চন্দনাইশ উপজেলাধীন ঐতিহ্যবাহী বরমা গ্রামের এক দরিদ্র অথচ অভিজাত পরিবারে জন্ম নেন যাত্রা মোহন সেনগুপ্ত। তাঁর ভারতখ্যাত পুত্রের নাম ব্যরিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত। চট্টগ্রাম এসোসিয়েশন প্রতিষ্ঠাকালীন সময়ে যে ভূমি দান করেছিলেন, সেটিতে ১৯২০ সালে নির্মিত হয় চট্টগ্রাম শহরের প্রথম ক্লাব হল। উপমহাদেশের বহু রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের নীরব সাক্ষী এই জে এম সেন হল, আজো দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। একিভাবে বাংলা কলেজ খ্যাত নেলী সেনগুপ্তার বাসভবনটিও ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের বহু ঘটনার সাক্ষী। লন্ডনের ক্যামব্রিজ এলাকায় বসবাস করতেন অভিজাত ইংরেজ ফ্রেডরিক গ্রে এবং এডিন হেনরিক গ্রে পরিবার। তাদের পরিবার আলো করে ১২ জানুয়ারি ১৮৮৬ সালে জন্ম নেয় এক কন্যা সন্তান। নাম রাখা হয় এডিথ ইলেন গ্রে। ১৯০৪ সালে গ্রে পরিবারে ভারতীয় এক ছাত্র পেমেন্টে লজিং সিস্টেমে আতিথ্য গ্রহন করেন। ছেলেটির নাম দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত। অনলবর্ষী বক্তা, চলাফেরায় চৌকস এই বাঙালি ছেলের প্রতি ইলেনের আকর্ষণ প্রেমের পর্যায় অতিক্রম করে বিবাহের সিদ্ধান্তে উপনীত হলে বাবা ফ্রেডরিক গ্রে তীব্র আপত্তি উত্থাপন করেন। একরোখা ইলেন ব্যারিস্টার যতীন্দ্রকে বিবাহ করে নিজের নাম রাখলেন নেলী সেনগুপ্তা। ১৯০৯ সালের শীতের এক বিকেলে গ্রামের ধুলোময় রাস্তা দিয়ে ধব ধবে সাদা বিদেশিনী বধূকে নিয়ে যতীন্দ্র বরমা গ্রামের নিজ বাড়িতে হাজির। কয়েকদিনের মধ্যে নেলী গ্রামবাসীকে আপন করে নিয়েছেন যেন জন্ম জন্মান্তরের রক্তের সম্পর্ক। কালক্রমে গ্রাম্য এই বিদেশিনী বধূ বাংলার সীমা ছাড়িয়ে সর্ব ভারতে পরিচিতি লাভ করেন, রাজনীতিক ও সমাজসেবী হিসেবে।
১৯৩৩ সাল। সর্বভারতীয় কংগ্রেসের ৪৭ তম কলকাতা অধিবেশন। সম্ভাব্য সভাপতি পন্ডিত মদনমোহন আলভ্যকে কয়েকদিন আগে বৃটিশ গ্রেফতার করলে, সর্বমহলে নেলী সেনগুপ্তার নাম উঠে আসে। বিদেশিনী এই মহিলার নাম মহাত্মা গান্ধীও সমর্থন করেন। নেলী সেনগুপ্তা হলেন কংগ্রেসের তৃতীয় মহিলা এবং একমাত্র বিদেশি মহিলা সভাপতি। তাঁর নাম এভাবে সর্বভারতীয় পর্যায়ে উঠে আসার পেছনে মূল প্রভাবক ছিল ১৯৩১ সালের ‘খাদি’ আন্দোলন। মহাত্মা গান্ধী বিলেতি কাপড় বর্জন করে দেশীয় হাতে বোনা খাদি কাপড় ব্যবহারের যে আন্দোলনের ডাক দেন তার শুরু চট্টগ্রাম থেকে নেতৃত্বে ছিলেন নেলী সেনগুপ্তা। ভারতীয় রাজনীতির এতো শীর্ষ পর্যায়ে উঠে আসার পেছনে সেন পরিবারের ঐতিহ্যের সাথে নেলীর যুগল বন্ধন ক্রমশঃ সময় ও স্থানের সীমা অতিক্রম করেছে। ঐতিহ্যের শুরু যাত্রা মোহন সেনগুপ্তকে দিয়ে। তিনি জন্মেছিলেন ১৮৫০ সালে। সেই যুগে বি.এস পাস করেন কলকাতা ক্যাথিড্রেল মিশন কলেজ থেকে এবং বি.এল পাস করেন ১৮৭৬। সালে চট্টগ্রাম কমিশনার অফিসের চাকরি ত্যাগ করে চট্টগ্রামেই শুরু করেন আইনপেশা। সম্ভবত; যুগের বৈশিষ্ট্যই যাত্রা মোহনকে সাহিত্যানুরাগী করেছিল। চট্টগ্রাম পরীর পাহাড়ে ১৯১৩ সালে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় সাহিত্য সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের অন্যতম ছিলেন আইনজীবী যাত্রা মোহন সেনগুপ্ত। