চিনিকলের মলিন বদন, দায় কার

অনুপ দাশ গুপ্ত | বৃহস্পতিবার , ৭ জানুয়ারি, ২০২১ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

চিনি শিল্পের মূল উপাদান বা কাঁচা মাল হলো আখ। আখ একটি পরিবেশ বান্ধব উদ্ভিদ। বায়ুমণ্ডল থেকে অধিক কার্বনডাই-অঙাইড শোষণ করে বাতাসের তাপমাএা নিয়ন্ত্রণে এ ফসলটির রয়েছে বিরাট ভূমিকা। আখের ছোবড়া ও মোথা গ্রামে-গঞ্জে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। রাষ্ট্রায়ত্ত ১৫ টি চিনিকলের মধ্যে ছয়টি চিনিকল বন্ধ করে দেয়া হয়, পূর্ব ঘোষণা ও পরিকল্পনা ছাড়াই হঠাৎ করে। এই সব চিনিকলগুলো বন্ধের ফলে আখ নিয়ে আখা চাষীদের ভাগ্যে যে চরম দুর্ভোগ ও কালো মেঘ নেমে এসেছে তাতে আর্থিক ক্ষতির কথা বলে শেষ করা যাবে না। উওরাঞ্চণে রাষ্ট্রায়ত্ত এই ছয়টি চিনিকল বন্ধের কারণে ধারণা করা হচ্ছে আখের আবাদ একেবারে বন্ধ হয়ে যাবে। যার মারাত্মক প্রভাব পড়বে ওই অঞ্চলের পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের ওপর। আখ একটি প্রচণ্ড ঘাতসহনীয় উদ্ভিদ হওয়াতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রতিকূল প্রভাব মোকাবিলায় এর সক্ষমতা রয়েছে অন্য ফসলের চেয়ে বেশি। বন্যা, খরা ও জলোচ্ছ্বাসেও ফসলটি কৃষককে নিরাশ করে না। অনেকেরই মনে থাকবে ১৯৮৭ ও ১৯৮৮ সালের ভয়াবহ বন্যার সময় উত্তরাঞ্চলে ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট ও ফসলের মাঠ তলিয়ে গিয়েছিল, কৃষকদের বাঁচার কোন উপায় ছিল না, তখন বন্যার ঘোলাজলে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল আখ। বন্যা শেষ হয়ে যাবার পর এই আখ বিক্রি করেই উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা তাদের ঘর-বাডি মেরামত থেকে আরম্ভ করে বরি ফসলের চাষের মাধ্যমে জীবন বাঁচিয়েছিল। পত্রপত্রিকার খবরের মাধ্যমে জানা যায়, চিনিকল এলাকায় আখমাড়াই বন্ধ করার প্রতিবাদে জিল্লুর রহমান নামে এক আখচাষি তার ক্ষেতের আখ পুড়িয়ে ফেলেছেন। সেই আখ পোড়ানোর ছবিও পত্রিকায় আমরা দেখেছি। ওই চাষির যুক্তি হলো রংপুর চিনিকলের চেয়ে ছোট জয়পুর হাটের চিনিকলে আখ দিতে গেলে জমিতেই আখ শুকিয়ে যাবে। ছয়মাসেও তারা আখমাড়াই করতে পারবে না। ফলে ধানের আবাদও করা সম্ভব হবে না। এই রকম নির্মম ঘটনা থেকে বোঝা যায় বন্ধ হওয়া মিল এলাকার আখ চাষিরা কী রকম এক ভয়ানক দুরবস্থার মধ্যে আছে। এর দায় কি সরকার ও বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্যশিল্প কর্পোরেশন (বিএসএফআইসি) এড়াতে পারেন? এই ছয়টি চিনিকল বন্ধের জন্য কি আখচাষিরা দায়ী, কোনভাবেই নয়। সরকার লোকসানের কথা বলে একের পর এক রাষ্ট্রায়ত্ত কারখানা গুলো বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু এ লোকসানের প্রকৃত কারণ অনুসন্ধান করলে দেখা যাবে, এর জন্য দায়ী হলো অতি দুর্বল নেতৃত্ব, অতি দুর্বল ও দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যবস্থাপনা এবং চিনিকলগুলোকে আধুনিকায়ন করার প্রতি চরম উদাসীনতা। চরম ভ্রান্তনীতি ও সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতৃত্বের চরম ব্যর্থতার ফসল হলো আজকের এই রাষ্ট্রায়ত্ত চিনি কলগুলোর বিষণ্ন বদন। অথচ বেসরকারি