চলেনি কোনো ট্রেন চরম দুর্ভোগ

রেলওয়ের রানিং স্টাফদের কর্মবিরতি । চট্টগ্রাম স্টেশন ফাঁকা, পাহাড়তলীতে বিক্ষোভ । সচিবের সাথে বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়নি

আজাদী প্রতিবেদন | বুধবার , ২৯ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:২২ পূর্বাহ্ণ

রেলওয়ের রানিং স্টাফদের (লোকোমাস্টার, সহকারী লোকোমাস্টার, গার্ড ও টিটিই) কর্মবিরতির কারণে গত সোমবার দিবাগত মধ্যরাত থেকে দেশের সব রুটে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ফলে গতকাল মঙ্গলবার চট্টগ্রামঢাকাসহ সারা দেশে কোনো ট্রেন চলেনি। এতে করে চরম ভোগান্তিতে পড়েছেন যাত্রীরা। মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক দেওয়া এবং নিয়োগপত্রের দুই শর্ত প্রত্যাহারের দাবিতে অনির্দিষ্টকালের জন্য কর্মবিরতির কর্মসূচি পালন করছেন তারা। গত সোমবার রাত ১২টার চট্টগ্রামঢাকাসিলেট, রাজশাহী থেকে সকল ট্রেন ছেড়ে গেলেও রাত ১২টা ১ মিনিটের পর থেকে গতকাল সারা দিনে শিডিউলে থাকা ট্রেনগুলোতে উঠেননি রানিং স্টাফরা।

চট্টগ্রাম থেকে প্রতিদিন ১২টি আন্তঃনগর ট্রেনসহ ১৬টি ট্রেন দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে চলাচল করে। ১৬টি ট্রেনে গড়ে ১০ হাজারের মতো যাত্রী ভ্রমণ করেন। ১৬টি ট্রেনের টিকেট যাত্রীদের মাঝে বিক্রি করা হলেও ট্রেন চালকদের ধর্মঘটের কারণে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায় সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েন যাত্রীরা। স্টেশন প্রতিদিন হাজার হাজার যাত্রী আর ট্রেনের হুইসেলে মুখর থাকত। গতকাল সকাল থেকে দেখা গেছে পুরো স্টেশন ফাঁকা। ট্রেনগুলো লাইন ধরে অলস দাঁড়িয়ে আছে। নেই হুইসেল, নেই যাত্রীদের কর্মব্যস্ততা। ট্রেন চলাচল বন্ধ রেখে ট্রেন চালকরা পাহাড়তলী লোকোশেডে দিনভর বিক্ষোভ মিছিল ও সমাবেশ করেছেন। যে লোকোশেড থেকে প্রতিদিন কিছুক্ষণ পরপর ট্রেনের ইঞ্জিন বের হতো সেই লোকোশেড বন্ধ রেখে ট্রেন চালকরা বিক্ষোভ করেন। এ সময় রানিং স্টাফরা তাদের দাবির প্রতি অনড় অবস্থানের কথা জানান।

এদিকে রেলের বিকল্প হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ রেল রুটগুলোতে যাত্রী পরিবহনের জন্য বিআরটিসির বাস সার্ভিস চালু করা হয়েছে। চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক এবিএম কামরুজ্জামান বলেন, রেলওয়ের পক্ষ থেকে যাত্রীদের ভোগান্তি কমাতে বিকল্প হিসেবে বিআরটিসির বাসের মাধ্যমে সেবা দেওয়া হচ্ছে। তাছাড়া যাত্রী চাইলে টিকেট রিফান্ডের সুযোগ আছে। যারা কাউন্টার থেকে টিকেট নিয়েছেন তারা কাউন্টারে টিকেট ফেরত দিয়ে টাকা ফেরত নিতে পারবেন। যারা অনলাইনে টিকেট নিয়েছেন তারা অনলাইনে রিফান্ড রিকোয়েস্ট দিয়ে টাকা ফেরত নিতে পারবেন। চট্টগ্রাম রেলওয়ে স্টেশন মাস্টার মোহাম্মদ আবু জাফর মজুমদার বলেন, চট্টগ্রাম রেল স্টেশন থেকে যাত্রীরা তাদের কেনা রেল টিকেটে বিআরটিসি বাস সার্ভিসের মাধ্যমে ভ্রমণ করতে পারবেন। পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত বিআরটিসি বাস সার্ভিস চালু থাকবে।

