বাংলা একাডেমির সভাপতি অধ্যাপক আবুল কাসেম ফজলুল হক মনে করেন, ‘বাংলাদেশের রাজনীতির যে নিদারুণ পতনশীল দশা আজ দেখা যাচ্ছে, তা থেকে উত্থানের জন্য কেবল বর্তমান বাস্তবতার বিচার মোটেই পর্যাপ্ত নয়; দরকার ঐতিহাসিক সত্যের মুখোমুখি হওয়ার সাহস’ (শ্রেষ্ঠ প্রবন্ধ, ৫৯)। উনিশ শতকে বঙ্গদর্শন পত্রিকায় বঙ্কিমচন্দ্রও লেখেন, ‘বাঙ্গালার ইতিহাস চাই। নহিলে বাঙ্গালী কখন মানুষ হইবে না। যাহার মনে থাকে যে, এ বংশ হইতে কখন মানুষের কাজ হয় নাই, তাহা হইতে কখন মানুষের কাজ হয় না। তাহার মনে হয়, বংশে রক্তের দোষ আছে। তিক্ত নিম্ব বৃক্ষের বীজে তিক্ত নিম্বই জন্মে–মাকালের বীজে মাকালই ফলে’। একুশ শতকের বিশের দশকে আমাদের তরুণসমাজ জেনজি বা ইন্টারনেট প্রজন্মের কাছে বাংলাদেশের ইতিহাস যদি পৌঁছে না দেওয়া যায়, আমাদের ভবিষ্যৎ বড়ই লড়ঝড়ে। দু’শতক আগে বঙ্কিম যেন আমাদের দেখিয়ে দেন যে, নীতিকথায় আছে, এক মানুষের আঁকা এক ছবিতে আছে, মানুষ সিংহকে জুতা মারছে। চিত্রকর এক সিংহকে ডেকে ছবিটি দেখাল। সিংহ বলল, সিংহেরা যদি ছবি আঁকতে জানত, তা হলে ছবি অন্যরকম হত। বাঙালি ইতিহাস লেখেনি। তাই বাঙালির ঐতিহাসিক চিত্রের এ দশা হয়েছে। একথা যেমন আমাদের ইতিহাসচর্চা সম্পর্কে বাস্তব তেমনি আমদের সাহিত্যচর্চা প্রসঙ্গেও প্রাসঙ্গিক। আমাদের ইতিহাস চর্চার সাথে সাহিত্যবোধের সমন্বয় আবশ্যক, কেননা সাহিত্যের ইতিহাসের ভেতরেই সুপ্ত থাকে জাতির ইতিহাস। এমন প্রেক্ষিতেই বিচার্য শৈলী প্রকাশনী থেকে এবছর প্রকাশিত ভাষাবিজ্ঞানী ড. মো: আবুল কাসেম প্রণীত প্রবন্ধ–সংকলন দুটি: চট্টগ্রাম ইতিহাস (২০২৫) এবং চট্টগ্রাম ও বাংলা সাহিত্য (২০২৫)।
বইদু’টি উৎসর্গ করা হয়েছে যথাক্রমে অধ্যাপক আলমগীর মোহাম্মদ সিরাজুদ্দীন এবং অধ্যাপক মাহমুদ শাহ কোরেশীর উদ্দেশ্যে অপরিসীম শ্রদ্ধায়। প্রবন্ধগুলো দেশে–বিদেশে বিভিন্ন সেমিনারে পঠিত এবং বিভিন্ন পত্রিকায়–জার্নালে প্রকাশিত হলেও গ্রন্থরূপ দেওয়ার সময় ‘সবকটি প্রবন্ধই কমবেশি পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জন’ করেছেন বলে জানিয়েছেন প্রাবন্ধিক। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব ও ভাষাবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতকোত্তর (১৯৭৪) সম্পন্ন করে তিনি ‘বাঙালি মুসলমানের রাজনৈতিক স্বাতন্ত্র্যচেতনা: বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চায় তার প্রতিফলন (১৯৪২–১৯৭২)’ বিষয়ে গবেষণা করে পিএইচডি ডিগ্রি (১৯৮৯) অর্জন করেন। এভাবে বাংলা ভাষা–সাহিত্য ও ইতিহাস–রাজনীতি তাঁর অধ্যয়ন–অধ্যাপনা ও গবেষণা–চর্চার বিষয়ে পরিণত হয়। ভাষাবিজ্ঞান, ব্যাকরণ, ইতিহাস ও সাহিত্যসমালোচনা ইত্যাদি বিচিত্র