খাতের ব্যবস্থাপনায় চালু রাখা চিনিকল গুলো কিন্তু ক্রমবর্ধমান লাভ করেই চলছে। তাহলে একদেশে দুই ব্যবস্থাপনার অধীনে থাকা চিনিকলগুলোর চিত্র দুই ধরনের কেন? দীর্ঘদিন ধরে আখচাষিরা আখের ন্যায্যমূল্য না পাওয়া, আখ বিক্রি করতে গিয়ে নানাভাবে হয়রানি, প্রতারণার শিকারের কারণে আখ উৎপাদন ব্যবস্থাকে নিরুৎসাহিত করেছে। চিনিকলগুলোর পুরনো যন্ত্রপাতি, মিলের অভ্যন্তরে দুর্নীতি ও সুষ্ঠু চিনি নীতির অভাবকেও চিনি শিল্পের এই চরম দুরবস্থার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা যায়। স্বাধীনতার এখন ৫০ বছর চলছে অথচ এতদীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও চিনি শিল্পের আধুনিকায়ন করে অভ্যন্তরীণ জনগণের চাহিদা মেটানোর জন্য এরকম লাভজনক খাতকে উন্নত করার কোন আন্তরিক ও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে আমরা দেখিনি। এও এক বেদনাদায়ক অধ্যায়। আরও আছে চিনি আমদানি উদারীকরণ নীতি ও পণ্যের বহুমুখীকরণের জন্য কার্যকর পদক্ষেপের ঘাটতি। পৃথিবীর প্রতিটি শিল্পকে দীর্ঘদিন ধরে লাভজনক করে চালানোর জন্য আছে উৎপাদন প্রক্রিয়ার আধুনিকীকরণ নীতি, কারণ তা না হলে পুঁজিবাদী বিশ্বের প্রতিযোগিতাশীল বাজারে বেশি দামে পণ্য বিক্রি করে টিকে থাকা যায় না। লক্ষ্য করা গেছে দেশীয় চিনি শিল্পের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় শিল্পের আধুনিকীকরণ নীতি বলতে কিছুই নেই এবং কখনো ছিলও না। উল্লেখ করা যায়, ভারতের প্রয়াত রাষ্ট্রপতি এপিজে আবদুল কালামের লিখিত -‘গভার্নেন্স ফর গ্রোথ ইন ইন্ডিয়া’ গ্রন্থের কথা। এই গ্রন্থটিতে তিনি লিখেছেন, ‘সৃষ্টিশীল নেতৃত্বই একটা স্বচ্ছ ব্যবস্থাপনা ও দূরদর্শী নীতি (পলিসি) গ্রহণ করতে পারে, সেটা শিল্পের উৎপাদন ব্যবস্থায় হোক বা দেশ পরিচালনার ক্ষেত্রে হোক’। আবার তিনি এই গ্রন্থের আরেকটি অধ্যায়ে বলেছেন, ‘পাবলিক অডিট এবং গুড গভার্নেন্স না থাকলে যে কোন উৎপাদনমুখী শিল্প কলকারখানা অলাভজনক হওয়ার সম্ভাবনা শতভাগ’। সরকারি সবকটি চিনিকলের উৎপাদিত চিনি বাজার দরের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দামে উৎপাদিত হচ্ছে। যার ফলে বিগত ৫ বছরে ৩ হাজার ৯৭৬ কোটি টাকা লোকসান গুণতে হয়েছে চিনি শিল্প করপোরেশনকে (দৈনিক দেশরূপান্তর, ৬ ডিসেম্বর )। ২০১৯-২০ অর্থ বছরে এই লোকসানের পরিমাণ ছিল ৯৭০ কোটি টাকা। এছাড়াও ৭৮৯৫ কোটি টাকা ঋণের বোঝাও রয়েছে চিনি শিল্প করপোরেশনের ওপর। কিন্তু কথা হলো কেন এই বোঝা? এক শিল্প গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশে সুগারবিট থেকে চিনি উৎপাদন কোনো কালেই সফল হয়নি। তারপরও ঠাকুরগাঁও সুগার মিলে সুগারবিট ভিত্তিক প্রকল্প গ্রহণ করেছেন সরকার, যা সত্যিই অর্থহীন। ভারতে দৈনিক ১৫০০ টন মাড়াই ক্ষমতা সম্পন্ন চিনিকল যেখানে চালানো হয় ৩০০ থেকে ৪০০ শ্রমিক দিয়ে, সেখানে বাংলাদেশে একই মাড়াই ক্ষমতা সম্পন্ন মিল চালানো হয় একহাজার বা বারোশ শ্রমিক দিয়ে (গবেষণা জার্নাল : অ্যা স্টাডি অন ইকোনমিক ইন্সপেক্ট অব সুগার প্রোডাকশন ইন তামিলনাডু)। তাহলে প্রশ্ন থেকেই যায় এত অপচয়ের মাধ্যমে চিনি কলগুলো কীভাবে লাভজনক হবে? নব্বুইয়ের দশকের দিকে বিশ্বের বিখ্যাত শিল্প গবেষক ও লীন গুরু জেমস পি. ওম্যাক, ড্যনিয়াল টি.