স্টেশনে ট্রেনের জন্য অপেক্ষা, দুর্ভোগ : সকালে চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে গিয়ে ট্রেনের অপেক্ষায় অনেক যাত্রীকে বসে থাকতে দেখা গেছে। অনেকে স্টেশন ম্যানেজার, মাস্টার ও কাউন্টারের দিকে ছুটাছুটি করছেন। তাদের চোখেমুখে হতাশার চাপ। ট্রেন ছাড়বেএমন আশায় অনেকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা স্টেশনে অপেক্ষা করেছেন। অনেকে টিকেটের টাকা ফেরত নিচ্ছেন। আবার অনেকে ট্রেনের টিকেটে বিআরটিসির বাসে করে গন্তব্যে যাচ্ছেন। তাদের অনেকে ট্রেন চলাচল বন্ধের খবর জানতেন না বলে জানান।

সকাল ৮টা থেকে ১১ বছরের সন্তানকে নিয়ে চট্টগ্রাম স্টেশনে ট্রেনের অপেক্ষায় বসে আছেন রেবেকা সুলতানা যাত্রী। তিনি ঢাকায় যাওয়ার জন্য সুবর্ণ এক্সপ্রেসের টিকেট কেটেছিলেন। তিনি আজাদীকে বলেন, অগ্রিম টিকেট কেটেছিলাম। স্টেশনে এসে দেখি ট্রেন চলাচল বন্ধ। প্রতিদিন ট্রেনে প্রচুর যাত্রী যাতায়াত করেন। ট্রেন চালকরা তাদের দাবির জন্য ট্রেন বন্ধ রেখে আন্দোলন করবেন, এটা মেনে নেওয়া যায় না।

স্টেশনের প্লাটফর্মে কথা হয় সাইদুল ইসলাম নামে এক যাত্রীর সাথে। তিনি কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনের টিকেট কেটেছেন। তিনি বলেন, পরিবারসহ ৪ জন কক্সবাজার যাওয়ার জন্য স্পেশাল ট্রেনের টিকেট কেটেছি। স্টেশনে এসে শুনছি ট্রেন চলবে না। আমাদেরকে টিকেটের টাকা ফেরত নিতে বলছেন। কক্সবাজার স্পেশাল ট্রেনটি সকাল ৭টায় চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে ছেড়ে যায় প্রতিদিন।

স্টেশনের ভেতরে বেঞ্চে বসে অপেক্ষা করছিলেন এনজিওকর্মী রোজী আক্তার চৌধুরী নামে সুবর্ণ এক্সপ্রেসের যাত্রী। তিনি বলেন, আমি সাড়ে ৭টার সুবর্ণ এক্সপ্রেস ট্রেনের টিকেট কেটেছি। এখন ১১টা বাজে। যদি ধর্মঘট প্রত্যাহার হয়, সেই আশায় অপেক্ষা করছিলাম। স্টেশন ম্যানেজার এবং মাস্টার জানালেন, বিআরটিসি বাসে করে ঢাকায় চলে যাওয়ার জন্য। অথবা অনলাইনে টিকেটের টাকা রিফান্ড নেওয়ার জন্য। তাই এখন বাসে করে ঢাকায় যাওয়ার জন্য বের হচ্ছি।

সিলেটের একটি হোটেলের কর্মচারী মোতালেব এসেছিলেন চট্টগ্রামে নিজের বাড়িতে। গতকাল সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে পাহাড়িকা এঙপ্রেসে করে সিলেটে পৌঁছে রাতে তার কর্মস্থলে যোগদানের কথা ছিল। কিন্তু কর্মবিরতির কারণে তিনি বেলা ১১টায় বিআরটিসি বাসে করে সিলেট যাচ্ছেন। মোতালেব বলেন, ট্রেনের টিকেট দেখিয়ে বিআরটিসি বাসে করে যাওয়া সুযোগ দেওয়া হয়েছে; এজন্য রেল কর্তৃপক্ষকে ধন্যবাদ।

মোতালেবের পাশের সিটে বসা মুন্সি মিয়া বলেন, যেহেতু ট্রেন চালকরা ট্রেন চলাচল বন্ধ রেখেছেন, এই মুহূর্তে আর কী করা? যেকোনো প্রকারে তো যেতে হবে। রেল কর্তৃপক্ষ ট্রেন যাত্রীদের জন্য বাসের ব্যবস্থা করায় মোটামুটি যাওয়ার সুযোগ হলো।

তবে ট্রেনের টিকেটে বিআরটিসি বাসে করে গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার সিদ্ধান্তে অনেকে ক্ষুব্ধ হয়েছেন। মহানগর এক্সপ্রেসের যাত্রী রফিকুল মিয়া বলেন, আমি বাসে চড়তে পারি না, এজন্য ট্রেনের টিকেট কেটেছি অগ্রিম। এখন স্টেশন ম্যানেজার বলছেন ট্রেনের এই টিকেট দিয়ে বিআরটিসি বাসে করে চলে যাওয়ার জন্য। একই ক্ষোভ প্রকাশ করলেন অপর যাত্রী রহিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ট্রেনযাত্রা আর বাসযাত্রা তো এক না। আমরা ট্রেনে যাওয়ার জন্য টিকেট কেটেছি। এখন আমাদেরকে যদি বলা হয় বাসে যেতে, তাহলে কেমন লাগে?

যেসব ট্রেনের যাত্রা বাতিল হয়েছে সেসব ট্রেনের টিকেটের টাকা যাত্রীদের ফেরত দিচ্ছে রেলওয়ে। পাশাপাশি অনেকে বিআরটিসি বাসে করে যাতায়াত করতে দেখা গেছে চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে। আজ বুধবারও চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে বিআরটিসি বাস থাকবে বলে জানান বিআরটিসি চট্টগ্রাম বাস ডিপোর ম্যানেজার জুলফিকার আলী।

রেল স্টেশন ফাঁকা, অলস বসে আছে ১৬ ট্রেন : চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে প্রতিদিন ভোর ৬টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় চট্টলা এক্সপ্রেস, সকাল ৭টায় চট্টগ্রাম স্টেশন থেকে কক্সবাজার ছেড়ে যায় কক্সবাজার স্পেশাল, সাড়ে ৭টায় ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় সুবর্ণ এক্সপ্রেস, ৭টা ৪০ মিনিটে সাগরিকা, ৭টা ৫০ মিনিটে সিলেটের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যায় পাহাড়িকা এক্সপ্রেস, সকাল ৯টা ১৫ নিমিটে বিজয়, সকাল ১০টায় কর্ণফুলী, দুপুর সাড়ে ১২টায় মহানগর এক্সপ্রেস, বিকাল ৩টায় মহানগর গোধালী, ৩টা ৪০ মিনিটে নাসিরাবাদ এক্সপ্রেস, ৪টা ৪৫ মিনিটে সোনার বাংলা, সন্ধ্যা ৬টায় মেঘনা এক্সপ্রেস, রাত ১১টায় তূর্ণা নিশিথা, রাত ৩টা ৪০ মিনিটে কঙবাজারের উদ্দেশ্যে কক্সবাজার এক্সপ্রেস, সকাল ১১টা ৪০ মিনিটে পর্যটক এক্সপ্রেস এবং রাত পৌনে ১২টায় মেইল ট্রেন চলাচল করে।

রেল সচিবের সাথে বৈঠক, সিদ্ধান্ত হয়নি : ধর্মঘট থেকে সরে আসতে রানিং স্টাফদের নিয়ে গতকাল দুপুর দেড়টার দিকে ঢাকা রেলওয়ে স্টেশনের ভিআইপি রুমে বৈঠকে বসেন রেলপথ মন্ত্রণালয়ের সচিব মোহাম্মদ মো. ফাহিমুল ইসলাম। দুপুর ২টা ৪৫ মিনিটের দিকে কোনো সিদ্ধান্ত ছাড়াই রানিং স্টাফদের প্রতিনিধি সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন। বৈঠকে কোনো সুরাহা হয়নি।

দাবির বিষয়ে অনড় রানিং স্টাফরা : রেলের রানিং স্টাফরা তাদের মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক দেওয়া এবং নিয়োগপত্রের দুই শর্ত প্রত্যাহারের দাবিতে কর্মবিরতি পালন করছেন। এর ফলে গতকাল চট্টগ্রামসহ সারা দেশে রেল যোগাযোগ বন্ধ হয়ে পড়ে। গতকাল কোনো ট্রেনের চাকা ঘুরেনি।

বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফ ও শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মো. মজিবুর রহমান বলেন, যতক্ষণ আমাদের দাবি মেনে নেওয়া হবে না ততক্ষণ পর্যন্ত ধর্মঘট অব্যাহত থাকবে। আমরা নতুন কোনো দাবি জানাচ্ছি না। রানিং স্টাফদের ১৬০ বছর ধরে মাইলেজ সুবিধা হঠাৎ করে বাতিল করে দেবেন; সেটা কেউ মানবে? আমাদের বিরুদ্ধে যত খুশি তারা (কর্তৃপক্ষ) ব্যবস্থা নিক, দাবি মেনে না নেওয়া পর্যন্ত আমরা কেউ ট্রেন চালাব না। কেউ কাজে ফিরবে না।

তিনি বলেন, ট্রেন চালকরা দৈনিক আট ঘণ্টার বেশি কাজ করলে বেসিকের (মূল বেতন) বাড়তি অর্থ পেতেন। এছাড়া অবসরের পর বেসিকের সঙ্গে এর ৭৫ শতাংশ অর্থ যোগ করে অবসরকালীন অর্থের হিসাব হতো। ২০২২ সালের জানুয়ারিতে অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রানিং স্টাফদের সেই সুবিধা বাতিল করা হয়। এরপর থেকে বাংলাদেশ রেলওয়ে রানিং স্টাফরা আন্দোলন করছেন। বিষয়টি রেল মন্ত্রণালয় এবং অর্থ মন্ত্রণালয়কে বুঝতে হবে। আমাদের দাবি হচ্ছে, মাইলেজের ভিত্তিতে পেনশন ও আনুতোষিক দেওয়া এবং নিয়োগপত্রের দুই শর্ত প্রত্যাহার করা।

চট্টগ্রাম বিভাগীয় রেলওয়ে রানিং স্টাফ ঐক্য পরিষদের আহ্বায়ক মো. মজিবুর রহমান ভূঁইয়া বলেন, আমরা আমাদের অবস্থানে অনড় আছি। দাবি না মানা পর্যন্ত অবস্থান থেকে সরব না। জানি, আমাদের উপর অনেক হুমকিধমকি, অনেক বিপর্যয় আসতে পারে। এগুলো মেনেই আন্দোলনে নেমেছি। আমরা তো নতুন কোনো দাবি নিয়ে মাঠে নামিনি। পূর্বের প্রাপ্যতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। সেটা ফিরিয়ে দিতে বলছি। আমরা ট্রেন চালকরা দুজনের ডিউটি একজনে করি। তাহলে আমাদেরকে সে রকম সুযোগসুবিধা দেবেন না?

ঢাকায় রেলওয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে রানিং স্টাফদের কেন্দ্রীয় নেতাদের আলোচনা চলছে জানিয়ে তিনি বলেন, আমাদের কেন্দ্রীয় নেতা মো. মজিবুর রহমান ঢাকায় আছেন। নানাভাবে আলোচনা চলছে। আজকে সারা দিন আমরা পাহাড়তলী লোকোশেড এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ করেছি। সোমবার রাত থেকেই তারা পাহাড়তলী লোকোশেডে আছেন বলে জানান তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধযাত্রীদের জিম্মি করে কর্মসূচি দুঃখজনক : উপদেষ্টা
পরবর্তী নিবন্ধবাসে নৈরাজ্য, ভাড়া দ্বিগুণ