প্রায় ৪ দশক ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের (চবি) সিনেটে কোনো নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী পরিষদের কার্যক্রম চলছে মেয়াদোত্তীর্ণ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিদের দিয়ে। সর্বশেষ ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ২৫ জন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট সিনেট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তাদের মেয়াদ শেষ হয় ১৯৮৯ সালে। কিন্তু এরপর থেকে আর কোনো নির্বাচন হয়নি। দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ায় শিক্ষাবিদরা বলছেন প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে গণতান্ত্রিক কাঠামো। ১৯৮৬ সালে নির্বাচিত ওই সদস্যদের মধ্য থেকে ইতোমধ্যেই মারা গেছেন ১০ জনেরও বেশি। বিভিন্ন মহল থেকে বারবার সিনেট নির্বাচনের দাবি উঠলেও প্রশাসনের ব্যর্থতায় তা সম্ভব হয়ে উঠেনি। বিশ্ববিদ্যালয় আইন অনুযায়ী তিন বছর অন্তর নির্বাচন হওয়ার নিয়ম থাকলেও তা লঙ্ঘিত হচ্ছে দীর্ঘদিন ধরে।
জানা গেছে, বিশ্ববিদ্যালয় আইন–১৯৭৩ অনুযায়ী সিনেট গঠিত হয় উপাচার্য, উপ–উপাচার্য, সরকার মনোনীত পাঁচ সরকারি কর্মকর্তা, স্পিকার মনোনীত পাঁচ সংসদ সদস্য, আচার্য মনোনীত পাঁচ শিক্ষাবিদ, সিন্ডিকেট মনোনীত গবেষণা সংস্থাগুলোর পাঁচ প্রতিনিধি, পাঁচজন কলেজ অধ্যক্ষ, ১০ জন কলেজশিক্ষক, কুমিল্লা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান, নির্বাচিত ২৫ রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট, বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাচিত ৩৩ শিক্ষক এবং ছাত্র সংসদ থেকে নির্বাচিত পাঁচ ছাত্র প্রতিনিধি নিয়ে। তবে সব পদে নিয়মিত পরিবর্তন এলেও গত ৩৯ বছরে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধিদের পদে কোনো পরিবর্তন আসেনি। এছাড়া দীর্ঘদিন ধরে ছাত্র সংসদ নির্বাচন না হওয়ায় সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধির পদও খালি পড়ে আছে। এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইফতেখার উদ্দিন চৌধুরীর আমলে নির্বাচিত ৩৩ জন শিক্ষক প্রতিনিধির মধ্যে ইতোমধ্যে ৮ জনের অবসরজনিত কারণে পদ শূন্য পড়ে আছে। হচ্ছে না কোনো শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনও।
১৯৮৬ সালে সর্বোচ্চ ভোট পেয়ে নির্বাচিত প্রথম রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি ড. মোহাম্মদ আবদুল মালেক চৌধুরী জানান, দীর্ঘদিন ধরে নির্বাচন না হওয়ার পেছনে রাজনৈতিক ও ব্যক্তিস্বার্থ জড়িত। তিনি বলেন, আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য রফিকুল ইসলাম চৌধুরীসহ একাধিক উপাচার্যকে রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন দেওয়ার কথা বলেছি কিন্তু তারা তা শোনেননি। শিক্ষকতার কারণে আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে ৪২ বছর ছিলাম। এ সময়ে আমি দেখেছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের হাউস টিউটর সিট দিয়ে, সহকারী প্রক্টরের পদ দিয়ে বা প্রভোস্ট পদ দিয়ে কেনা যেত। তারা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কখনও কথা বলতেন না। তিনি আরও বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের এমন পরিস্থিতি দেখে নিজেই খুব লজ্জিত। আমি নির্বাচিত হওয়ার পর প্রথম ৪ বছর সিনেটে অংশ নিয়েছি। এর পর থেকে আমি আর কখনও যাইনি। আমার নাম বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট তালিকায় দেখে ১৯৯৩ সালে রেজিস্ট্রার বরাবর চিঠি দিয়েছি। বলেছি আপনারা দ্রুত রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট নির্বাচন দিয়ে নতুনদের সুযোগ করে দেন। আর যদি না পারেন তাহলে অন্তত আমার নামটা যেন আর ডায়েরিতে না আসে। কিন্তু প্রশাসন আজ পর্যন্ত আমার নামটা রেখে দিয়েছে। এখানে শিক্ষক সমাজের নীরবতাই নির্বাচন না হওয়ার বড় কারণ। শিক্ষকরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে কথা বলেননি বলেই এতদিন নির্বাচন হচ্ছে না।
রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি ড. মনজুর–উল–আমিন চৌধুরী বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নির্বাচন না দেওয়ায় ১৯৮৬ সালে নির্বাচিত সিনেট সদস্যরাই এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে আসছেন। এত বছর পর্যন্ত যারা উপাচার্যের দায়িত্ব পালন করছিলেন তারা বিশ্ববিদ্যালয় আইন–৭৩ অনুযায়ী বাৎসরিক সভা ডাকলেও অভ্যন্তরীণ যে নির্বাচন তারা সেটা দেননি। প্রতিটি সিনেট অধিবেশনে সিনেট নির্বাচন দেওয়ার কথা বলা হলেও তাতে কোনো কর্ণপাত করেনি প্রশাসন। সিনেটে কয়েকটা ক্যাটাগরিতে নির্বাচন হওয়ার কথা যেগুলো হলো রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন, বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ নির্বাচন, বিশিষ্ট নাগরিক নির্বাচন কিন্তু কোনো নির্বাচন দেয়নি প্রশাসন। এমনকি ফিন্যান্স কমিটিতে একজন সিনেট প্রতিনিধি থাকার কথা তারা সেই নির্বাচন পর্যন্ত দেননি। যা বিগত প্রশাসনের ব্যর্থতা।
রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি এবং সিন্ডিকেট সদস্য এসএম ফজলুল হক বলেন, ৭৩ এর আইন অনুযায়ী নির্বাচিত প্রতিনিধি না আসা পর্যন্ত আগের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ দায়িত্ব পালন করে যাবেন। সে অনুযায়ী আমরা এখন পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছি। গত ৩৯ বছরে যতগুলো সিনেট অধিবেশন বসেছে, সবগুলোতেই নির্বাচন দেওয়ার দাবি জানানো হয়েছে। কিন্তু কেন নির্বাচন দেওয়া হয়নি, সেটা প্রশাসনই ভালো বলতে পারবে। প্রশাসন নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন নেতৃত্ব না এনে ১৯৮৬ সালের নির্বাচিত প্রতিনিধি দিয়ে সিনেট অধিবেশন পরিচালনা করে যা প্রশাসনের ব্যর্থতা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ স্টাডিজ বিভাগের সভাপতি অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ সাখাওয়াত হুসাইন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে গণতন্ত্র ও মুক্তবুদ্ধিচর্চার কেন্দ্র। এই প্রক্রিয়া সচল রাখতে সিনেটে রেজিস্টার্ড শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে প্রতিনিধি রাখার নিয়ম বিশ্ববিদ্যালয় আইনে সংযোজিত হয়েছে। এজন্য নিয়মিত নির্বাচন হওয়া প্রয়োজন। আশা করি নতুন প্রশাসন দ্রুত চাকসু নির্বাচন ও রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন দিয়ে সিনেটে ছাত্র প্রতিনিধি এবং রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েট প্রতিনিধি নির্বাচন করে সিনেটে অন্তর্ভুক্ত করবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের (ভারপ্রাপ্ত) রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ সাইফুল ইসলাম বলেন, আমরা প্রশাসনিক দায়িত্বে আসার পর সিনেট নির্বাচন দেওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করছি। আমরা নতুন তালিকা তৈরি করছি সেখানে আরও অনেক গ্র্যাজুয়েট অন্তর্ভুক্ত হবেন। তারপর আমরা নির্বাচন দেওয়ার চিন্তা করবো।
এ প্রসঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ–উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ড. মো. কামাল উদ্দিন বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্টার গ্র্যাজুয়েটদের তালিকা আমরা আপডেট করছি। নতুন রেজিস্টার্ড গ্র্যাজুয়েটদের অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এরপর নির্বাচন নিয়ে আমরা চিন্তা করব। দীর্ঘদিন নির্বাচন না হওয়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, বিগত প্রশাসনের সময় যারা দায়িত্বে ছিলেন, তাদের অনিচ্ছার কারণেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি।