বলেছিলে তাই চিঠি লিখে যাই, কথা আর সুরে সুরে
মন বলে তুমি রয়েছ যে কাছে, আঁখি বলে কত দূরে!
কালজয়ী বাংলা গানের শিল্পী জগন্ময় মিত্রের ১৯৪৮ সালে রেকর্ড করা গান “চিঠি–তুমি আজ কত দূরে” তাকে যেমন সংগীত পিপাসুদের কাছে জনপ্রিয় করে তুলেছিল, এনে দিয়েছিল গানের জগতে প্রতিষ্ঠা, তেমনি লক্ষ কোটি শ্রোতা, রোমান্টিকতায় আচ্ছন্ন হয়ে গানটির সাথে যেন একাত্ম হয়ে পড়েন।
বস্তুত ৩০ বছর আগেও চিঠি ছিল দূরের কারো সাথে যোগাযোগের সবচেয়ে বিশ্বস্ত মাধ্যম। তখন হাজারো ভিড়ের মাঝে মনের জমানো অব্যক্ত ভাব প্রকাশে প্রিয়জনের জন্য লেখা চিঠির প্রয়োজনীয়তা ছিল অনস্বীকার্য। বর্তমান সময়ের মতো আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা তো তখন ছিল না। তাই প্রয়োজনের জন্যই রচিত হতো চিঠি। কত নান্দনিক ছিল তার ভাষা! কত কথা! যা মুখে প্রকাশ করতে ছিল দ্বিধা, তাই সহজে প্রকাশ করা গেছে চিঠি লিখে। বর্ণে বর্ণে মূর্ত হয়ে উঠত কথকতা।
এক একটি চিঠিতে কতকিছু লেখা হতো। থাকতো পত্র প্রেরকের হাসি, আনন্দ, সুখ, দুঃখ, আবেগ, অনুভূতি, বেদনা, প্রেম, ভালবাসা, নিজের মনের ভাব প্রকাশ! জানতে চাইতো পত্র গ্রাহকের কুশল এবং আনুষঙ্গিক সবকিছু। চিঠি পাঠিয়ে যতক্ষণ না উত্তর মিলছে, ততক্ষণ যেন স্বস্তি নেই। মনের কোনের জমানো উৎকন্ঠা যাচ্ছেই না! এছাড়াও উৎসব অনুষ্ঠানে একে অপরকে শুভেচ্ছা বিনিময়ের অন্যতম অঙ্গ ছিল এই পত্র লেখা।
কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য রানার কবিতায় লিখেছেন–
‘‘কত চিঠি লেখে লোকে,
কত সুখে, প্রেমে, আবেগে স্মৃতিতে, কত দুঃখ ও শোকে।’’
যুগ পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের রুচি ও অভ্যাসের পরিবর্তন এলো। অবিশ্বাস্য গতির ই–মেইল, ম্যাসেঞ্জাার, হোয়াটসএ্যাপ, ভাইবার, ইন্সট্রাগ্রামসহ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের আরো এমন বহু এ্যাপের মাধ্যমে হারিয়ে গেলো কাগজ এবং কলমে লেখা চিঠির আবেদন।
প্রযুক্তির বিবর্তনের সঙ্গে তাল মেলাতে না পেরে চিঠি এখন একরকম ‘নাই’ হয়ে গেছে। চিঠি আর কেউ লিখে না! চিঠির ঝোলা কাঁধে ঝুলিয়ে ডাকপিয়নের ডাকও আর শোনা যায় না। রাস্তার মোড়ে মোড়ে লালরঙা চিঠির বাক্সগুলোও এখন আর তেমন দেখা যায় না। অথচ জরাজীর্ণ এই বাক্সগুলো একসময় ছিল অনুভূতি আর আবেগের আধার। দূরে থাকা নিকট জনের কাছে খবর পৌঁছানোর অন্যতম যোগসূত্র। ঘরের দরজায় ডাক পিয়নের সাইকেলের বেল শোনার প্রতীক্ষায়ও আর কেউ থাকে না। কুরিয়ার সার্ভিস এসে তাদের সরিয়ে দিয়েছে।
এখনও চিঠি আসে। তবে যে চিঠি এখন আসে তার অধিকাংশই আনুষ্ঠানিক। বলা যায়, দাপ্তরিক পত্র। বিদ্যালয়গুলোতে ছাত্রছাত্রীদের চিঠি লেখার নিয়ম শিখানো হয়। তবে এই চর্চা এবং এর অনুশীলন শুধুই পরীক্ষায় নম্বর বাড়ানোর জন্য। কিন্তু বাস্তবে চিঠি লেখা আর হয় না। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সংক্ষিপ্ত পরিসরেই যাবতীয় প্রয়োজন পূরণ হয়। সেখানে ভাষার ব্যবহারের প্রয়োগ অপ্রতুল। থাকে না আবেগ। চিঠি লেখার জন্য ‘শ্রদ্ধেয়’, ‘প্রিয়’, ‘ স্নেহের’–এমন মমতামাখা শব্দগুলি আর ব্যবহৃত হয় না। চিঠির শেষে ‘ইতি’ ব্যবহৃত হয়, তাও আজ আর অনেকেই হয়তো জানে না। যারা শিখেছিলাম, তারাও ভুলে গেছি। কেউ আর কাউকে বলে না, লিখে না, ‘বাড়ি ফিরে চিঠি লিখো। তোমার চিঠির অপেক্ষায় থাকবো’।
একটু একটু করে ধীরে ধীরে চিঠির গুরুত্ব চিরতরে হারিয়ে গেছে। একটা সময় পরে চিঠি থাকবে শুধু ইতিহাসের পাতায়। হয়তো বা যাদুঘরে! আজ কেউ চিঠি লিখে না, কেউ বই পড়ে না, কোনো বার্তা পৌঁছানোতে কাউকে ধৈর্য্য নিয়ে অপেক্ষা করতে হয় না। আধুনিকতার নাগপাশে আবদ্ধ সবকিছু খুব দ্রতলয়ে চলছে। আপনি অতীতকে আঁকড়ে ধরেছেন, তো আপনি পিছিয়ে পড়েছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছিন্নপত্রে’ চিঠির সম্পর্কে বলেছিলেন, ‘পৃথিবীতে অনেক মহামূল্য উপহার আছে, তার মধ্যে সামান্য চিঠিখানি কম জিনিস নয়। চিঠির দ্বারা পৃথিবীতে একটা নতুন আনন্দের সৃষ্টি হয়েছে। আমরা মানুষকে দেখে যতটা লাভ করি, তার সঙ্গে কথাবার্তা কয়ে যতটা লাভ করি, চিঠিপত্র দ্বারা তার চেয়ে আরো একটা বেশি কিছু পেয়ে থাকি। আমার মনে হয়, যারা চিরকাল অবিচ্ছেদে চব্বিশ ঘণ্টা কাছাকাছি আছে, যাদের মধ্যে চিঠি লেখালেখির অবসর ঘটেনি, তারা পরস্পরকে অসম্পূর্ণ করেই জানে।’
এখনও কেউ হয়তো আপনার কথাই ভাবছে। কিন্তু তার সেই ভাবনা, চিঠিতে লিখে আপনাকে জানানো হয় না। আপনিও হয়তো আপনার প্রিয় মানুষটি হতে একটা চিঠির অপেক্ষা করে আছেন। কিন্তু যার কাছে আশা করছেন, তার আর আপনাকে চিঠি লিখে, সময় নষ্ট করার মতো সময় হয় না। “আমি ভাল আছি, তুমিও ভাল থেকো”! দূরে থাকা, কাছে থাকা অথবা পাশাপাশি–কাছাকাছি থেকেও দূরে মনে হওয়া প্রতিটি প্রিয় মানুষের জন্য স্নেহ এবং ভালবাসায় ভরা এমন একটি চিঠি, আজকের কঠিন, নিষ্ঠুর, অসুস্থ ও অসৎ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এই পৃথিবীতে সবারই বোধহয় খুব প্রয়োজন!
জগন্ময় মিত্রের সেই ঐতিহাসিক গানটি দিয়েই এ লেখার ইতি টানছি।
যাবার বেলায় হাত দুটি ধরে
বলেছিলে, চিঠি দিও
বলেছিলে তুমি চিঠি দিও মোরে
দূর থেকে তাই গানের লিপিকা লিখে যাই গো
লিখে যাই সুরে সুরে।
তুমি আজ কত দূরে?
জয়া
বুধবার
১৪/০৫/২০২৫