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এ সম্মেলনে যোগ দিতে চট্টগ্রাম এসেছিলেন এবং রহমতগঞ্জস্থ সেনভবনেই ঐ কয়দিন অবস্থান করেছিলেন। ১৮৯৮ সালে বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য হওয়ায় যাত্রা মোহন বঙ্গীয় রাজনীতির এক অগ্রগণ্য পুরুষ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেন। সাহিত্য সম্মেলন, খাদি আন্দোলন, লবণ আন্দোলন, সত্যাগ্রহ, রাওলাট কমিশন বিরোধীসহ সব আন্দোলনের প্রথম সূত্রপাত হতো বন্দর নগরী চট্টগ্রাম থেকে। বিশের দশকে মাস্টার’দার সশস্ত্র বিদ্রোহ তো আজকের শুধুই ইতিহাস। মহাত্মা গান্ধী এ জন্যই বলেছিলেন, চিটাগং টু দ্য ফোর। পরবর্তীতে পূর্ব- পাকিস্তানে ৬ দফা পাবলিকলি ঘোষিত হয় চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে। একাত্তরের ২৭ মার্চ স্বাধীনতার ঘোষণা আসে চট্টগ্রামের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে।
পিতা যাত্রা মোহনের রাজনৈতিক ভাবমূর্তি ও সমাজসেবা মূলক দৃষ্টিভঙ্গি পুত্র যতীন্দ্রমোহনকে প্রভাবিত করে। বিলেত থেকে ফিরেই যতীন্দ্র কংগ্রেস রাজনীতির সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে পড়েন। এক পর্যায়ে বঙ্গীয় রাজনীতিতে ব্যারিস্টার যতীন্দ্রের প্রভাব দিন দিন বাড়তে থাকে। ব্যক্তিগতভাবে জহুরলাল নেহেরুর সাথে তাঁর বন্ধুত্ব সর্ব ভারতীয় রাজনীতিতে প্রবেশের অন্যতম অনুসঙ্গ হিসেবে আবির্ভূত হয়। গান্ধী পরিবারের সাথে নেলী গুপ্তের নৈকট্য ব্যারিস্টার যতীন্দ্র মোহনের সূত্র ধরেই। যতীন্দ্র তিনবার কলকাতা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র ছিলেন এবং এটা নির্দেশ করে যে, বাংলার অভিজাত শ্রেণিতে যতীন্দ্র অতি উঁচু আসনে অবস্থান করছিলেন।
আইন পেশায় যতীন্দ্রের অবদান অবিস্মরণীয়। ১৮ এপ্রিলের চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন মামলা শুরু হয় ১৯৩০ সালেই। প্রধান আসামী সূর্যসেন। কংগ্রেসের অভ্যন্তরে অনুশীলন সমিতি থেকে পৃথক হয়ে যুগান্তর চরমপন্থী গ্রুপের সূচনা হয় বিপ্লবী অরবিন্দ ঘোষকে কেন্দ্র করে ১৮৯৯-১৯০১ সময়ে। কিন্তু মামলার ভয়ে তিনি পন্ডীচেরী গিয়ে ফরাসী ছত্রছায়ায় আধ্যাত্মিক পথে ধাবিত হন। অত:পর চাপেকর ভ্রাতৃদ্বয় যুগান্তর সমিতির হাল ধরেন। ব্যারিস্টার প্রমথ নাথ মিত্র এসে যুগান্তর সমিতিকে শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড় করান। মাস্টারদা সূর্যসেন কলকাতা থাকাকালীন সশস্ত্র পথে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখা শুরু করেন। ১৯১৮ সালে চট্টগ্রাম এসে দেওয়ানজী পুকুর পাড়ে প্রতিষ্ঠা করেন ‘সাম্যসমিতি’। কংগ্রেস জেলা কমিটির সাধারণ সম্পাদক থাকার পরও মাস্টারদা ৬৫ জনের একদল যুবককে অস্ত্র চালনার ট্রেনিং দিয়ে সশস্ত্র অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা নিয়ে এগোতে থাকেন। এ সময় চট্টগ্রাম কংগ্রেসের শীর্ষ নেতা ব্যারিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত ছিলেন মাস্টার’দার প্রধান পৃষ্ঠপোষক।
১৮ এপ্রিল গোটা ভারতবর্ষ ঘুমিয়ে আছে। ৬৫ যুবক আক্রমণ করল চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার (বর্তমান সার্কিট হাউস)। তাৎক্ষণিকভাবে টেলি ও রেলযোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন এবং নিজেকে ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আর্মির’ (মূলত যুগান্তর গ্রুপের সদস্য) প্রধান হিসেবে নিজেকে স্বাধীন ভারত সরকারের প্রেসিডেন্ট ঘোষণা করেন। মাত্র তিনদিন স্বাধীন এই সরকার স্থায়ীত্ব পেয়েছিল। হাজার হাজার সৈন্য নিয়ে বৃটিশ চট্টগ্রাম অবরোধ করলে বিপ্লবীরা পার্বত্য চট্টগ্রামের গহীন অরণ্যে আশ্রয়ের খোঁজে শহর ত্যাগ করেন। ২২ এপ্রিল ১৯৩০ বৃটিশ সৈন্য জালালাবাদ পাহাড়ে বিপ্লবীদের ঘেরাও করে ফেলে। উভয় পক্ষে তুমুল যুদ্ধ চলে। হরি গোপাল বল টেগরা সহ ১৪ জন বিপ্লবীর মৃত্যু ঘটে। মাস্টারদা সহ বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হন।
মামলাটি বহুদিক থেকে গোটা ভারতের রাজনৈতিক মনস্তত্ত্বে বিপুল আঘাত হানে। এর আগে ভারত বিখ্যাত তিনটি মামলা হলো ১৯২২ সালের পেশোয়ার ষড়যন্ত্র মামলা, ১৯২৪ সালের কানপুর ষড়যন্ত্র মামলা আর ১৯২৯ সালের মিরাট ষড়যন্ত্র মামলা। মিরাট ষড়যন্ত্র মামলায় প্রধান অভিযুক্ত ভগং সিংও সোশালিস্ট বিপ্লবী আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। কানপুর ও পেশোয়ার মামলা দু’টি ছিল কমিউনিস্টদের বিরুদ্ধে। সেদিক বিবেচনায় মাস্টারদা’র মামলাটি ছিল রাজনৈতিক ভাবে পৃথক। মাস্টারদা মূলত জাতীয়তাবাদী নেতা ছিলেন। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবের কথা মাস্টারদা অথবা রিপাবলিকান আর্মি বলেনি। সমসাময়িক ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ মামলাটি পরিচালনার ভারপড়ে ব্যারিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহনের উপর। তিনি ভারত খ্যাত আইনজীবী ব্যরিস্টার রসুল সহ বহু খ্যাতনামা আইনজীবীকে চট্টগ্রাম নিয়ে আসেন এবং তাঁরা রহমতগঞ্জস্থ সেন ভবনেই মামলা চলাকালীন অবস্থান করেছিলেন। সম: সাময়িককালে এই সেন ভবনে রাত কাটিয়েছেন মহাত্মা গান্ধী, ডঃ আনসারী, মওলানা শওকত আলী, মাওলানা মোহাম্মদ আলী, সুভাষ বসু, শরৎ বসু সহ বহু ভারত খ্যাত রাজনীতিবিদ।
বিখ্যাত ব্যক্তিদের সংশ্রব নেলী সেনগুপ্তাকে আরো সামনে নিয়ে যায়। ১৯৩৩ সালে স্বামীর মৃত্যুর পর, দু’সন্তান শিশির এবং অনিলকে নিয়ে এই বিদেশিনী নির্বিঘ্নে পরবর্তী জীবন কাটাতে পারতেন। অথচ তিনি স্বামীর স্বদেশী পথে এগিয়ে গেলেন জোর কদমে। ১৯৪০ এবং ১৯৪৬ এ বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলির সদস্য নির্বাচিত হন কংগ্রেসের নমিনেশনে। পূর্ব-পাকিস্তানে ১৯৫৪ এর নির্বাচন, সংখ্যালঘুদের জন্য সংরক্ষিত ৭২ আসনের মধ্যে কংগ্রেসের টিকিটে ১ টিতে নির্বাচিত হন নেলী সেনগুপ্ত। পঞ্চাশের দশকে সবাই যখন দলে দলে ভারত চলে যাচ্ছিল তখন পন্ডিত নেহেরু নেলী সেনগুপ্তকে অসহায় হিন্দুদের পাশে থেকে সাহস দেবার অনুরোধ জানান। নেহেরুর সেই অনুরোধ নেলী সেনগুপ্ত শেষ দিন পর্যন্ত রক্ষা করেছেন। ১৯৭৩ সালে ৮৮ বছর বয়সে এই বিদেশিনী বাঙালি বধূর বর্ণাঢ্য জীবন নাট্যের সমাপ্তি ঘটে। মাস্টার’ দা সূর্যসেন এবং তারেকশ্বর দস্তিদারের ফাঁসি চট্টগ্রাম কারাগারে একই মঞ্চে কার্যকর হয় ১২ জানুয়ারি ১৯৩৩। মাস্টার’দার দেহ বঙ্গোপসাগরের গভীর জলরাশিতে নিক্ষেপ করা হয়। যারা কলকাতা গিয়েছেন তাঁদের অনেকেই দেশপ্রিয় পার্কে বেড়াতে গিয়েছেন, আমিও গিয়েছি। আমি নিশ্চিত অনেকেই জানেন না, এই দেশপ্রিয় হলেন আমাদের ব্যারিস্টার দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেনগুপ্ত। অথচ আমরা তাঁর ও তাঁর স্ত্রী নেলী সেনগুপ্তার স্মৃতিকে ধরে রাখার কোন চেষ্টাই করলাম না।
লেখক: আইনজীবী, কলামিস্ট