চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের কাছে বিগত ৮ বছরে ১৪ ঘাটের ইজারা মূল্য বাবদ কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের পাওনা প্রায় ৮ কোটি টাকার অধিক। এ বিশাল অঙ্কের টাকা থেকে ২০১৯ সালে তৎকালীন ইউএনও ২০ লাখ টাকা করেছিলেন। আর ২০২০-২১ এ চসিক পরিশোধ করেছে ৪ লাখ ৭২ হাজার ৬৪১ টাকা। সর্বশেষ ২০২৩ সালে সদ্য সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান নিলেন ১০ লাখ টাকা।
হিসাবে দাঁড়ায় মোট ৮ কোটি টাকা পাওনা থেকে মাত্র ৩৪ লাখ ৭২ হাজার ৬৪১ টাকা আদায় হলেও সরকারি কোষাগারে জমা হয়েছে মাত্র ২০ লাখ টাকা। বাকি ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৬৪১ টাকা কর্ণফুলীতে এসে হাওয়া (উধাও) হয়ে যায়।
যা সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি বলে নিশ্চিত করেছেন বর্তমান কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত। তিনি কয়েকবার উপজেলা হিসাব শাখায় যোগাযোগ করে এ তথ্য প্রতিবেদককে নিশ্চিত করেছেন। বলতে গেলে এই বিপুল অঙ্কের পাওনা আদায়ে চেষ্টা করলেও উপজেলা পরিষদ ও প্রশাসন সম্পূর্ণ ব্যর্থ।
জানা গেছে, ২০১৭ সালে কর্ণফুলী উপজেলার যাত্রা শুরু হয়। সৃষ্টি থেকে আজ অবধি কোন বছরের সম্পূর্ণ অর্থ আদায় করতে পারেনি কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ফারুক চৌধুরী। শুধু কী উপজেলা পরিষদ; কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসারও এ দায়িত্ব এড়িয়ে যেতে পারেন না। যদিও স্বতন্ত্র কর্ণফুলী উপজেলা হওয়ার মেয়াদকাল ৮ বছর চলছে।
প্রকৃতপক্ষে, দীর্ঘদিন এই অর্থ অনাদায়ের কারণে উপজেলা পরিষদের অভ্যন্তরীণ খরচ ও উন্নয়নের যোগান দিতে হিমশিম খেতে হয়েছিলো উপজেলাকে। তবুও ইজারার সমূদয় অর্থ বছরের পর বছর বকেয়া পড়ে রয়েছে। কারণ চসিক কতৃপক্ষকে কর্ণফুলী উপজেলার পক্ষ থেকে ১৪টি ঘাটের ইজারালব্ধ ৫০% হিস্যা পরিশোধ করতে বারবার তাগিদ দেওয়া হলেও চসিক আমলে নেননি।
তাঁর প্রমাণে জানা গেছে, ২০২৩ সালের ৭ মার্চ স্থানীয় সরকার বিভাগের প্রশাসন-২ থেকে উপ-সচিব শাহেদ পারভেজ স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে বকেয়া পরিশোধে চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তাকে অনুরোধ করেন। কিন্তু তবুও বিশাল অঙ্কের পাওনা পরিশোধের কোন ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
তথ্য বলছে, গত ২০২৩ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি ও ২৯ শে মার্চ মাসের তথ্য ও চসিক সূত্র বলেছে, পতেঙ্গা ১৫ নম্বর ঘাটের সরকারি মূল্য নির্ধারণ ১ কোটি ৩২ লাখ হলেও সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দর ২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা, সল্টগোলা ফেরিঘাটের সরকারি মূল্য ৩৫ লাখ ২০ হাজার টাকা হলেও সর্বোচ্চ প্রাপ্তদর ৫২ লাখ ১১ হাজার