বিষয়ে তিনি নিরলসভাবে প্রবন্ধ লিখে চলছেন। প্রবন্ধ রচনা ও গবেষণার জন্য তিনি গত বছর (২০২৪) চট্টগ্রাম একাডেমি–শিল্পশৈলী পুরস্কার লাভ করেন। আমাদের অজানা নয় একাডেমিক জ্ঞানচর্চায় ভাষার সাথে ইতিহাস অধ্যয়ন আবশ্যক; আবার ভাষার বৈশিষ্ট্য বিচার করেও আমরা মানুষের নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠী নির্ণয়ে অগ্রসর হই বৈকি! সুতরাং, একজন সাহিত্যের অধ্যাপক কিংবা ভাষাবিজ্ঞানীর ইতিহাসের মুখোমুখি দাঁড়ানোর সাহস যে সাধারণের চেয়ে একটু বেশিই থাকে সে–কথা প্রবন্ধ–সংকলন দুটির পাঠকমাত্রেই স্বীকার করবেন।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পঁয়ত্রিশ বছর অধ্যাপনার অভিজ্ঞতা–ঋদ্ধতা তাঁর প্রবন্ধে পাওয়া যায়। চট্টগ্রাম ইতিহাস (২০২৫) বইটিতে আছে চট্টগ্রামের ইতিহাস–ঐতিহ্য বিষয়ক কুড়িটি মূল্যবান প্রবন্ধ। শুরুতেই ‘আজকের যুগের ইতিহাস গবেষকদের উদ্দেশে’ শিরোনামে প্রবন্ধে প্রাবন্ধিক বলেন, ‘ইতিহাসের গতিপ্রকৃতি সঠিকভাবে জানতে পারলেই না আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে, ভবিষ্যৎ মানুষের জন্য সত্যিকার কল্যাণকর সমাজ রচনা করা’ (পৃ. ১০)। এ থেকে প্রমাণ মেলে প্রাবন্ধিক প্রবন্ধকে সমাজ বদলের হাতিয়ার রূপে প্রয়োগে বন্ধপরিকর। তবে চট্টগ্রামের প্রত্নতাত্ত্বিক মিউজিয়ম আয়োজিত ইতিহাস গবেষকদের সম্মেলনে প্রদত্ত এই অভিভাষণটি কবে পঠিত হয়েছিল বা কবে রচিত হয়েছিল সে–তথ্য পাওয়া পায়নি। ‘চাটগাঁ: অনন্য যুগে যুগে’ প্রবন্ধে তিনি স্মরণ করেন: ‘সারেং, সুটকি, দরগা–এই তিনে চাটগাঁ’। তাঁর ধারণা চর্যাগীতির কালে চট্টগ্রামে অনেক চর্যাও রচিত হয়ে থাকতে পারে। বাংলা একাডেমি প্রকাশিত চরিতাভিধান এর আলোকে তিনি অনুসন্ধান করে দেখান যে, মধ্যযুগের ৩৩জন বাঙালি কবির মধ্যে ১৫জনই চট্টগ্রামের। এমনতর বহু তথ্য–উপাত্ত তিনি সংগ্রহ করলেও এর বিস্তৃত বর্ণনা–বিশ্লেষণে বেশিদূর অগ্রসর হননি। তাইতো প্রবন্ধে আচমকা চট্টগ্রাম সন্তান ড. মুহাম্মদ ইউনূস সম্পর্কে প্রাবন্ধিক লেখেন, ‘সারা দুনিয়ার পণ্ডিত চিন্তানায়কগণ এখন তাঁর কথা মনোযোগ সহকারে শুনছেন, ভাবছেন, বিবেচনা করছেন’। তারপরেই প্রসঙ্গ পরিবর্তন। ‘চট্টগ্রামের ইতিহাসের আলোকে হযরত শাহজাহান শাহ (রঃ)’ প্রবন্ধে তাঁর সরল স্বীকারোক্তি: ‘এখানকার স্থায়ী জনগোষ্ঠীর ধর্মান্তরকরণই যে চট্টগ্রামের বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনগোষ্ঠীর মূল উৎস এটা বলাই বাহুল্য’। ‘আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদ: একটি সংক্ষিপ্ত ইতিহাস’ প্রবন্ধে শায়েস্তা খানের পুত্র বুজুর্গ উমেদ খান কর্তৃক ১৬৬৬ খ্রিষ্টাব্দের শুরুতে আন্দরকিল্লা মসজিদ প্রতিষ্ঠা এবং পরবর্তীতে ব্রিটিশ অস্ত্রাগার রূপে ব্যবহার এর পুনরুদ্ধার ও আধুনিকায়ন বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা রয়েছে। ‘আধুনিক সমাজের আকাঙ্ক্ষায় চট্টগ্রামের একটি সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ প্রবন্ধে লেখক তুলে আনেন: ‘মধ্যযুগীয় চিন্তাচেতনার জমিতে বেড়ে ওঠা পাকিস্তানবাদের সেই রমরমা মুহূর্তে এর সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়া সত্ত্বেও একটি আধুনিক সমাজের আকাঙ্ক্ষায় এর নানা দিকনির্দেশনা তুলে ধরতে গিয়ে আমাদের সাংস্কৃতিক কর্মীরা কী উদ্যম ও বলিষ্ঠ সাহসিকতারই পরিচয় দিয়েছিলেন’ (পৃ. ৩৩)। ‘দৈনিক আজাদীর তিন সারথি’ প্রবন্ধে আলোকপাত করা হয়েছে : দৈনিক আজাদীর স্বপ্নদ্রষ্টা ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক, ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ভাগ্নে ও জামাতা অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ এবং ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেকের একমাত্র পুত্র জনাব এমএ মালেক সাহেবের মহতী কার্যক্রমের উপর। ‘চট্টগ্রামে মুক্তিযুদ্ধ ও গণতন্ত্রের আন্দোলন: ‘আজাদী’র দুটো দুর্লভ সংখ্যার আলোকে’ প্রবন্ধের শিরোনামেই মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রামের ভূমিকা বিষয়ক বিশ্লেষণের স্বরূপ অনুমান করা যায়। ‘স্বাধীনতার প্রথম কবিতা’ প্রবন্ধে কবি শামসুর রাহমানের অবদান স্মরণে রেখেও অধ্যাপক চৌধুরী জহুরুল হকের তথ্য অনুসারে ২৩শে মার্চ ১৯৭১–এ দৈনিক আজাদী–তে প্রকাশিত কাজী জাফরুল ইসলামের ‘দেশকে করব মুক্ত স্বাধীন’ কবিতাটিকে স্বাধীনতার প্রথম কবিতা অভিধা প্রদানের যৌক্তিকতা বিশ্লেষিত হয়েছে। এছাড়াও এই বইয়ে সন্নিবেশিত হয়েছে: ‘শেখ আবদুর রশীদ: একজন ত্যাগী মুক্তিযোদ্ধার প্রতিকৃতি’, ‘আমার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’, ‘সৈয়দ রফিকুল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস’, ‘রাউজানের ইতিহাস’, ‘গ্রামীণ উন্নয়ন: একজন রাউজানবাসীর প্রত্যাশা’, ‘নোয়াজিশপুরে আধুনিক শিক্ষার সূচনাপর্ব: একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা’, ‘গহিরা হাই স্কুলে আমরা’, ‘ব্যারিস্টার অরবিন্দ বড়ুুয়া: আমাদের এক বরেণ্য পূর্বপুরুষ’, ‘বাংলার ইতিহাসের অমর গবেষক আবদুল করিম’, ‘আবদুল হক চৌধুরীর লেখক জীবনের প্রস্তুতি পর্ব’, ‘আবদুল হক চৌধুরীর গবেষণা’ ও ‘উত্তর চট্টগ্রামের বিখ্যাত দানবীর আবদুল অদুদ চৌধুরী: তাঁর জীবন ও কীর্তি’ শিরোনামে স্মৃতিগদ্য, ঐতিহাসিক ব্যক্তিত্বের কীর্তিমূল্যায়ন আর আঞ্চলিক ইতিহাসের নানান অনুষঙ্গ।
চট্টগ্রাম ও বাংলাসাহিত্য (২০২৫) বইটিতে বাইশটি প্রবন্ধ সংকলিত হয়েছে। শুরুতে ‘আধুনিক–পূর্ব যুগের বাংলা সাহিত্যে চট্টগ্রামের অবদান’ প্রবন্ধে চট্টগ্রাম যে প্রাচীন জনপদ তার প্রমাণ দেখিয়েছেন: রামায়ণ–মহাভারতের যুগে প্রাগজ্যোতিষপুরের অংশ চট্টগ্রাম একটি সমৃদ্ধ জনপদ ছিল। ‘মাতৃভাষাপ্রেমী কবি আবদুল হাকিম’ প্রবন্ধে প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মাঝেও মধ্যযুগে সন্দ্বীপের কবি আবদুল হাকিমের মাতৃভাষাপ্রেমে বলীয়ান হয়ে ওঠার বিবরণ উপস্থাপিত হয়েছে পরম মমতায়। এছাড়া ‘মাগনসমস্যা: কোরেশী মাগন বনাম মাগন ঠাকুর’, ‘আলাওল নামে কবি’ এবং ‘বাংলার মোগল যুগের ভাবমানস ও কবি আলী রজা’ প্রবন্ধত্রয়ে মধ্যযুগে চট্টগ্রামের কবিদের অবদান বর্ণিত হয়েছে। ‘মহাকবি নবীন সেনের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা’ প্রবন্ধে বাংলা মহাকাব্যে চট্টগ্রামের অবদান আলোচিত হয়েছে। ‘দেশব্রতী ইসলামাবাদী’, ‘আবদুর রশিদ সিদ্দিকী ও সমকালীন মুসলিম সমাজ’, ‘সাহিত্যিক ও মানুষ আবুল ফজল’, ‘আবুল ফজল মানসের প্রাসঙ্গিক সূত্র’, ‘আসহাব উদ্দীনের সাহিত্যমানস’, ‘বুলবুল চৌধুরীর সাহিত্যপ্রতিভা সম্পর্কে যৎকিঞ্চিৎ’, ‘লালসালু’ উপন্যাসের প্রকৃতি বিচার’, ‘আবদুল হক চৌধুরীর লেখক জীবনের প্রস্তুতি পর্ব’, ‘কালান্তরসাহিত্য ফটিকছড়ির এক বিস্মৃত অধ্যায়’, ‘আবদুল গফুর হালীর মানবিক ভাবমানস’, ‘নেছার আহমদ সম্পাদিত ড. মাহফুজুল হক রচনাবলি প্রসঙ্গে’, ‘ডা. অরবিন্দ বড়ুুয়া রচিত পথে প্রবাসে’, ‘ছত্রিশ হাজার ফুট সম্পর্কে ক’টি কথা’ এবং ‘মুহম্মদ হাফিজুর রহমান–এর নির্বাচিত কবিতা’ শিরোনামে রচিত প্রবন্ধগুলো মূলত বইআলোচনা বা চট্টগ্রামের সাহিত্যিকদের কৃতিত্বকীর্তন বিষয়ক বাতচিত। ‘আবদুল হক চৌধুরীর গবেষণা’ প্রবন্ধটি দুটো বইয়ে রাখার প্রয়োজন ছিল না। তবে বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘পুথিসংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ’। আবদুল করিম প্রথম আনোয়ারা হাই স্কুলের হেডমাস্টারি করে কলকাতায় গিয়ে বঙ্গীয় সাহিত্যপরিষদে বক্তৃতা দিয়ে প্রমাণ বলেন এতদ অঞ্চলের মুসলমানদের মাতৃভাষা বাংলা। পুঁথি সংগ্রহ করে তিনি প্রমাণ করেছেন: মধ্যযুগে মুসলমানেরাই বাংলা ভাষায় সাহিত্যচর্চা করে এ ভাষাকে সমৃদ্ধ করেছেন।
বাংলা ভাষা–সাহিত্য ও ইতিহাসে চট্টগ্রামের অবদান সম্পর্কে আরও অনেক অবাক করা তথ্য আছে বইদুটোতে। সাহিত্য–সমালোচক, ইতিহাস–গবেষকদের পাশাপাশি সাধারণ পাঠকও বইদুটি পড়ে আনন্দ পাবেন আশা করি। সুন্দর প্রচ্ছদ আর মজবুত বাঁধাইয়ের বই দুটি পাঠককে বাঙালির আবহমান ঐতিহ্য–ইতিহাস ও সাহিত্যকে অধ্যয়নে–লালনে উদ্বুদ্ধ করবে।
লেখক: কবি ও ভাষাবিজ্ঞানী, সহকারী অধ্যাপক (বাংলা), সিইউএফ কলেজ