কয়েক মাস আগে বিশ্বখ্যাত চামড়াজাত পণ্যের ব্রান্ড সপ ফ্রান্সের এলভি ব্রান্ডের শোরুমে গিয়েছিলাম। দেখলাম ঐ শোরুমে চামড়াজাত পণ্য বিশেষ করে চামড়ার লেডিস হ্যান্ড ব্যাগ দাম ৩ হাজার থেকে ১০ হাজার ডলার পর্যন্ত। অথচ এর একটি ব্যাগ তৈরিতে এক বর্গ মিটারের বেশি চামড়া লাগার কথা না। যেহেতু বিশ্ববিখ্যাত ব্যান্ড, তাই দাম বেশি। খবর নিয়ে জানলাম এই সব ব্যাগ ফ্রান্স ইটালি ও চায়নার তৈরি। একটা ব্যাগ ভালো করে নেড়ে চেড়ে দেখলাম। মনে হলো যথাযথ উদ্যোগ ও মান নিশ্চিত করতে পারলে এই ধরনের ব্যাগ আমাদের দেশে অনায়াসে তৈরি করা সম্ভব। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধান বাধা হলো এলডব্লিউজি‘র স্বীকৃতি।
টেনারিতে দুই ধরনের বর্জ্য বের হয়, তরল ও কঠিন বর্জ্য। এই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য প্রয়োজন মানসম্পন্ন ইটিপি। কিন্তু গত ৫৩ বছরেও দেশে চামড়া শিল্পনগরীতে আমরা মানসম্পন্ন ইটিপি স্থাপন করতে পারিনি। আর মানসম্পন্ন ইটিপি না থাকায় আমাদের টেনারীগুলো এলডব্লিউজি‘র সনদপত্র পাচ্ছে না। সে জন্য আমাদের দেশের চামড়ার কদর উন্নত বিশ্বের কোথাও নেই। খুব স্বল্প মূল্যে আমাদেরকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য বিদেশে রপ্তানি করতে হয়। ফলে কাঁচা চামড়ার যথাযথ মূল্যও পাওয়া যায় না।
দেশে প্রতিবছর কোরবানির সময় কোটি কোটি টাকার চামড়া নষ্ট হয়। এ বছরও এর ব্যতিক্রম হয়নি। লাখ টাকার গরুর চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩–৪ শত টাকায়। আর ছাগলের চামড়া কেউ কিনতে চায় না, নষ্ট করে ফেলতে হয়। অথচ বাংলাদেশের চামড়ার গুণগত মান ভালো, এখানে শ্রম তুলনামূলক সস্তা। কোনো ধরনের কাঁচামাল আমদানির ওপর নির্ভরশীলতা ছাড়াই চামড়াশিল্পের বিকাশের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। এরপরও কেন চামড়াশিল্পের বিকাশ হচ্ছে না, তা নিয়ে রয়েছে এক গোলকধাঁধা।
বাংলাদেশের পোশাকশিল্পের প্রধান কাঁচামাল তুলাসহ বিভিন্ন কাঁচামাল বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। পোশাক খাত সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা নিয়ে দেশের প্রধান রপ্তানি খাতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশ আজ পোশাক রপ্তানিতে বিশ্বে দ্বিতীয় শীর্ষ। অথচ রাষ্ট্রীয় অবহেলা ও অদূরদর্শিতার কারণে দেশে উন্নত মানের কাঁচা চামড়ার বিপুল সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও চামড়াশিল্প বিকশিত হতে পারেনি।
বাংলাদেশ থেকে ২০২২–২৩ অর্থবছরে ৪,৬৯৯ কোটি ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে, যার জন্য ১,৫৯৯ কোটি ডলারের তুলা, সুতা, কাপড়, সরঞ্জামসহ বিভিন্ন কাঁচামাল আমদানি করতে হয়েছে। অন্যদিকে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রপ্তানি মাত্র ১২২ কোটি ডলার। এ সময় চামড়া জাত পণ্যের বৈশ্বিক বাজার ছিল প্রায় ৪৬৮ বিলিয়ন বা ৪৬ হাজার ৮০০ কোটি ডলার। অর্থাৎ চামড়ার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশের হিস্যা মাত্র ০.২৬%।
তবে বিপুল সম্ভাবনা থাকার পরও দেশীয় চামড়া শিল্পের বিকাশ না হওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ দেশের চামড়াশিল্পের কমপ্লায়েন্স (দূষণমুক্ত ও উন্নত কর্মপরিবেশ) অর্জন করতে না পারা। বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশনের (বিসিক) এক গবেষণা অনুসারে, এ জন্য যেসব কারণ দায়ী তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, সাভারের চামড়াশিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগারের (সিইটিপি) সক্ষমতার অভাব, কমপ্লায়েন্স সম্পর্কে ট্যানারিমালিকদের যথাযথ ধারণা না থাকা, কঠিন বর্জ্যের অব্যবস্থাপনা ও ট্যানারির অভ্যন্তরীণ পরিবেশের মান উন্নত না হওয়া।
