করোনা রোগীর চিকিৎসায় প্রস্তুতি হিসেবে মার্চ মাসের শুরুর দিকে নগরের দুটি হাসপাতাল নির্ধারণ করে করোনা মোকাবেলায় গঠিত জেলা পর্যায়ের কমিটি। চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসক এই কমিটির সভাপতি আর সিভিল সার্জন সদস্য সচিব। কমিটির নির্ধারণ করা দুটি হাসপাতালের একটি চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, অপরটি ফৌজদারহাটের বিআইটিআইডি। নির্ধারণের পর বিআইটিআইডিতে ৫০ এবং জেনারেল হাসপাতালে ১শটি আইসোলেশন শয্যা প্রস্তুতের কথা জানায় স্বাস্থ্য বিভাগ। সিদ্ধান্ত অনুসারে ১৯ মার্চ থেকে করোনা রোগী ও সন্দেহজনক রোগী ভর্তি শুরু করে চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল। শুরুতে ১শ শয্যা নির্ধারণ করা হলেও পরবর্তীতে আরো ৫০ শয্যা বাড়িয়ে হাসপাতালটির আইসোলেশন শয্যা দেড়শতে উন্নীত করা হয়। করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতাল হিসেবে চিকিৎসা কার্যক্রম শুরুর পর থেকে গত ৬ মাসে ১২শ রোগী চিকিৎসা নিয়েছে এ হাসপাতালে। এসব রোগীদের চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে এখন পর্যন্ত হাসপাতালটিতে সরকারি খরচের অংক দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। যদিও এসব খরচের সিংহভাগই চিকিৎসক-স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা-খাওয়া বাবদ ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ।
রোগী ও চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য : হাসপাতাল সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী- করোনা রোগীর চিকিৎসা কার্যক্রম শুরুর প্রথম মাসে (১৯-৩০ মার্চ) ৩৮ জন রোগী ভর্তি হয় এ হাসপাতালে। এপ্রিল মাসে ভর্তি হয় ৯৬ জন। সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ৩৩১ জন রোগী ভর্তি হয় মে মাসে। জুনে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা ছিল ৩২৫ জন। জুলাই ও আগস্ট মাসে ভর্তিকৃত রোগীর সংখ্যা যথাক্রমে ১৯৩ ও ১৪৫ জন। আর চলতি মাসের ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ৫২ জন রোগী ভর্তি হয় এখানে।
সব মিলিয়ে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ১ হাজার ১৮০ জন রোগী এই হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন। গতকাল পর্যন্ত হিসেব করলে রোগীর এ সংখ্যা ১২শর কম নয়। চিকিৎসা নিতে আসা এসব রোগীর মধ্যে সুস্থ হয়ে হাসপাতাল ছেড়েছেন ৬৮০ জন। মৃত্যু হয়েছে ১৫৮ জনের। আর চিকিৎসকের রেফার করা, পলাতক ও স্বেচ্ছায় হাসপাতাল থেকে চলে যাওয়া রোগীর সংখ্যা ৩৪২ জন। এই হিসাবের বাইরে আরো ৫ হাজার ৭৩৩ জন রোগী হাসপাতালের ফ্লু কর্ণার থেকে চিকিৎসা সেবা নিয়েছেন।
সর্বশেষ গতকাল হাসপাতালটির করোনা ওয়ার্ডে ২২ জন এবং আইসিইউতে ৬ জনসহ মোট ২৮ জন রোগী চিকিৎসাধীন বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের করোনা টিমের ফোকাল পারসন ডা. আব্দুর রব মাসুম।
সরকারি বরাদ্দ ও খরচ : পরবর্তীতে করোনা ডেডিকেটেড হিসেবে প্রস্তুত করা হলি ক্রিসেন্ট ও রেলওয়ে হাসপাতালের খরচ নির্বাহের দায়িত্বভারও জেনারেল হাসপাতাল প্রশাসনের ওপর ন্যস্ত করে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। জেনারেল হাসপাতাল প্রশাসনের কাছে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী-এই তিনটি হাসপাতালের খরচ বাবদ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে প্রথম দফায় (জুনের আগে) মোট ১ কোটি ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়। তবে এই অর্থ খরচের সময়সীমা ছিল জুন পর্যন্ত।
প্রথম দফায় প্রাপ্ত বরাদ্দের মাঝে ৭০ লাখ টাকা খরচ করতে পারলেও বাকি ৪০ লাখ টাকা সরকারি কোষাগারে ফেরত পাঠানো হয় বলে জানান জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ। প্রথম দফায় খরচ হওয়া ৭০ লাখ টাকার মধ্যে রেলওয়ে হাসপাতালে ২৪ লাখ ৪৮ হাজার টাকা ও হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে সাড়ে ৫ লাখ টাকা ব্যয় হয়। অর্থাৎ এই দুটি হাসপাতালে খরচের অংক প্রায় ৩০ লাখ টাকা। সে হিসেবে প্রথম দফায় জেনারেল হাসপাতালের খরচ দাঁড়ায় ৪০ লাখ টাকা।
