প্রায় চার বছর ধরে ঝুলে আছে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নয়নে ২৯৮ কোটি ৩২ লাখ টাকায় গৃহীত চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) একটি প্রকল্প। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে প্রস্তাবিত প্রকল্পটির আওতায় ৩৫৩টি আধুনিক যান–যন্ত্রপাতি সংগ্রহ করতে চায় চসিক। প্রকল্পটির চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে গত জানুয়ারি মাসে চসিক থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয়া হয়। এরপর চলতি মাসে অর্থ মন্ত্রণালয় প্রকল্পটির জিওবি অনুদানে সম্মতি দেয়। তবে এতে ঋণের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়। যদিও চসিকের ইতিহাসে কোনো প্রকল্পে ঋণ হিসেবে জিওবি অনুদান দেয়ার নজির নেই। এ অবস্থায় শেষ পর্যন্ত একনেকে চূড়ান্ত অনুমোদন পেলেও আর্থিক সংকটে থাকা চসিকের পক্ষে এ প্রকল্প বাস্তবায়ন করা কঠিন হবে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, প্রকল্পটির মোট ব্যয়ের মধ্যে ২৬৮ কোটি ৪৮ লাখ ৮০ হাজার টাকা জিওবি (সরকারি ফান্ড) অনুদান এবং বাকি ২৯ কোটি ৮৩ লাখ ২০ হাজার টাকা নিজস্ব ফান্ডে ব্যয়ের প্রস্তাব করে চসিক। তবে গত ৫ মে প্রকল্পের জিওবি অংশের অনুদানে ঋণের শর্ত জুড়ে দেয় অর্থ মন্ত্রণালয়। শর্ত অনুযায়ি, চসিকের প্রস্তাবিত অনুদানের বিপরীতে ৬০ শতাংশ অর্থ দেয়া হবে ঋণ হিসেবে। যা টাকার অংকে ১৬১ কোটি ৯ লাখ ২৮ হাজার টাকা। বাকি ৪০ শতাংশ বা ১০৭ কোটি ৩৯ লাখ ৫২ হাজার টাকা দেয়া হবে অনুদান হিসেবে। চসিককে ঋণ হিসেবে দেয়া অর্থ ৫ শতাংশ সুদে ২০ বছরে ত্রৈমাসিক কিস্তিতে পরিশোধ করতে হবে।
মেয়রের অসন্তোষ : দীর্ঘদিন ধরে প্রকল্পটি অনুমোদন না হওয়ায় এবং সর্বশেষ জিওবি অনুদানে ঋণের শর্ত জুড়ে দেয়ায় অসন্তোষ প্রকাশ করেছেন সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তিনি আজাদীকে বলেন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য প্রকল্পটি খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রকল্পে অনেকগুলো যান–যন্ত্রপাতি ধরা আছে। এগুলো ছাড়া তো খাল–নালা পরিষ্কার করা সম্ভব হবে না। জলাবদ্ধতা নিরসনের জন্য খাল–নালা–পরিষ্কারে আমাদের মেশিনারিজ দরকার। সিডিএ তাদের মেগা প্রকল্পের কাজ শেষে ৩৬ টি খাল কর্পোরেশনকে বুঝিয়ে দেবে। এছাড়া আরো ২১টি খাল আছে। যন্ত্রপাতির ঘাটতি থাকলে খালগুলো কর্পোরেশন মেইনটেনেন্স করবে কীভাবে? বারবার বলার পরও প্রকল্পটির অনুমোদন দেয়া হচ্ছে না। এখন আবার জিওবি অনুদানে ঋণের শর্ত দেয়া হচ্ছে। এতে বুঝা যায় প্রকল্পটি নিয়ে আন্তরিকতার ঘাটতি আছে। চসিকের আর্থিক সক্ষমতা নেই। তাই প্রকল্পটি সম্পূর্ণ জিওবি অনুদানে অনুমোদন হওয়া উচিত। অন্যথায় বাস্তবায়ন করা কঠিন হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমরা মন্ত্রণালয়ে কথা বলব।
