চিকুনগুনিয়া : ব্যক্তিগত সতর্কতা ও মশা প্রতিরোধটাই জরুরি

| বৃহস্পতিবার , ২৫ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ১০:৫৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক) ও এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ এন্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (এআরএফ)- এর যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত এক গবেষণায় বলা হয়েছে, চট্টগ্রামে প্রাপ্ত বয়স্ক (২৬ থেকে ৬০ বছর), শিক্ষিত এবং শহরের লোকজন বেশি আক্রান্ত হচ্ছেন মশাবাহিত রোগ চিকুনগুনিয়ায়। নগরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি কোতোয়ালী থানা এবং উপজেলার মধ্যে সীতাকুণ্ডের বাসিন্দা বেশি আক্রান্ত হয়েছেন। বিপরীতে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছেন ১৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী জনগোষ্ঠী। একইসঙ্গে শহরাঞ্চলের মানুষ গ্রামাঞ্চলের তুলনায় অধিক ডেঙ্গুর ঝুঁকিতে রয়েছে। তবে ডেঙ্‌গু ও জিকার সাথে চিকুনগুনিয়ার একসাথে সংক্রমণ পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলছে। ‘চট্টগ্রামে ডেঙ্গু, জিকা ও চিকুনগুনিয়া সংক্রমণের সার্বিক পরিস্থিতি, জনস্বাস্থ্যে প্রভাব, চিকিৎসা পদ্ধতি এবং ভাইরাসের জিনোমের স্বরূপ উন্মোচন’ শীর্ষক গবেষণাটি পরিচালিত হয় চলতি বছরের ১ মে থেকে ১৫ ডিসেম্বর। নগর ও আশেপাশের উপজেলার ১ হাজার ১০৯ জন চিকুনগুনিয়া রোগী ও ১ হাজার ৭০৯ জন ডেঙ্গু রোগীর ক্লিনিক্যাল, জনস্বাস্থ্য, রোগতত্ত্ব ও জেনেটিক তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়েছে গবেষণায়। গত রোববার দুপুরে নগরের থিয়েটার ইনস্টিটিউটে গবেষণার সার সংক্ষেপ উপস্থাপন করেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হেসেন। গবেষণায় নেতৃত্ব প্রদান করেন চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের চিকিৎসক ডা. এইচ এম হামিদুল্লাহ মেহেদী, রেলওয়ে জেনারেল হাসপাতালের চিকিৎসক ডা. আবুল ফয়সাল মোহাম্মদ নুরুদ্দিন এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং এন্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. আদনান মান্নান। গবেষকরা জানিয়েছেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম অঞ্চলে চিকুনগুনিয়া দ্রুত বিস্তারমান একটি মশাবাহিত ভাইরাসজনিত রোগ হিসেবে গুরুতর জনস্বাস্থ্য চ্যালেঞ্জে রূপ নিয়েছে। এই রোগ কেবল স্বল্পমেয়াদি জ্বরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়; বরং দীর্ঘস্থায়ী অস্থিসন্ধির ব্যথা, কর্মক্ষমতা হ্রাস এবং উল্লেখযোগ্য অর্থনৈতিক ক্ষতির কারণ হয়ে উঠছে। তাঁরা বলছেন, চিকুনগুনিয়া এখন আর কেবল একটি সাময়িক জ্বরের রোগ নয়; এটি একটি দীর্ঘমেয়াদি জনস্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক সংকটে পরিণত হয়েছে। শুধুমাত্র ডেঙ্গুকেন্দ্রিক নিয়ন্ত্রণ কৌশল দিয়ে এই রোগ মোকাবিলা সম্ভব নয়।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, বয়স্করা চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে যথেষ্ট ঝুঁকির সম্ভাবনা থাকে। যাদের ক্রনিক রোগ রয়েছে, বিশেষ করে ডায়াবেটিস, কিডনি, লিভার, হৃদরোগ, ক্যান্সার, হাঁপানি ইত্যাদি, চিকুনগুনিয়া হলে তারাই মূলত হাই রিস্কের মধ্যে থাকেন। বয়োবৃদ্ধদের রোগ প্রতিরোধ ও সহ্য করার ক্ষমতা অনেক কম। তাদের চিকুনগুনিয়া হলে গিরায় গিরায় যে প্রচণ্ড ব্যথা হয় তার ধকল সামলানো কঠিন হয়ে পড়ে। যদিও আলাদা চিকিৎসা নেই, তবুও চিকুনগুনিয়ায় আক্রান্ত হলে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া উচিত এবং প্রয়োজনে হাসপাতালে ভর্তি হতে হবে। তারা যেন শুধু প্যারাসিটামল খেয়ে ঘরে শুয়ে না থাকেন।

খোদ সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছেন, ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়ার প্রকোপ শুধু স্বাস্থ্যঝুঁকিই নয়, এটি জনস্বাস্থ্য ও নগর ব্যবস্থাপনার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে নীতিনির্ধারণ, ওয়ার্ডভিত্তিক পরিকল্পনা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের ওপর জোর দিয়ে তিনি বলেন, মশার প্রজননস্থল, মৌসুমি ও জলবায়ুগত প্রভাব, নগরের অবকাঠামো এবং মানুষের আচরণ, এসব বিষয় বৈজ্ঞানিকভাবে বিশ্লেষণ না করলে মশক নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম দীর্ঘমেয়াদে সফল হবে না।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, চিকুনগুনিয়া জ্বরের কোন প্রতিষেধক, ভ্যাকসিন বা টিকা এখনও আবিষ্কার হয়নি। এই রোগ থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রতিরোধের গুরুত্বটাই বেশি। রোগ থেকে উদ্ধার পাওয়ার একটাই উপায় মশার কামড় থেকে নিজেকে রক্ষা করা এবং এডিস মশার বংশ বিস্তার রোধ করার জন্য মশার আবাসস্থল এবং আশপাশের প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করা। অর্থাৎ ব্যক্তিগত সতর্কতা এবং মশা প্রতিরোধটাই জরুরি।

আসলে মশা নামক ক্ষুদ্রে এ প্রাণীটি মহানন্দে তার বংশবৃদ্ধি করছে এবং বেশ দাপটের সঙ্গেই চিকুনগুনিয়া রোগটি ছড়াচ্ছে সর্বস্তরে। শিশুবৃদ্ধ, ধনীগরিব, পেশাজীবীডাক্তারসাংবাদিকশ্রমিকএক কথায় সব শ্রেণীর মানুষ কারোরই ছাড় নেই, সবাই আক্রান্ত হচ্ছেন। রোগটি নতুন হলেও আতঙ্কিত হবার কিছু নেই। এতে কেউ মারা যায় না। হয়তোবা কিছুদিন ভোগায়। তবে জীবনবিধ্বংসী না হলেও রোগটিকে হেলাফেলা করা উচিত নয়। একটু সচেতন হলেই মোকাবেলা করা সম্ভব।

পূর্ববর্তী নিবন্ধ৭৮৬
পরবর্তী নিবন্ধএই দিনে