চসিক জানতে চায় কারিগরি কারণ, সিডিএ তুলে ধরল আইনের ধারা

এ বিষয়ে সিডিএর দায়িত্ব বেশি, প্রয়োজনে কর্পোরেশন সাহায্য করবে : মেয়র । কর্পোরেশনের সাথে আলাপ করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে : সিডিএ চেয়ারম্যান

মোরশেদ তালুকদার | রবিবার , ১৪ ডিসেম্বর, ২০২৫ at ৬:০০ পূর্বাহ্ণ

সিডিএ’র প্রস্তুতকৃত তালিকায় থাকা ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার বিস্তারিত কারিগরি কারণ জানতে চেয়ে চলতি মাসের শুরুতে সংস্থাটিকে একটি পত্র দেয় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। গত সপ্তাহে এ চিঠির জবাব দেয় সিডিএ। যেখানে ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার কারিগরি দিকগুলো স্পষ্ট করেনি সিডিএ। বরং চিঠিতে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন২০০৯ এর দুইটি ধারা উল্লেখ করে আইনটির আলোকে প্রয়োজনীয় কারিগরি পরীক্ষানিরীক্ষা করার জন্য চসিককে পরামর্শ দেয় সিডিএ।

সিডিএ’র কাছ থেকে এমন জবাব পেয়ে বিস্ময় প্রকাশ করেছেন চসিকের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা। তারা বলছেন, সিডিএ কি চসিককে আইন শেখাল! এ বিষয় সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে জানান, নগরে ভবন নির্মাণের অনুমতি দেয় সিডিএ। তাই এ বিষয়ে সিডিএ’র দায়িত্ব বেশি। সিডিএ’র উচিত সুচারূভাবে তাদের দায়িত্ব পালন করা। প্রয়োজনে কর্পোরেশন তাদের সহযোগিতা করবে। সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম আজাদীকে জানান, কারিগরি দিক এনালাইসিস করে দেখার মত সক্ষমতা নেই সিডিএ’র। আবার স্থানীয় সরকার আইন উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে চসিকের দিকে সব ঠেলে দিচ্ছেন, বিষয়টি এমনও না। সিডিএ কর্পোরেশনের সাথে আলাপ করে এ বিষয়ে যৌথভাবে সিদ্ধান্ত নেবে।

সূত্রপাত যেভাবে : আনঅফিসিয়ালি গত মাসের শেষ সপ্তাহে সিডিএ থেকে নগরের ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের একটি তালিকা সংগ্রহ করে চসিক। তালিকায় রয়েছে ১০২টি ভবন। তালিকাটি পেয়ে ১ ডিসেম্বর চসিকে বৈঠক করেন উর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বৈঠকে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের বিষয়ে ৫ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করা হয়। এরপর ৩ ডিসেম্বর সিডিএকে আনুষ্ঠানিক পত্র দেয় চসিক। চসিক সচিব মেহাম্মদ আশরাফুল আমিন স্বক্ষরিত পত্রটিতে সিডিএ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত সিটি কর্পোরেশন এলাকার ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের হালনাগাদ তালিকা এবং ভবনগুলো ঝুঁকিপূর্ণ হওয়ার বিস্তারিত কারগরি কারণ প্রেরণ করতে বলা হয়।

সিডিএ’র জবাব : ৮ ডিসেম্বর চসিকের চিঠির জবাব দেয় সিডিএ। সংস্থাটির সচিব রবীন্দ্র চাকমা স্বাক্ষরিত জবাব সম্বলিত পত্রে স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন২০০৯ এর তৃতীয় তফসিলের অনুচ্ছেদ১৭ এর দুটি উপধারা তুলে ধরা হয়। বলা হয়– ‘সিডিএর প্রস্তুতকৃত হালনাগাদ তালিকায় উল্লেখিত ভবন সমূহের বিষয়ে প্রয়োজনীয় কারিগরি পরীক্ষা নিরীক্ষা করত: স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশ) আইনের আলোকে সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণ করা যায়।’ অবশ্য পত্রে সিডিএ জানায়, নগরের বিভিন্ন স্থাপনার বিষয়ে এলাকাবাসীর অভিযোগ, সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবর এবং সরেজমিনে স্থাপনার বাহ্যিক অবস্থা বিবেচনায় সিডিএ কর্তৃক প্রস্তুতকৃত ঝুঁকিপূর্ণ ভবনের হালনাগাদ তালিকা প্রণয়ন করা হয়েছে।

এ বিষয়ে চসিক সচিব মেহাম্মদ আশরাফুল আমিন আজাদীকে বলেন, কোন গ্রাউন্ডে ঝুঁকিপূর্ণ করা হয়েছে তার বিস্তারিত তথ্য চেয়েছিলাম। কারণ নোটিশ দেয়ার পর ভবন মালিকরা এলে তাদেরও একটা বক্তব্য থাকবে। তখন আমরা সেটা মিলিয়ে দেখব। যাতে অন্যায়ভাবে কেউ ক্ষতিগ্রস্ত না হয়। কিন্তু সিডিএ বিস্তারিত দেয়নি। তারা একটি তালিকা পাঠিয়েছে। সেটা আমরা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণ বিষয়ে গঠিত কমিটির কাছে উপস্থাপন করব।