এর আগে গত ২৫ মে নগর ভবনে অনুষ্ঠিত জলাবদ্ধতা বিষয়কে এক সেমিনারে প্রকল্পটির অনুমোদন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন মেয়র। সেদিন তিনি বলেন, চেয়েছি ২৯৮ কোটি টাকা, দিচ্ছে ৮–১০ কোটি টাকা। গত ৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান উদেষ্টার সাথে দেখা করেছি। উনাকে তিনটি কাজের প্রস্তাব দিয়েছি। প্রথমত জলাবদ্ধতামুক্ত করতে চাইলে ২৯৮ কোটি টাকার প্রকল্পটি দিতে হবে। আমার মেশিনারিজ দরকার। যে মেশিন আছে সেগুলো ১৫–২০ বছরের পুরনো। এ মেশিনগুলো যখনই কাজ করতে যাই ফেল করছে সেখানে। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) বলেছেন, ‘দেখছি’।
প্রকল্পে আছে ৩৫৩টি আধুনিক যান–যন্ত্রপাতির প্রস্তাব : প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনায় (ডিপিপি) বিভিন্ন ধরনের ৩৫৩টি আধুনিক যান–যন্ত্রপাতি কেনার প্রস্তাব আছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে– ৬০টি বিভিন্ন সাইজের ডাম ট্রাক, ৬টি বিভিন্ন আকারের চেইন ডোজার, ১০টি বিভিন্ন সাইজের এঙকেভেটর, ২১টি মিনি গার্ভেজ টিপার (১.৫ টন), ২টি রোড সুইপিং মেশিন, ৯টি ব্যাকহো ও স্কিড স্টিয়ার লোডার, ৯টি বিভিন্ন সাইজের হুইল লোডার, ২টি ল্যান্ডফিল কম্পেক্টর, ৫টি গার্ভেজ কম্পেক্টর, ১টি ড্রেন ক্লিনিং ও জেট এন্ড সাকার মেশিন, ২০০টি মোবাইল ওয়েস্ট কনটেইনার ও ১০টি মোবাইল ওয়েস্ট কনটেইনার কেরিয়ার, ভাইব্রেটরি টেনডম রোলার– ১০ টন ডাবল ড্রাম, স্টেটিক থ্রি হইলার রোলার–২০টন।
এছাড়া মনিটরিং পিকআপ, মোটরসাইকেল, ব্যাক হে লোডার, স্কিড স্টিয়ার লোডার, হুইল লোডার, অ্যাম্পিবিউয়াস এঙকেভেটর, ডিমোলিশন এঙকেভেটর, গ্রিপল এঙকেভেটর, চেইন এঙকেভেটর, চেইন এঙকেভেটর, টায়ার এঙকেভেটর, গার্বেজ ট্রিপার, ল্যান্ডফি কম্পেক্টর, ক্লিনিং জেট অ্যান্ড সাকার মেশিন, মোবাইল ওয়েস্ট কনটেইনার, মোবাইল ওয়েস্ট কনটেইনার কেরিয়ার, ডাইব্রেটরি টেনডেম রোলার, তিনটি স্ট্রেটিক থ্রি হুইলার কেনার প্রস্তাব আছে। প্রকল্পে ২০০টি আইপি ক্যামেরা স্থাপন ও গাড়ি রাখার শেড তৈরির বিষয়টিও উল্লেখ আছে।
প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রিতা যে কারণে : স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ে প্রকল্পটির ডিপিপি প্রেরণ করা হয় ২০২১ সালের আগস্ট মাসে। তখন প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয় ৩৯৫ কাটি ৩৮ লাখ টাকা। এরপর একইবছরের ৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত প্রকল্প যাচাই কমিটি (আইপিইসি) সভায় প্রকল্পের ব্যয় কমাতে বলা হয়। এর প্রেক্ষিতে ২০২১ সালের অক্টেবর মাসে ব্যয় কমিয়ে ২৯৮ কোটি ৩২ লাখ টাকায় প্রকল্পের ডিপিপি প্রেরণ করা হয় মন্ত্রণালয়ে। পরবর্তীতে ২০২২ সালের ১৬ মার্চ প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি’র (পিইসি) সভায় প্রকল্পটি অনুমোদন পায়।
জানা গেছে, প্রকল্পটির ডিপিপি প্রস্তুত করেন চসিকের তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (যান্ত্রিক) সুদীপ বসাক। ২০২২ সালের ২৩ মার্চ মাসে তাকে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশনে বদলি করা হয়। এরপর চসিকের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা প্রকল্পটি নিয়ে আর আগ্রহ দেখাননি। তারা মন্ত্রণালয়ে যোগাযোগ রক্ষা না করায় প্রকল্পটি গতি পায়নি।