তবে জুন পরবর্তী সময়ে এই তিন হাসপাতালের খরচ বাবদ আরো ৯০ লাখ টাকার চাহিদাপত্র ঢাকায় পাঠানো হয়েছে বলে নিশ্চিত করেছেন ডা. অসীম কুমার নাথ। এর মধ্যে রেলওয়ে হাসপাতালের খরচ বাবদ প্রায় ১৫ লাখ টাকা এবং হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের খরচ বাবদ সাড়ে ৫ লাখ টাকাসহ দুটি হাসপাতালের জন্য মোট ২০ লাখ টাকার চাহিদা পাঠানোর কথা জানান তিনি। সে হিসেবে বাকি প্রায় ৭০ লাখ টাকা চাওয়া হয়েছে জেনারেল হাসপাতালের খরচ বাবদ।
হিসেবে দেখা যায়- এ পর্যন্ত জেনারেল হাসপাতালের খরচের অংক দাঁড়িয়েছে ১ কোটি ১০ লাখ টাকা। অবশ্য এই খরচে রেলওয়ে হাসপাতালের জন্য ওষুধ বাবদ ২-৩ লাখ টাকা এবং হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালের জন্য প্রিন্টার, স্ক্যানার ও ইউপিএসসহ একটি কম্পিউটার ক্রয় বাবদ আনুমানিক ৫০ হাজার টাকা অর্ন্তভুক্ত রয়েছে বলে জানিয়েছে জেনারেল হাসপাতাল প্রশাসন।
খরচ কোন খাতে : জেনারেল হাসপাতালে করোনা রোগীদের চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত ১২০ জন চিকিৎসকসহ প্রায় চার শতাধিক স্বাস্থ্যকর্মীর থাকা-খাওয়ার খরচ নির্বাহে সিংহভাগ অর্থ ব্যয় হয়েছে বলে জানিয়েছেন হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. অসীম কুমার নাথ। এর মধ্যে কেবল চিকিৎসকদের থাকা বাবদ মোটেল সৈকতের বকেয়া বিল রয়েছে ৩২ লাখ টাকা। যা পরবর্তীতে ঢাকায় পাঠানো চাহিদাপত্রে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে বলে জানান তিনি।
প্রসঙ্গত, করোনা চিকিৎসা সেবায় নিয়োজিত চিকিৎসক-নার্স ও অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীদের পরিবার থেকে আলাদা রাখার প্রয়োজনে হোটেল বা সরকারি প্রতিষ্ঠানে রাখার সিদ্ধান্ত হয়। টানা দশদিন করোনা ওয়ার্ডে কর্তব্য পালনের পর চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের ১৪ দিন কোয়ারেন্টাইনে থাকার নিয়ম চালু করা হয়। আলাদা বা কোয়ারেন্টাইনে রাখতে চট্টগ্রামের বেশক’টি হোটেলকে বেছে নেয়া হয়। এর মধ্যে মোটেল সৈকতও একটি। যদিও স্বাস্থ্যকর্মীদের থাকা বাবদ হোটেলগুলোকে কেবল ইউটিলিটি বিল প্রদানের নির্দেশনা দেয় মন্ত্রণালয়। অন্যদিকে, বিভিন্ন ক্যাটারিং সার্ভিসের মাধ্যমে চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের খাবারের ব্যবস্থা করা হয় বলে সংশ্লিষ্টরা জানান।
চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবল : প্রথম দিকে তুলনামূলক কম সংখ্যক চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মী দিয়ে কার্যক্রম শুরু হয় জেনারেল হাসপাতালের। তবে পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থান থেকে প্রেষণে চিকিৎসক ও অন্যান্য জনবল এই হাসপাতালে পদায়ন করা হয়। করোনা রোগীদের চিকিৎসায় হাসপাতালটিতে ১২০ জন চিকিৎসক, ২১৭ জন নার্স ছাড়াও ৬২ জন ৩য় ও ৪র্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োজিত করা হয়। এর বাইরে আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে নিয়োগ পাওয়া আরো ৩৬ জন কর্মচারী রয়েছে হাসপাতালটিতে। হাসপাতালের আরএমও ডা. জামাল মোস্তফা এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
আইসিইউ ও অঙিজেন সুবিধা : করোনা চিকিৎসায় নির্ধারণ করা হলেও প্রথম দিকে আইসিইউ সুবিধা ছিল না জেনারেল হাসপাতালে। তবে পরবর্তীতে আনুষঙ্গিক সকল সুবিধা সম্বলিত ১০টি আইসিইউ শয্যা স্থাপন করা হয়। যদিও শ্বাসকষ্টের রোগীদের জন্য সেন্ট্রাল অঙিজেনের সুবিধাও ছিল না এখানে। সিলিন্ডারের মাধ্যমে রোগীদের অঙিজেন সাপোর্ট দেয়া হতো। অবশ্য, পরবর্তীতে সেন্ট্রাল অঙিজেন লাইনের পাশাপাশি প্লান্টও বসানো হয়েছে। অর্থাৎ করোনা রোগীর চিকিৎসায় বর্তমানে আনুষঙ্গিক সব ধরনের সুবিধা রয়েছে আড়াইশ শয্যার এ হাসপাতালে।