থাপন করা হয়। এছাড়া অভয়ারণ্যের উল্লেখযোগ্য প্রাণী এশিয়ান হাতি ছাড়া বন্যশূকর, বানর, হনুমান, মায়া হরিণ, সাম্বার সহ ১৯ প্রজাতির স্তন্যপায়ী ও চার প্রজাতির উভয়চর প্রাণী, সাত প্রজাতির সরীসৃপ, ৫৩ প্রজাতির পাখি এবং ১০৭ প্রজাতির সুসজ্জিত বৃক্ষরাজির সমন্বয়ে গঠিত চিত্রহরিৎ বিশাল বনভূমি।
তবে অভয়ারণ্যের একটি প্রবেশ পথের সাইনবোর্ডে লেখা রয়েছে ৪৬৮ প্রজাতির বন্যপ্রাণী ও ৬৯১ প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে। পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে সহজে অভয়ারণ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যসহ এশিয়ান হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর এবং পাখির অবাধ বিচরণ উপভোগ করা যায়। এতকিছু থাকার পরও অভয়ারণ্যটি এখনো পর্যটন কেন্দ্রের আওতায় আনা হয়নি। তাও আবার এখন সব বন্ধ হয়ে আছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, ২০০৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন এজেন্সির (ইউএসএইড) অধীনে ‘নিসর্গ’ প্রকল্প নামে বন ও বন্যপ্রাণী রক্ষায় কাজ করেন চুনতি অভয়ারণ্যসহ দেশের ২৪টি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যে। ২০১২ সালের ২০ জুন ব্রাজিলের রাজধানী রিওডি জেনিরোতে বিশ্বের ২৫টি দেশকে সম্মানজনক ‘ইকুয়েটর’ পুরস্কার দেয়। চুনতি অভয়ারণ্যের জন্য বাংলাদেশকেও ইকুয়েটর পুরস্কার দেয়া হয়। এই অভয়ারণ্য বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে নিয়ে যায় অনন্য উচ্চতায়। পরবর্তীতে মাত্র ১২ বছরের মাথায় চুনতি অভয়ারণ্য হারিয়েছে তার খ্যাতি ও জৌলুস। ইউএসএইড অধীনে নিসর্গসহ আরো কয়েকটি প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ার সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যায় পর্যটকদের আনাগোনা। অন্যদিকে, অভয়ারণ্যের বুক চিরে তৈরি করা হয়েছে রেলপথ। এই রেলপথ অভয়ারণ্যকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে।
সরেজমিনে দেখা যায়, চুনতি বনপুকুর এলাকার পশ্চিমে একটি ভাঙা সাইনবোর্ড হেলে আছে। সাইনবোর্ডের উপরে লেখা আছে ‘প্রকৃতি ব্যাখা কেন্দ্র’ নিচে আছে ‘চুনতি বন্যপ্রাণী অভায়রণ্য। এর একটু সামনেই জরাজীর্ণ কাউন্টার ও প্রবেশ পথের মূল ফটক। দীর্ঘ ৫ বছর ধরে ঝুলে আছে তালা। চুনতি অভয়ারণ্যের সৌন্দর্য্য উপভোগ করতে পারছেন না পর্যটকরা। অভয়ারণ্যের ভেতরে পর্যটকদের জন্য নির্মিত সব অবকাঠামো ঝরাজীর্ণ হয়ে পড়ে আছে। পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে সহজে অভয়ারণ্যের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যসহ এশিয়ান হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর এবং পাখির অবাধ বিচরণ উপভোগ করা যেত।
স্থানীয় সোহাগ মিয়া বলেন, এক সময় অভায়রণ্যের সৌন্দর্য্য দেখতে শিক্ষার্থীসহ দেশ–বিদেশের অনেক পর্যটকের আনাগোনা ছিল। মহাসড়কের পাশে হওয়ায় যাতায়াত ব্যবস্থাও খুবই ভালো। গবেষণা করার জন্য বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের দেখা যেতো। এখন আর কারো আনাগোনা দেখা যায় না। চুনতি অভয়ারণ্যে ইকোট্যুরিজমের কিছু বিশেষ আকর্ষণ, বিশেষ করে পর্যটন অবকাঠামো তৈরি করলে এটি দেশের অন্যতম ইকোপার্কে পরিণত হবে। যা থেকে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা রাজস্ব আয় করা সম্ভব।
শিক্ষার্থী উম্মে সানজিদা জানান, লোহাগাড়ায় এমনিতে পরিবার–পরিজন নিয়ে ঘুরে বেড়ানোর জন্য পর্যটন এলাকার অভাব। বৃক্ষের সৌন্দর্য্যের সমন্বয়, উঁচু–নিচু পাহাড়ে সৃজিত বাগান আর বাগানে পাখিদের মিষ্টি সুরে মুখরিত অভয়ারণ্যের পর্যটন কেন্দ্রটি দীর্ঘদিন বন্ধ হয়ে আছে। এটি পুনরায় চালু করলে হতে পারে একটি আধুনিক পর্যটন কেন্দ্র ও প্রকৃতি গবেষণাগার। চুনতি বনপ্রাণী অভয়ারণ্য রেঞ্জের রেঞ্জ কর্মকর্তা মাহমুদ হোসেন বলেন, জীববৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বনাঞ্চল নিয়ে গঠিত হয়েছে চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য। গবেষণার জন্য এই অঞ্চল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। পর্যটকদের জন্যও আকর্ষণীয়। প্রকল্প বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বরাদ্দের অভাবে পর্যটনও বন্ধ হয়ে গেছে। পুনরায় চালু করার জন্য কর্তৃপক্ষ অবহিত করেছে।
চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্যের সহ–ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি আনোয়ার কামাল বলেন, আগে দর্শনীর বিনিময়ে বন–জঙ্গলে ঘুরে হাতির পিঠে পড়ে অভয়ারণ্যের সৌন্দর্য উপভোগ করতেন দর্শনার্থীরা। এছাড়া পর্যবেক্ষণ টাওয়ারের মাধ্যমে সহজে
অভয়ারণ্যের হাতি ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ উপভোগ করা যেত। পর্যটকের আনাগোনাও বেশ ভালো ছিল। ২০১৪–২২ সাল পর্যন্ত তৎকালীন সহ–ব্যবস্থাপনা কমিটি ও তৎকালীন অভয়ারণ্যের কর্মকর্তাদের সমন্বয়হীনতা এবং অসহযোগিতার কারণে
ইউএসএইড’র প্রকল্প বন্ধ হয়ে যায়। যার ফলে পরিবেশ বান্ধব পর্যটন বন্ধ হয়ে যায়। এটিকে আধুনিক পর্যটন কেন্দ্রসহ ইকোপার্কে পরিণত করার যথেষ্ট উপাদান রয়েছে। এই ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অবহিত করা হয়েছে। এছাড়া চুনতি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য জীববৈচিত্রের অপূর্ব নির্দশন ও এশিয়ান হাতির প্রাকৃতিক প্রজনন কেন্দ্র। প্রজননের সময় হলে মিয়ানমার, থাইল্যান্ড ও নেপালসহ বিভিন্ন দেশ থেকে হাতিরা এখানে চলে আসে।