বর্তমানে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত সুদীপ বসাক আজাদীকে বলেন, যখন প্রকল্পটি সাবমিট করি তখন চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের যান–যন্ত্রপাতি নষ্ট হওয়ার পথে। তাই প্রকল্পটি গ্রহণ করি। প্রকল্পে অনেকগুলো ছোট ছোট যান ধরা আছে। এগুলো দিয়ে অলিগলি থেকে ময়লা পরিষ্কার সম্ভব হবে। আমি কর্পোরেশনে থাকাকালীন নিজে দৌঁড়ঝাপ করে প্রকল্পটি পিইসি সভায় নিয়ে যায়। সেখানে অনুমোদনও হয়। পরবর্তীতে হয়তো প্রকল্পটি নিয়ে আগ্রহের ঘাটতি ছিল। তাই সেভাবে আর এগুয়নি। তবে বর্তমান মেয়র মহোদয়কে ধন্যবাদ তিনি প্রকল্পটির গুরুত্ব অনুধাবন করে এটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নিয়েছেন।
যেভাবে গতি আসে : ২০২৪ সালের নভেম্বর মাসে দায়িত্ব নেয়ার পর প্রকল্পটির বিষয়ে জানতে পারেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। প্রকল্পের অনুমোদন পেতে মন্ত্রণালয়ের যোগাযোগ করেন তিনি। এরপর গত ৫ ফেব্রুয়ারি প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করে প্রকল্পটির অনুমোদন দিতে অনুরোধ করেন। এর আগে ৬ জানুয়ারি প্রকল্পটির বিষয়ে স্থানীয় সরকার বিভাগে চসিকের পক্ষে চিঠি দেয়া হয়। এতে প্রকল্পের প্রস্তাবিত জিওবি অনুদান হিসেবে অর্থ বিভাগের সম্মতি আদায়ের অনুরোধ করা হয়। এর প্রেক্ষিতে গত ৫ মে অর্থ বিভাগ সম্মতি দেয়। যদিও এতে ঋণের শর্ত জুড়ে দেয়া হয়।
যে কারণে প্রকল্প নেয়া : প্রকল্পের উন্নয়ন প্রস্তাবনার তথ্য অনুযায়ী, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনেক কাজের মধ্যে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা একটি অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। দ্রুত জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের সাথে সাথে বর্জ্য উৎপাদনের পরিমাণ দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্জ্য অপসারণের জন্য যে পরিমাণ যান ও যন্ত্রপাতি প্রয়োজন হয় সে পরিমাণ যান–যন্ত্রপাতি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে নেই। বর্তমানে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনে ৩ হাজার ৬৩ মেট্রিক টন বর্জ্য প্রতিদিন উৎপাদিত হয়। এর মধ্যে ১৫৮৫ টন বর্জ্য অপসারণ সম্ভব হয়। বাকি ১ হাজার ৪৭৮ মেট্রিক টন বর্জ্য অনির্ধারিত স্থানে থেকে যায়, যা পরিবেশের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। এসব বর্জ্য অপসারণের জন্য প্রয়োজনীয় সংখ্যক আধুনিক যন্ত্রপাতি ক্রয় করা অতি জরুরি। যেসব যন্ত্রপাতি রয়েছে সেগুলো দিয়ে মান সম্মত উপায়ে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হয় না।
ডিপিপি’তে বলা হয়, প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হলে বর্জ্য সম্পূর্ণভাবে, সহজে ও সুন্দরভাবে অপসারণ করা সম্ভব হবে। বর্জ্য অপসারণ সম্ভব হলে চট্টগ্রাম শহর পরিচ্ছন্ন নগরী হিসেবে পরিগণিত হবে। নাগরিকদের জীবনমান উন্নয়ন হবে।