সন্তান; বাবা– মার সারাজীবনের আরাধ্য সম্পদ। সৃষ্টিকর্তার পরম আশীর্বাদেই আমরা সন্তানের বাবা– মা হতে পারি। বাবা– মা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব–কর্তব্য অপরিসীম। জীবনটাকে সুখময় করতে প্রকৃত অভিভাবকের দায়িত্ব থেকে সরে গেলে জীবনটাই মূল্যহীন হয়ে পড়ে। আজ নিজেকে অভিভাবকের জায়গায় বসিয়ে কিছু করণীয় সম্পর্কে লিখতে ইচ্ছে করছে। ভুল–ভ্রান্তিগুলো চোখ এড়িয়ে যাবেন, এ প্রত্যাশা রইলো সকলের প্রতি।
সন্তানের সাথে সবসময় সত্য বলার চেষ্টা করতে হবে আমাদের। মিথ্যা বলা থেকে বিরত থেকে সত্যবাদী হওয়ার মন্ত্র শেখাতে হবে। বর্তমানে প্রযুক্তির বিপুল প্রসারে মোটামুটি আমরা মিথ্যা বেশিই বলে থাকি। যেমন ধরুন, আছি চকবাজারে… কেউ কল করে জানতে চাইলে বলি, চাক্তাই আছি। আমাদের এ বলা মিথ্যা থেকে আমাদের সন্তানও শেখে কিন্তু! আদর্শ বাবা–মা হতে হলে সন্তানকে অবশ্যই সময় দিতে হবে আমাদের। তাদের পছন্দ–অপছন্দ জেনে তাদেরকে দূরে–কাছে অর্থাৎ বাইরের জগতে ঘুরতে নিয়ে যেতে হবে। স্বদেশের প্রতি ভালোবাসা বাড়ানো এবং সাধারণ মানুষের জীবন যাপন সম্পর্কে তাদের একটা জগত তৈরি হয় এর ফলে। সন্তানকে সুশিক্ষিত করা আমাদের দায়িত্ব। অভিভাবক হিসেবে তাদের ভালোবাসা যেমন দরকার তেমনিই দরকার, নিজেদের দাম্পত্য জীবনকে সুখী করা। স্নেহ, মায়া, মমতার মতো স্পর্শকাতর ব্যাপারগুলোর সাথে পরিচিত হয় কিন্তু পরিবার থেকেই। নিজেদের মধ্যে ঝগড়া, মারামারি থেকে বিরত থাকা খুবই জরুরি।
অনেক বাবা–মার মতে, সন্তানকে শুধু আদর, সোহাগে বড় করতে হয়। কিন্তু ‘অতি আদরে নষ্ট পুত্র’ প্রবাদটা ভুললে ভালো হবে না। আমার মতে, শাসনে–আদরে সন্তানকে বড় করতে হয়। এমনও তো হতে পারে, সন্তান অপরাধ করেছে বলে হঠাৎ শাসন করতে গেলে অভিমানে সে আত্মহননের মতো পথও বেছে নিতে পারে! তাই, শাসনে–আদরে সন্তানকে শিক্ষা দিতে হবে। সন্তানের ভালো এবং প্রশংসনীয় কাজে অবশ্যই আমাদের পুরস্কৃত করা উচিত। প্রশংসা করে ভালো কাজে দ্বিগুণ উদ্দীপনা সৃষ্টি করা আমাদেরই কাজ। এতে করে সে মূল্যবোধ সম্পর্কে বুঝবে এবং ভবিষ্যতে এর প্রভাবকে কাজে লাগাতে পারবে। ভালো কাজে প্রশংসার পাশাপাশি নেতিবাচক বা ভুল কাজে তাদেরকে বুঝাতে হবে যে, তারা যা করেছে তা সঠিক নয়। বুঝতে না চাইলে তাদের মৃদু তিরস্কারও করতে হবে এক্ষেত্রে।
সবচেয়ে প্রয়োজনীয় ব্যাপারটা হলো, আমরা আমাদের বেড়ে ওঠার গল্পগুলো সন্তান থেকে আড়াল করি। হয়তো মনে করি, তাদের কাছে বললে তারা আবার কী মনে করে! আমরা ভুল ভাবি এক্ষেত্রে। তারা একটা ইতিহাস জানা থেকে কেনো বঞ্চিত হবে? অতীতের জীবন–যাপন আর বর্তমান আকাশ সংস্কৃতির কল্যাণে জীবন–যাপন! অনেক অমিল। সভ্যতাকে জানতে হলে পেছনে ফিরতেই হয়। সন্তানকে ভালোবাসি সন্তানের প্রত্যাশার চেয়েও বেশি। এ ব্যাপারটা তাদের বুঝতে দিতে হবে। বড় হয়ে তারা যেনো বাবা–মার দায়িত্ব–কর্তব্যগুলো সম্পর্কে সজাগ থাকে এবং বাবা–মাকে বোঝা মনে না করে। সন্তানের কাছে নিজের অবস্থান সম্পর্কে পরিষ্কার একটা ধারণা দেওয়া খুব দরকার আমাদের। আয়–ব্যয় সম্পর্কিত পারিবারিক আলোচনাগুলো তাদের সামনেই করা উচিত। তাদের চাওয়া–পাওয়া নিয়ে একটা বিশাল দূরত্ব তৈরি হবে না এতে করে। বাস্তবতার নিরিখেই তারা বুঝে নিবে কী করা দরকার, কী হওয়া দরকার তাদের।
নীতিগতভাবে আমাদের সচেতন হতে হবে। পরোপকার, মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল নিজেরা আগে হবো তারপর সন্তান থেকে প্রত্যাশা করবো। সফলতার পাশে ব্যর্থতাকে আলিঙ্গন করতে শেখাতে হবে আমাদের। ব্যর্থতাকে বিদ্রুপ বা সমালোচনা না করে কিভাবে পুনর্বার সফল হতে হয় তা শেখাতে হবে আমাদের। সন্তানের কথা শোনার মানসিকতা রাখতে হবে আমাদের। তাচ্ছিল্য করা থেকে বিরত থাকতে হবে। অন্য কারো সাথে তাদের তুলনা করা মোটেই শোভনীয় নয়। এতে হীনম্মন্যতায় ভুগতে পারে তারা।
সন্তানকে সমাজে সুসভ্য মানুষ গড়ার নেপথ্য কারিগর আমরা বাবা– মা’রা। সন্তানকে ভালোবাসে না এমন মানুষ পৃথিবীতে বিরল হয়তো! একজন বোবা ছেলের মাও চায় তার সন্তান যেনো সফল মানুষ হয়! সামনের বেঞ্চের স্টুডেন্টের মা যেমন চায়, তার সন্তান প্রথম হোক, জিতুক। ঠিক পেছনের বেঞ্চের পড়া না পারা স্টুডেন্টের মাও চায়, তার সন্তান জিতুক, সেরা হোক। আসল কথা হলো, আমরা সবাই তো বাবা– মা! আমাদের সবার সন্তান সঠিক মানুষটিই হয়ে ওঠুক আর আমরা হয়ে ওঠি সমাজের আদর্শ বাবা– মা। পৃথিবীর সব বাবা– মাই’ই জিতুক।
লেখক : শিক্ষক