টাকা, সদরঘাটের সরকারি মূল্য ১২ লাখ ২৭ হাজার ৬০০ টাকা হলেও সর্বোচ্চ প্রাপ্তদর ১৯ লাখ ৯৭ হাজার ৩৮৫ টাকা, এয়াকুব নগর লইট্ট্যা ঘাট সরকারি মূল্য ৪ লাখ ৪৬ হাজার ৪৫৪ টাকা হলেও সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দর ৯ লাখ টাকা, ১২ নম্বর তিনটিঙ্গা ঘাটের সরকারি মূল্য ২৫ লাখ ৩৫ হাজার ৫০০ টাকা হলেও সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দর ৩২ লাখ টাকা, ৭ নম্বর রুবি সিমেন্ট ঘাট ৭৬ হাজার ২৫৭ টাকা হলেও সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দর ৮০ হাজার টাকা, ৯ নম্বর বিওসি ঘাটের সরকারি মূল্য ১৮ লাখ ৯৭ হাজার ৯০৪ টাকা হলেও সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দর ৩২ লাখ ২০ হাজার টাকা, অভয়মিত্রঘাটের সরকারি মূল্য ৭ লাখ ৪ হাজার হলেও সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দর ৭ লাখ ৫ হাজার টাকা, পতেঙ্গা চাইনিজ ঘাটের সরকারি মূল্য ৮ লাখ ৯৬ হাজার ৫০০ টাকা হলেও সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দর ১১ লাখ ৮৫ হাজার ৫০০ টাকা, বাকলিয়া ক্ষেতচর ঘাটের সরকারি মূল্য ৫৬ হাজার ১০০ টাকা হলেও সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দর ৭ লাখ ৬০ হাজার ১ টাকা, চাক্তাই ৫ টি লবণ ঘাট সরকারি মূল্য না দেখিয়ে ২২ হাজার ২০০ টাকায় সর্বোচ্চ প্রাপ্ত দরে মোট ১৯ টি ফেরিঘাট ইজারা দেওয়া হয়। যার মধ্যে কর্ণফুলী উপজেলার সাথে সম্পৃক্ত ১৪ টি ঘাট।
এসব ঘাটগুলোর মধ্যে কর্ণফুলী উপজেলা সংলগ্ন বিভিন্ন ঘাটের অবস্থানে দেখা যায়, জুলধা ইউনিয়নের ১১ নম্বর মাতব্বরঘাট, জুলধায় ৯ নম্বর ও ৭ নম্বর ঘাট, বড়উঠান ইউনিয়নের শাহমীরপুর ১২ নম্বর ঘাট, চরপাথরঘাটা ইউনিয়নের অভয়মিত্রঘাট ঘাট টু পুরাতন ব্রিজঘাট, বাংলাবাজার ঘাট, একই ইউনিয়নের বিপরীতে রয়েছে সদরঘাট, ফিরিঙ্গাবাজার ব্রিজঘাট, সদরঘাট ও নতুন ঘাট। সর্বশেষ শিকলবাহা ইউনিয়নের বিপরীতে রয়েছে চাক্তাই ঘাট ও ক্ষেতচর ঘাটের অবস্থান।
চসিক নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন ঘাটের ইজারা মূল্য বাবদ কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের পাওনা বিবরণে দেখা গেছে, ১৪২৪ বাংলা ও ১৪২৫ বাংলা মতে চসিকের কাছে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের পাওনা ছিলো ১ কোটি ১৫ লাখ ৩ হাজার টাকা। এই টাকা থেকে ২০১৯ সালে ২০ লাখ টাকা আদায় হয়। এরপরে চসিকের কাছে পাওনা রয়ে যায়, ৯৪ লাখ ৫২ হাজার ৮১১ টাকা।
পরবর্তী ১৪২৬ বাংলায় চসিকের কাছে পাওনা ৫৭ লাখ ৮৪ হাজার টাকা ২৬৭ টাকা ৫০ পয়সা, ১৪২৭ বাংলায় পাওনা ১ কোটি ৭ লাখ ৮৯ হাজার ৬১৪ টাকা, ১৪২৮ বাংলায় পাওনা ১ কোটি ২৯ লাখ ৪৫ হাজার ৭৩ টাকা, ১৪২৯ বাংলায় পাওনা ১ কোটি ৩৩ লাখ ৯৮ হাজার ১৬৫ টাকা। ফলে, ১৪২৯ বাংলা পর্যন্ত চসিকের কাছে বকেয়া পাওনা ৫ কোটি ২৩ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩০ টাকা ৫০ পয়সা।