আর এসব কারণে চামড়াশিল্পের মানসনদ প্রদানকারী আন্তর্জাতিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি) থেকে স্বীকৃতি পাচ্ছে না সাভারে অবস্থিত ট্যানারিগুলো।ফলে দেশে প্রক্রিয়াজাতকৃত চামড়া ইউরোপের বদলে চীনের বাজারে কম দামে রপ্তানি করতে হচ্ছে।চামড়া শিল্পে কমপ্লায়েন্সের ক্ষেত্রে এত পিছিয়ে আছে যে বাংলাদেশে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত ট্যানারির সংখ্যা মাত্র ৬। অথচ এ সংখ্যা ভারতে ১৩৯, চীনে ১০৩, ইতালিতে ৬৮, ব্রাজিলে ৬০, তাইওয়ানে ২৪, স্পেনে ১৭, দক্ষিণ কোরিয়া ও তুরস্কে ১৬ ও ভিয়েতনামে রয়েছে ১৪টি। এলডব্লিউজি সনদ না থাকার কারণে চামড়ার বৈশ্বিক বাজারে বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে আছে। দেশীয় কাঁচা চামড়ার পর্যাপ্ত জোগান থাকা সত্ত্বেও রপ্তানিমুখী চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী শিল্পকারখানাগুলোকে বছরে প্রায় হাজার কোটি টাকার ফিনিশড চামড়া আমদানি করতে হয়। মূলত পরিবেশদূষণ ও অনুন্নত কর্মপরিবেশের কারণে দেশীয় চামড়াশিল্পে এমন একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে যে একদিকে কাঁচা চামড়ার উপযুক্ত মূল্য না পেয়ে বঞ্চিত হচ্ছে দেশ অন্যদিকে চামড়াজাত পণ্য উৎপাদনকারী কোম্পানিকে বিদেশ থেকে এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত চামড়া আমদানি করতে হচ্ছে। গত এক দশকে চামড়ার জুতা থেকে শুরু করে সব ধরনের পণ্যের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বৃদ্ধি পেলেও বিস্ময়করভাবে দেশে কাঁচা চামড়ার দাম এক চতুর্থাংশ হয়ে গিয়েছে।
চামড়াশিল্পের দূষণের সমস্যা দীর্ঘদিনের। হাজারীবাগে থাকাকালে ট্যানারিগুলো প্রতিদিন প্রায় ২১,৬০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য পরিশোধন না করেই সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে ফেলতো। বুড়িগঙ্গা নদীর দূষণ কমাতে শিল্প মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিসিক সাভারের হেমায়েতপুরে ১,০৭৯ কোটি টাকা ব্যয়ে গড়ে তোলে চামড়াশিল্প নগর, যার মধ্যে ৫৪৭ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার বা সিইটিপি নির্মাণে। ২০১৭ সালে রাজধানীর হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারের চামড়াশিল্প নগরে সরিয়ে নেওয়া হলেও এ শিল্প দূষণমুক্ত হয়নি। খোঁজ নিয়ে দেখা যায়, সিইটিপির দৈনিক পরিশোধনের ক্ষমতা ২৫,০০০ ঘনমিটার বলা হলেও ২০১৯ সালে এলডব্লিউজি কর্তৃক চালানো এক পরীক্ষায় প্রকৃত পরিশোধনের ক্ষমতা পাওয়া যায় মাত্র ১৪,০০০ ঘনমিটার। অথচ চামড়া শিল্প নগরীতে অবস্থিত ট্যানারি গুলোর উৎপাদন ক্ষমতা দৈনিক সর্বোচ্চ ৭৬৬ টন ওয়েট ব্লু এবং ১৪২ টন ক্রাস্ট/ফিনিশড লেদার। স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী পানি ব্যবহৃত হলে দৈনিক প্রায় ২২,০০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদন হওয়ার কথা। এছাড়া ঈদুল আজহার পরবর্তী ৩ মাসে দৈনিক ৪০,০০০ ঘনমিটার তরল বর্জ্য উৎপাদিত হয়। তাই সিইটিপির সক্ষমতার অতিরিক্ত তরল বর্জ্য ড্রেনের মাধ্যমে পার্শ্ববর্তী ধলেশ্বরী নদীতে ফেলা হয়। কাঁচা চামড়া প্রক্রিয়া করণে ব্যবহৃত বিষাক্ত ভারী ধাতু ক্রোমিয়াম পরিশোধনের জন্য যে কমন ক্রোমিয়াম রিকভারি ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে, সেটাও কার্যকর নয়।এ ছাড়া চামড়াশিল্প নগরে দৈনিক ২০০ মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হয়। কিন্তু কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য স্লাজ পাওয়ার জেনারেশন সিস্টেম (এসপিজিএস) না থাকায় উৎপাদিত কঠিন বর্জ্য অস্বাস্থ্যকর ও অনিরাপদভাবে ৬ একর আয়তনের একটি ডাম্পিং জোনে গর্ত করে জমা করা হয়। ফলে চামড়াশিল্পের কারণে ধলেশ্বরী নদী দূষিত হচ্ছে এবং চামড়াশিল্প পরিবেশবান্ধব সার্টিফিকেট পাচ্ছে না। তাই সরকার বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে মানসম্পন্ন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা করলে চামড়া শিল্প একদিন বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের দিক দিয়ে তৈরী পোশাক শিল্পকে পিছনে ফেলে এগিয়ে যাবে–এটি নিশ্চিতভাবে বলা যায়।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট