বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বিজিবিএম (বার), এনডিসি, পিএসসি বলেছেন, “চায়ের প্যাকেট ও আমদানিকৃত মাছের বরফের ভেতর করে আসছে আইস। আইস দেখতে বরফের মতো হওয়ায় মাদক চোরাকারবারিরা সুযোগ নিচ্ছে। সীমান্তে মাদক চোরাকারবারিদের সাথে বিজিবি’র ইঁদুর-বিড়াল খেলার মতো প্রতিযোগিতা হচ্ছে। চোরাকারবারিরা নতুন নতুন পন্থা অবলম্বন করে আর আমরা এটাকে ধরি। আইসের গন্ধ শুঁকে বুঝতে পারে মতো কুকুরকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। এসব কুকুরের মাধ্যমেও আইস উদ্ধার করা হচ্ছে।”
তিনি আজ বৃহস্পতিবার(১৭ ফেব্রুয়ারি) সকালে সাতকানিয়ার বায়তুল ইজ্জত বিজিবি’র প্রশিক্ষণ প্রতিষ্টান বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার এন্ড কলেজের ৯৭তম রিক্রুট ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে এসব কথা বলেন।
তিনি বলেন, “গত দুই সপ্তাহ আগেও ৯ কেজি আইস উদ্ধার করা হয়েছে যা টাকার অংকে ৫০ কোটি টাকারও বেশি। তারপরও সীমান্ত রক্ষাকারী বাহিনীর চোখ ফাঁকি দিয়ে দেশে মাদক ঢুকছে। তবে তা অবাধে নয়। মিয়ানমার সীমান্তে আমাদের টহল সংখ্যা অনেক গুণ বাড়ানো হয়েছে।”
তিনি আরো বলেন, “সামাজিক আন্দোলনের মাধ্যমে সচেতনতা বৃদ্ধি করে চাহিদা কমাতে না পারলে মাদক চোরাচালান বন্ধ করতে পারবো না। এক কেজি আইসের দাম এক কোটি টাকা। যাদের এই আইস কেনার সক্ষমতা আছে তারাই গ্রহণ করছে। তাই সামাজিক আন্দোলন করে সচেতনতা বৃদ্ধির কোনো বিকল্প নাই। শুধু বিজিবি এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর প্রচেষ্ঠায় মাদক দ্রব্যের প্রবেশ রোধ সম্ভব নয়। এটা সামাজিকভাবে দেশের সকল নাগরিককে সংঘবদ্ধ ভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। সবাই ঐব্যবদ্ধ ভাবে সহযোগিতা করলেই কেবল মাদকের এ ভয়াল ছোবল থেকে দেশকে রক্ষা করতে পারব।”
সীমান্ত হত্যার বিষয়ে জানতে চাইলে বিজিবি’র মহাপরিচালক জানান, আগে সীমান্তবাসীকে সতর্ক হতে হবে। সীমান্ত পার হয়ে অবৈধ ভাবে অন্য দেশে প্রবেশ না করলে সীমান্ত হত্যা থেকে মুক্তি পাবো। বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে উদ্ভাবিত বিভিন্ন ধরনের মাইন লাগানো আছে। সেখানে অবৈধ ভাবে গেলে মাইনে মারা যেতে পারে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তেও অবৈধ ভাবে প্রবেশ করলে সে দেশের আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নিবে। সেই ক্ষেত্রে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের কিছু করার থাকব না।
মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম আরো বলেন, “আমরা সার্বক্ষণিক সচেতন থাকি। সীমান্তবাসীকে সচেতন করতে প্রতি বছর আমরা সীমান্তে হাজারের অধিক সভা-সমাবেশ ও সেমিনার করি। শুধু আমরা সচেতন করলে তো হবে না। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে এগিয়ে আসতে হবে। তাহলে আমরা সীমান্ত হত্যা থেকে পরিত্রাণ পাব।”
তিনি আরো জানান, সীমান্তে আমরা কাঁটা তারের বেড়া দিতে পারি। চাইলে ড্রোনের মাধ্যমেও আমরা নজরদারি করতে পারি। ড্রোন দিয়ে আমরা দেখলাম। দুইদিন পর দেখা গেলো কাটা তারের কিছু অংশ কেটে নিয়েছে। তাহলে লাভটা কী হলো? শুধু কাঁটা তার এবং ড্রোন দিয়ে কাজ হবে না। আগে আমাদের সেই সক্ষমতা অর্জন করতে হবে। বর্তমান সরকার সীমান্তে সড়ক নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে অনেক অংশ কাজ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ- মিয়ানমার সীমান্তে সড়ক হয়ে গেলে কাটা তার এবং ড্রোনও হবে। এর আগে পার্শ্ববর্তী দেশের মতো সীমান্তে সড়ক থাকতে হবে।”
এর আগে বিজিবি’র মহাপরিচালক মো. সাফিনুল ইসলাম বিজিবিএম, (বার) এনডিসি, পিএসসি বায়তুল ইজ্জতে বিজিবির প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার এন্ড কলেজের বীর উত্তম মুজিবুর রহমান প্যারেড গ্রাউন্ডে ৯৭ তম রিক্রুট ব্যাচের সমাপনী কুচকাওয়াজ পরিদর্শন ও অভিবাদন গ্রহন করেন। প্রশিক্ষণ সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে প্যারেড পরিচালনা করেন প্যারেড কমান্ডার ও ৯৭ তম রিক্রুট ব্যাচের অফিসার ইনচার্জ মেজর মোঃ সেলিমুদ্দোজা। প্যারেড এ্যাডজুটেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন সহকারী পরিচালক মোহাম্মদ ইমরান হোসেন।
৯৭ তম রিক্রুট ব্যাচে বায়তুল ইজ্জত বর্ডার গার্ড ট্রেনিং সেন্টার এন্ড কলেজে ৬২১ জন পুরুষ ও ৪৯ জন মহিলা সৈনিক মৌলিক প্রশিক্ষন সম্পন্ন করেন। এছাড়া একই দিনে একই সময়ে চুয়াডাঙ্গা ব্যাটালিয়ন (৬ বিজিবি) এর প্রশিক্ষণ ভেন্যুতে ৯৭ তম রিক্রুট ব্যাচের ২১৫ জন নবীন সৈনিক দীর্ঘ ২৪ সপ্তাহের কঠোর ও কষ্টসাধ্য প্রশিক্ষণ সফলভাবে শেষ করে কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তাদের সৈনিক জীবনের সুচনা করল।
বিজিবি’র মহাপরিচালক কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে নবীন সৈনিকদের উদ্দেশে দেয়া বক্তব্যের শুরুতে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গভীর শ্রুদ্ধাভরে স্বরণ করেন। একই সাথে তিনি এ বাহিনীর ৮ জন বীরউত্তম, ৩২ জন বীরবিক্রম, ৭৭ জন বীরপ্রতীক ও মুক্তিযুদ্ধে জীবন উৎসর্গকারী সকল বীরদের শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করেন।
তিনি আরো বলেন, “বিজিবি আজ একটি সুসংগঠিত, চৌকষ, সুশৃঙ্খল ও পেশাদার দেশপ্রেমিক বাহিনীতে পরিণত হয়েছে। বিজিবি সীমান্তের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে দেশের ৪৪২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সীমান্ত সুরক্ষা, সীমান্তে ভূমি ও সম্পদের নিরাপত্তা বিধান, সীমান্তে চোরাচালান, নারী ও শিশু পাচার রোধসহ সব ধরনের অপরাধ নিয়ন্ত্রণে সফলতার স্বাক্ষর রেখে চলছে।”
নবীন সৈনিকদের তিনি বলেন, “শৃঙ্খলাই হচ্ছে সৈনিকের মূলভিত্তি। আদেশ ও কর্তব্য পালনে যে কখনো পিছপা হয় না সে-ই প্রকৃত সৈনিক। সততা, কর্তব্যনিষ্ঠা, আনুগত্য, নির্ভরযোগ্যতা, বুদ্ধিমত্তা, কর্মতৎপরতা, তেজ ও উদ্দীপনা একটি বাহিনীর শৃঙ্খলা ও পেশাগত দক্ষতার মাপকাটি। নবীন সৈনিকরা এসব গুণাবলির প্রতিফলন ঘটিয়ে বাহিনীর ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার উপর গুরুত্বারোপ করেন। মনোবল, ভ্রাতৃত্ববোধ, শৃঙ্খলা ও দক্ষতা হলো বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের মূলনীতি।”
প্রধান অতিথির বক্তব্য শেষে বিজিবি’র মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বিজিবিএম (বার) এনডিপি, পিএসসি ৯৭ তম রিক্রুট ব্যাচের মধ্যে শারিরীক উৎকর্ষে সেরা নবীন সৈনিক (পুরুষ) ইমন হাওলাদার, একই বিষয়ে সেরা নবীন সৈনিক (মহিলা) নিপা আকতার, ফায়ারিং এ মোঃ জিয়াউর রহমান ও সর্ববিষয়ে সেরা নবীন সৈনিক নুরুল হুদা মামুনের হাতে পুরুস্কার তুলে দেন।