চট্টগ্রামে যাত্রীবেশে সিএনজি টেক্সি ভাড়া নেয় তারা। পথিমধ্যে চা পানের অজুহাতে কোনো দোকানের সামনে টেক্সিটি দাঁড় করায়। নিজেরা চা পানের সময় চালককেও আমন্ত্রণ জানায়। একপর্যায়ে চালকের চায়ের কাপে কৌশলে চেতনানাশক ওষুধ বা ট্যাবলেট মিশিয়ে দেয়া হয়। চা–পান শেষে তারা দ্রুত সিএনজি টেক্সিতে উঠে পড়ে। কয়েক মিনিটের মধ্যে চালক অচেতন হয়ে পড়লে তারা তাকে রাস্তায় ফেলে সিএনজি টেক্সিটি নিয়ে পালিয়ে যায়। পরে সিএনজি টেক্সিতে থাকা মোবাইল নম্বরে মালিককে ফোন করে বিকাশের মাধ্যমে টাকা দাবি করে।
৭ থেকে ১০ দিন ধরে চলে টাকা আদায়ের প্রচেষ্টা। টাকা পাওয়ার পর কোনো প্রত্যন্ত এলাকায় সিএনজি টেক্সিটি রেখে মালিককে ফোনে জানায়, অমুক জায়গায় আপনার গাড়ি রাখা আছে। এভাবে সিএনজি টেক্সিপ্রতি ৫০ হাজার থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত আদায় করে তারা। দুই–একদিন পরপরই এ চক্রের সদস্যরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থান থেকে অভিনব কৌশলে সিএনজি টেক্সি চুরি করছে।
চোর সিন্ডিকেটের সদস্যরা আরও জানায়, শীতকাল, গভীর রাত বা ভোরবেলায় সিএনজি টেক্সি চুরির ক্ষেত্রে তারা ওই কৌশল অবলম্বন করে। তবে গরমকালে তারা ভিন্ন কৌশলে চুরি করে। গরমের সময় সিএনজি ভাড়া নিয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর গরমে হাঁপিয়ে উঠার ভাব ধরে। এ সময় তারা কোনো কোল্ডড্রিংকস বা ডাবের দোকানের সামনে সিএনজি থামাতে বলে। নিজেরা কোল্ড ড্রিংকস বা ডাবের পানি খাওয়ার সময় চালককেও খেতে বলে। এ সময় কৌশলে চালকের কোল্ড ড্রিংক বা ডাবের পানিতে চেতনানাশক মিশিয়ে দেয়া হয়। চেতনানাশক মেশানো ড্রিংক বা পানি খেয়ে সিএনজি টেঙিতে ওঠার কিছুক্ষণের মধ্যে চালক অচেতন হয়ে পড়লে তারা টেঙিটি নিয়ে পালিয়ে যায়। একটি সিএনজি চুরি করতে তাদের ৬ থেকে ৭ জন লোকের প্রয়োজন হয়। টার্গেট করা সিএনজির পেছনে আরেকটি সিএনজিতেও তাদের লোক থাকে। চুরির পর সিএনজি ফিরিয়ে দেয়ার মাধ্যমে এ চক্রের সদস্যরা প্রত্যেকে মাসে লাখ টাকারও বেশি আয় করে থাকে। এডিসি আরও জানান, টাকার বিনিময়ে চোরাই সিএনজি ফিরিয়ে দেয়ার কারণে অনেকে তাদের নামে অভিযোগ দায়ের করেন না। এ কারণে তাদের নামে মামলার সংখ্যা কম।
পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ফেনী জেলায় টেঙি চুরির কয়েকটি দল সক্রিয় আছে। মালিকের সাথে দরদাম না হলে সেগুলো বিক্রি করে দেয় গ্যারেজ মালিকদের কাছে। চোর চক্রের সদস্যরা সিএনজি চালনায় পারদর্শী বলেও তিনি জানান।
আবার অন্য একটি গ্রুপ আছে, যাদের মধ্যে কেউ সংগ্রহ করেন পুড়ে যাওয়া ও নষ্ট হয়ে যাওয়া সিএনজি টেঙির কাগজপত্র। কেউ ওই কাগজপত্রের সঙ্গে মিলিয়ে চুরি করেন নতুন ও পুরাতন সিএনজি টেঙি। পরে চুরি করা ওই গাড়ি গ্যারেজে নিয়ে একজন পাল্টে দেন ইঞ্জিন–চেসিস নম্বর। তাতে লাগিয়ে দেন নষ্ট সিএনজি টেঙির ইঞ্জিন–চেসিস নম্বর। এরপর সংগ্রহ করা নষ্ট গাড়ির কাগজপত্র দিয়ে বাজারজাত ও ভাড়ায় দেন চুরি হওয়া গাড়ি। দীর্ঘদিন ধরে এ অভিনব কায়দায় দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে চোরাই সিএনজি টেঙি সংগ্রহ করে বেচাকেনা চলছে চট্টগ্রামে।