তাহলে সর্বশেষ ১৪৩০ ও ১৪৩১ বাংলার ইজারা মূল্য হিসেবে দুই বছরের আরো প্রায় ৩ কোটি ১০ লাখ টাকা মতো যোগ করলে পাওনা থাকেন ৮ কোটি ৩৩ লাখ ৬৯ হাজার ৯৩০ টাকা। যা প্রায় সাড়ে ৮ কোটি টাকা। অথচ ২০১৯ সালে ২০ লাখ টাকা এবং ২০২০-২১ সালে ৪ লাখ ৭২ হাজার ৬৪১ টাকা আদায় হয়। গত ২০২৩ সালের শেষের দিকে আদায় ১০ লাখ টাকা। মোট ৩৪ লাখ ৭২ হাজার ৬৪১ টাকা। কিন্তু কর্ণফুলীতে জমা মাত্র ২০ লাখ টাকা। বাকি ১৪ লাখ ৭২ হাজার ৬৪১ টাকা সরকারি কোষাগারে জমা হয়নি। কেন হয়নি তার সদুত্তর দিতে পারেননি কর্ণফুলী উপজেলা। তবে হিসাব শাখা যাচাই-বাছাই করলে সত্য বেরিয়ে আসবে বলে জানান। অথচ চসিকের পাওনা সাড়ে ৮ কোটি টাকা আদায় হলে উপজেলার অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করা সম্ভব হতো বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন হিসাব শাখার একাউন্ট অফিসার (এও) মোহাম্মদ হুমায়ুন বলেন, ‘চসিকের এস্টেট শাখার হিসাবে হয়তো কর্ণফুলী উপজেলার পাওনা অনেক। যা ৮ বছরের হিসাব মেয়র মহোদয়ের অফিস হতে অনুমোদন হয়ে রাজস্ব শাখায় আসেনি। তবে চসিক কর্ণফুলী উপজেলাকে তিনবারে ৩৪ লাখ ৭২ হাজার ৬৪১ টাকা পরিশোধ করেছেন। ’
কর্ণফুলী উপজেলা প্রশাসন সুত্র জানায়, চসিকের যে ঘাটগুলো রয়েছে তার এক পাশে কর্ণফুলী-অন্য পাশে শহর কূল। ইজারা হলে নিয়ম মতে ইজারার ৫০ ভাগ টাকা কর্ণফুলী উপজেলা পাবেন। চসিক পাওনা পরিশোধ করছে না বিধায় কর্ণফুলী উপজেলা স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাছে একটি চিঠি দিয়েছিলেন।
চিঠির প্রতিত্তরে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় বিভাগীয় কমিশনার ও ডিসি অফিসের মাধ্যমে ডিডিএলজি মারফত তদন্ত হয়ে মন্ত্রণালয়ে গিয়েছিলো। পরে মন্ত্রণালয় চসিককে চিঠি দিয়ে কর্ণফুলীর পাওনা টাকা পরিশোধে ব্যবস্থা নিতে বলেছিলেন কিন্তু সব কাগজে কলমে বন্দি।
এ প্রসঙ্গে কর্ণফুলী উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মাসুমা জান্নাত বলেন, ‘চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন যদি নিয়মিত ভাবে কর্ণফুলী উপজেলাধীন ঘাটগুলোর ইজারালব্ধ পাওনা আদায় করতেন। তাহলে দক্ষিণপাড়ের ঘাট গুলো সংস্কার বা উন্নয়ন করা সম্ভব হতো। অথচ শহর কূলের ঘাটগুলোতে উন্নয়ন কাজ হয়েছে। কর্ণফুলীর ঘাটগুলো অবহেলিত।’
চসিকের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ মুহম্মদ তৌহিদুল ইসলাম বলেন, ‘কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন ঘাটের ইজারা মূল্য বাবদ যে বকেয়া পাওনা রয়েছে তা রাজস্ব শাখা হিসাব নিকাশ করে চূড়ান্ত করলে পরিশোধ করা হবে।’
চসিকের প্রধান রাজস্ব কর্মকর্তা মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বিভিন্ন ঘাটের ইজারা বিষয়ক ফাইলটি এস্টেট শাখায় রয়েছে। খোঁজ খবর নিয়ে কর্ণফুলী উপজেলা পরিষদের পাওনা পরিশোধ করা হবে।’