যা বললেন মেয়র : সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, সিডিএ যেহেতু ইমারত আইন মেইনটেইন করে, ভবনের প্লানও তারা অনুমোদন দেয়, তাই তারাই সেগুলো সর্ট আউট করতে পারে। যেখানে হয়তো যৌথ উদ্যোগে আমরা কাজগুলো করতে পারি। এর মধ্যে আনঅফিশিয়ালি সিডিএ চেয়ারম্যান আমার এখানে এসেছিলেন, এ বিষয়ে ওনার সঙ্গে আলাপ হয়েছে। আমাদের এবং ওনাদের ইঞ্জিনিয়ার যৌথভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন চিহ্নিত করে অনতিবিলম্বে একটা ডিপিপি প্রস্তুত করে মিনিস্ট্রিতে পাঠানোর দরকার আছে।

মেয়র বলেন, যার যেটা দায়িত্ব তাকে সেটা পালন করতে হবে। সিডিএ তো ভবন নির্মাণ সংক্রান্ত বিষয়ে জড়িত। ভবন নির্মাণের জন্য সিডিএ থেকে অনুমতি নিতে হয়। কাজেই দায়িত্বটা মনে হয় তাদের বেশি। সিটি কর্পোরেশন সবসময় সব সার্ভিস অরিয়েন্টেড অর্গানাইজেশনের সাথে একসাথে কোঅর্ডিনেশন করছে ও সার্বিক সহযোগিতা দিয়ে যাচ্ছে। এই ব্যাপারেও আমাদের সহযোগিতা থাকবে ইনশাল্লাহ।

মেয়র বলেন, বিল্ডিংয়ের ক্ষেত্রে মেজর রোল সিডিএ’র। ওনাদের যে দায়িত্ব আছে সেটা তো সুচারূভাবে পালন করতে হবে। ভবনের ক্ষেত্রে ওনাদের দায়িত্ব তো আমাদের চেয়ে বেশি। তারা একরডিংলি সেটা করুক। আমরা অবশ্যই সার্বিক সহযোগিতা দিচ্ছি। আমাদের কাছ থেকে তারা যেটাই চায় সেটা তো আমরা দিচ্ছি। লজিস্টিক সাপোর্ট থেকে শুরু করে সব। বাট ইনিশিয়েটিভটা সিডিএকে নিতে হবে।

মেয়র বলেন, ১০ তলার বিল্ডিং ১৪ তলা করে ফেলল, ৬ তলার বিল্ডিং ১২ তলা করে ফেলল। অতিরিক্ত লোডএর কারণেই তো অনেক সময় ভবন ধসে পড়ে। এটা দেখার দায়িত্ব তো আসলেই সিডিএর। ভবন নির্মাণের অনুমতিটা তো আমাদের কাছ থেকে নেয় নাই। তাই এই জিনিসগুলো তো অবশ্যই সিডিএর দেখার দায়িত্ব। তারা যখন প্লান পাশ করেছে তখন কমপ্লিট একটা আইনের মাধ্যমেই তো করেছে। সিডিএকে দেখতে হবে, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো আইন মেনে করেছে কী না।

যা বললেন সিডিএ চেয়ারম্যান : কর্পোরেশনকে দেয়া চিঠিতে কারিগরি বিষয়ের চেয়েও স্থানীয় সরকার আইনকে বেশি গুরুত্ব দেয়ার বিষয়ে জানতে চাইলে সিডিএ চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. নুরুল করিম আজাদীকে বলেন, সিটি কর্পোরেশনের দিকে ঠেলে দিচ্ছি, বিষয়টি তা না। ওভাবে ভাবা আসলে ঠিক হবে না। আমরা চিন্তা করছি, সিটি কর্পোরেশনের সাথে আলাপ করে যৌথভাবে উদ্যোগ নিব। তিনি বলেন, কারিগরি দিকটা এনালাইসিস করে দেখার মত ক্যাপাসিটি সিডিএর নেই। কারিগরি দিকটা দেখার জন্য দুটো প্রতিষ্ঠান আছে; পিডব্লিউডি (গণপূর্ত অধিদপ্তর) এবং চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট)। ঢাকায় হলে বুয়েট আছে। এদের মাধ্যমে করতে হবে। সিটি কর্পোরেশন ও সিডিএ মিলে সমন্বিতভাবে পিডব্লিউডি থেকে একটা টিম এনে চেক করার জন্য উদ্যোগ নেব। মেয়রের সাথে আমি আলাপ করবসিডিএ সহযোগিতা করবে, সিটি কর্পোরেশনও যেন উদ্যোগ নেয়। আমরা যৌথভাবে মিলে কোনো বিশেষজ্ঞ দিয়ে দিয়ে এগুলোকে চেক করাতে পারে কি না।