চোরাই সিএনজি টেঙি চক্র নিয়ে দীর্ঘদিন কাজ করছেন আকবরশাহ থানার ওসি ওয়ারী উদ্দিন আকবর। তিনি আজাদীকে বলেন, বিভিন্ন সময় অভিযানে সিএনজি টেঙি চুরি এবং কেনাবেচা চক্রের সদস্যরা ধরা পড়ে। আবার জামিনে এসে পুরনো পেশায় ফিরে যায়। এর ফলে পুরোপুরি বন্ধ হচ্ছে না এ অপরাধ। তিনি বলেন, এই চক্রের সাথে কিছু গ্যারেজ মালিক, মোটর পার্টস ব্যবসায়ী এবং বিআরটিএর দালালও জড়িত আছে বলে জানান তিনি।
পুলিশ জানায়, চোরাই টেঙি কেনার পর গ্যারেজে নিয়ে যন্ত্রাংশ খুলে ফেলা হয়। সেখানে ইঞ্জিন, চেসিস নম্বর পাল্টে ভুয়া রেজিস্ট্রেশন নম্বর লাগানো হয়। পরে সুবিধামতো সেগুলো এক থেকে দেড় লাখ টাকায় বিক্রি করা হয়।
চট্টগ্রামে একটি বিশেষ অভিযান চালিয়ে সিএনজি টেঙি চোর চক্রের মূলহোতাসহ ৭ জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। এ সময় তাদের থেকে ৩টি সিএনজি টেঙি উদ্ধার করা হয়। গত ২১ ও ২২ ডিসেম্বর তাদেরকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ বিষয়ে হাটহাজারী থানার ওসি রুহুল আমিন আজাদীকে বলেন, হাটহাজারী উপজেলার ফরহাদাবাদ ইউনিয়ন থেকে একটি সিএনজি টেঙি চুরি হওয়ার পর বিশেষ অভিযান চালানো হয়। অভিযানে চট্টগ্রাম নগরী ও বাঁশখালী উপজেলা থেকে ৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় তাদের কাছ থেকে ৩টি সিএনজি টেঙি উদ্ধার করা হয়েছে।
নগর গোয়েন্দা পুলিশের উপকমিশনার (উত্তর) মুহাম্মদ আলী হোসেন বলেন, গত ১৯ আগস্ট চোর চক্রের আস্তানা থেকে ১২টি সিএনজি টেঙি উদ্ধার করা হয়েছে। উদ্ধারের পর জানা যায়, চট্টগ্রামে সিএনজি টেঙি চুরির পর ইঞ্জিন ও চেসিস নম্বর পরিবর্তন ও ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে বিক্রি করত একটি চক্র। চক্রের মূল হোতাসহ তিনজনকে আটক করে নগর গোয়েন্দা পুলিশ। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১২টি চোরাই সিএনজি উদ্ধার করা হয়। তারা সিএনজি অটোরিকশা চোর চক্রের সক্রিয় সদস্য।
১৯ জুলাই নগরীর বায়েজিদ থানার বটতল নতুন মাজার ও টেঙটাইল মোড় এলাকায় অভিযান চালিয়ে সিএনজি টেঙি চোর চক্রের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পিবিআই। এ সময় তাদের কাছ থেকে চুরি করা একটি সিএনজি উদ্ধার করা হয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা হল মো. সাহাব উদ্দিন, মো. মজিবুর রহমান ও মো. ওমর ফারুক পারভেজ। পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো ইউনিটের প্রধান পুলিশ সুপার নাইমা সুলতানা বলেন, গ্রেপ্তারকৃতরা সবাই সিএনজি টেঙি চোর চক্রের সক্রিয় সদস্য।