জেনস এবং ড্যনিয়াল রুস একটি আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ লিখেছিলেন শিল্প কলকারখানার উৎপাদন পদ্ধতির ক্রমাগত উন্নয়ন বিষয়ে, গ্রন্থটি হলো, ‘দ্য মেশিন দ্যাট চেইঞ্জ দ্য ওয়ার্ল্ড ‘-এই অসাধারণ গ্রন্থটিতে তারা মিল কলকারখানার উৎপাদন ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিগত উন্নয়ন সম্পর্কে বিস্তারিত বলেছেন, ‘উৎপাদন প্রক্রিয়ায় মেশিন,কার্যপদ্ধতি ও কর্মীদের উন্নত প্রযুক্তিগত সর্বাধুনিক নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও নতুন নতুন দক্ষতার আত্মস্তকরণই হতে পারে কমমূল্যে মানসম্মত পণ্যের উৎপাদন এবং ওই শিল্পের একমাত্র টিকে থাকার হাতিয়ার’। যা সত্যিকার অর্থে পুঁজিবাদী বিশ্বের বাণিজ্য ব্যবস্থায় নিগূঢ়ভাবে প্রমাণিত। জলাবদ্ধ কৃষি ক্ষেত্র থেকে মালেশিয়াকে শিল্পের শক্তি কেন্দ্র রূপে রূপান্তরকারী আধুনিক মালেশিয়ার রূপকার ‘তুন ডা. মাহাথির মোহামাদের স্মৃতিকথামূলকগ্রন্থ ‘এ ডক্টর ইন দ্যা হাউস’-এ শিক্ষা থেকে আন্তর্জাতিক শিল্প বাণিজ্যে অধ্যায়ে তিনি বলেছেন, ‘আমি নেতৃত্বে বিশ্বাস করি নজির সৃষ্টির দ্বারা। অনেকেই ব্যবসার উদ্দেশ্যে টাকা ধার করে কিন্তু তার অর্ধেক কাজে লাগায় ব্যবসায়ে, এতে সুদের হার দ্বিগুণ হয়ে যায় আর শিল্প বা ব্যবসা টিকিয়ে রাখা যায় না। তাই আমি যে কোন জায়গা থেকে আইডিয়া ধার নিতেও প্রস্তুত ছিলাম যাতে শিল্প কলকারখানার প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে শিল্পকে লাভজনক করা যায়, কারণ শিল্প কলকারখানার উন্নয়নই হলো দেশকে উন্নত করার মূল চাবিকাঠি’ ( পৃ:৬৩)।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষক শ্রমিক মেহনতি মানুষকে প্রবল ভালবাসতেন তাই তিনি ১৯৭২ সালে সব চিনিকল গুলোকে জাতীয়করণ করেন শ্রমিক ও আখচাষীদের ভাগ্য বদলানোর নিমিত্তে কিন্তু সেই স্বপ্ন এখন দুঃস্বপ্নে পরিণত হলো। এখন আখচাষী ও চিনিকল শ্রমিকদের পথে প্রান্তরে বিক্ষোভ মিছিল ও আন্দোলন করতে হচ্ছে তাদের জীবন ও জীবিকা রক্ষার জন্য। ডিসেম্বর মাসের ২১ ও ২৪ তারিথে ছয়টি বন্ধ চিনিকল খুলে দেওয়ার দাবিতে পাবনার ঈশ্বরদী, ঝিনাইদহ, পঞ্চগড়সহ গাইবান্ধার মহিমাগঞ্জের রংপুর চিনি কলের শ্রমিকরা হরতাল করেছেন (প্রথমআলো: ২৫ ডিসেম্বর’২০) ।
অত্যন্ত দুঃখজনক হলেও সত্য আখ কাটার ভরা মৌসুমে রাষ্ট্রীয়ত্ত চিনিকল গুলো বন্ধের ঘোষণা সত্যিই বেদনাদায়ক। চিনিকল গুলোকে আধুনিকায়ণ করে এবং বহুমুখী উৎপাদনে নিয়ে চিনির পাশাাপাশি উপজাত পণ্যও উৎপাদন করা, যা আমরা ইতোমধ্যে দর্শনা চিনিকলে দেখেছি লাভজনক হয়েছে। তাই চিনিকল বন্ধের সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করে একটি বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে অতিদ্রুত চিনিকল গুলোকে আধুনিকায়ণের আওতায় এনে লাভজনক করা ছাড়া অন্য কোন পথ খোলা নেই এতগুলো মানুষের জীবন ও জীবিকা বাঁচানোর।
লেখক : প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধ‘প্রতিটি কৃষ্ণাঙ্গ শিশু স্বপ্নের এক নতুন দিগন্ত খুঁজে পাবে’
পরবর্তী নিবন্ধটেস্ট র‌্যাংকিংয়ে আফগানিস্তানের নিচে নেমে গেল বাংলাদেশ