সিডিএ চেয়ারম্যান বলেন, আসলে আমরা বসে নেই। পদক্ষেপ নিচ্ছি। চট্টগ্রামে কিন্তু হাজার হাজার ভবন আছে, যেগুলো কমবেশি ঝুঁকিপূর্ণ। তাই আমাদের শুরু করতে হবে। এর মধ্যে আমি সিডিএর স্থাপনাগুলো চেক করার জন্য পিডব্লিউডিএর সঙ্গে যোগাযোগ করেছি। নিউ মার্কেট, কর্ণফুলী মাকেট, পাহাড়তলী মার্কেট এগুলো অনেক পুরনো হয়ে গেছে। ওখানেও কিছু সমস্যা দেখা গেছে। প্রাথমিকভাবে ১০ তলার উপর ভবনগুলো সিডিএ চেক করবে। আমাদের ক্যাপাসিটির মধ্যে যতটুকু চেক করা যায়। ভবন হেলে গেছে কী না, ফেটে গেছে কী না। চেক করে যেগুলো পাব সেগুলো নিয়ে সিটি কর্পোরেশনের সাথে বসব। আসলে আমাদের আরো এঙপার্ট আনতে হবে। দেরি করা যাবে না। আমরা কাজ শুরু করছি। আমাদের ক্যাপাসিটি প্রয়োজনের তুলনায় খুব কম।

তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন অপসারণের ব্যয়টা পাবলিককে করতে হবে। আমরা প্রাথমিকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ ভবনগুলো চিহ্নিত করে খালি করার জন্য চেষ্টা করতে পারব। চট করে খালি করাটাও খুব ডিফিকাল্ট। কারণ একটি বহুতল ভবনে অনেক পরিবার বাস করে। ভবনটা কতটা ঝুঁকিপূর্ণ আমরা সেটা তাদের জানিয়ে দিব। নিয়ম হচ্ছে, বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হলে মানুষ বের করে দিয়ে ওটাকে সিল করে দেয়া। এটার জন্য সিটি কর্পোরেশসহ যৌথভাবে উদ্যোগ নেব। বিষয়টাকে আমরা সিরিয়াসলি নিয়েছি।

তিনি বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ ভবন করার ক্ষেত্রে আবার সতর্কতার সাথে করতে হয়। অনেক সময় ভবন মালিক তার ভাড়াটিয়া তুলে দিয়ে বাণিজ্যিক স্থাপনা করতে চান। সেক্ষেত্রে ভাড়াটিয়া তুলতে না পারলে ভবনটি ঝুঁকিপূর্ণ দাবি করে চিঠি দেয়। যাতে ভাড়াটিয়া উচ্ছেদ করতে পারে। কাজেই খুব কেয়ারফুলি টেস্টগুলো করতে হবে।

কী আছে আইনে : স্থানীয় সরকার (সিটি কর্পোরেশন) আইন, ২০০৯ এর তৃতীয় তফসিলের অনুচ্ছেদ ১৭ এর দুটি উপধারায় আছে– ‘যদি কর্পোরেশন কোনো ইমারত বা তার উপর স্থাপিত কোনো কিছু ধ্বংসের মুখে আছে বলে মনে করে কিংবা সেটা কোনো প্রকারে বাসিন্দাদের অথবা পার্শ্ববর্তী কোনো ইমারত বা তার বাসিন্দাদের বা পথচারীদের জন্য বিপজ্জনক বলে মনে করে, তাহলে কর্পোরেশন নোটিশ দ্বারা উহাতে উল্লিখিত প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য উক্ত ইমারতের মালিককে বা দখলকারকে নির্দেশ দিতে পারবে। যদি এই নির্দেশ পালনে কোনো ত্রুটি হয় তাহলে কর্পোরেশন নিজেই প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে। এ জন্য ব্যয়িত অর্থ ইমারতের মালিকের কাছ থেকে এই আইনের অধীনে আরোপিত কর হিসাবে আদায়যোগ্য হবে।’ আরেকটি উপধারায় আছে– ‘যদি কোনো ইমারত বিপজ্জনক অবস্থায় থাকে, বা তা মানুষ বসবাসের অনুপযুক্ত হয় তাহলে কর্পোরেশন তার সন্তুষ্টি মোতাবেক ইমারতটি মেরামত না করা পর্যন্ত সেটায় বসবাস নিষিদ্ধ করতে পারবে।’

পূর্ববর্তী নিবন্ধআনোয়ারায় ওসমান হাদি ও এরশাদ উল্লাহর ওপর হামলার প্রতিবাদে বিএনপির প্রতিবাদ মিছিল
পরবর্তী নিবন্ধআচরণবিধি মানাতে শুরুতেই প্রশাসনের কড়াকড়ি