‘মৃত্যু কি সহজ, কি নিঃশব্দে আসে অথচ মানুষ চিরকালই জীবন নিয়ে গর্ব করে যায়।’ কথাটা বলেছিলেন উত্তরাধিকার–কালবেলা–কালপুরুষের স্রষ্টা সমরেশ মজুমদারের। জীবন নিয়ে গর্ব কি তাঁরও ছিল না? না থাকলে কী করে লিখলেন এত লেখা!
জনপ্রিয় এই লেখক চলে গেলেন ‘সহজ মৃত্যুর কাছে’। ‘দৌড়’ দিয়ে তিনি চিনিয়েছিলেন নিজেকে, ‘কালবেলা’ তাকে পৌঁছে দিয়েছিল জনপ্রিয়তার চূড়ায়, সেই কথাসাহিত্যিক চলে গেলেন ‘আট কুঠুরী নয় দরজা’ আঁটা ঘর পেরিয়ে ‘কালপুরুষ’ হয়ে নিঃসীমে। গতকাল পশ্চিমবঙ্গের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয়েছে তাঁর, যাঁর উপন্যাস পড়ে স্বপ্নের ভুবন গড়তেন বাঙালি পাঠকদের একটি প্রজন্ম, যারা এখন মধ্যবয়স পার করছেন।
তাঁর প্রথম গল্প ‘অন্যমাত্রা’ লেখা হয়েছিল মঞ্চনাটক হিসেবে। সেখান থেকেই লেখকজীবনের শুরু। ১৯৬৭ সালে দেশ পত্রিকায় ছাপা হয় অন্যমাত্রা। ১৯৭৬ সালে দেশ পত্রিকায় ছাপা হয় প্রথম উপন্যাস ‘দৌড়’। এই কি তাঁর লেখকজীবনের দৌড়? এই ‘দৌড়ের মাঝে’ লিখলেন উত্তরাধিকার, কালপুরুষ, কালবেলা, সাতকাহন, গর্ভধারিণীর মতো জনপ্রিয় সব উপন্যাস। গল্প–উপন্যাস ছাড়াও লিখেছেন আরো অনেক কিছু। খবর বিডিনিউজ ও বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার।
তাঁর উপন্যাস ‘উত্তরাধিকার’–এর শুরু হচ্ছে এভাবে, ‘শেষ বিকেলটা অন্ধকারে ভরে আসছিল। যেন কাছাকাছি কোথাও বৃষ্টি হয়ে গেছে।…’ এই উপন্যাসের পটভূমি জলপাইগুড়ি ও ডুয়ার্সের চা বাগান। কেউ কেউ চরিত্র ও ঘটনার মধ্যে পরিচিত চেহারা খুঁজে পাওয়ায় তিনি বলেছিলেন, আমি একটি বিশেষ সময় নিয়ে উপন্যাস লিখতে চেয়েছি, ফটোগ্রাফারের এলেম আমার নেই। আঘাত কি আমি জানি, তাই সেটা কাউকে দিতে একদম ইচ্ছে করে না।
সমরেশের ট্রিলজি উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ তরুণ বয়সে অনেককে স্বপ্নচারী করে তুলেছিল। তাঁর সাতকাহনে উঠে দাঁড়ানোর প্রেরণা খোঁজেন অনেক নারী, তাঁর সৃষ্ট অর্জুন চরিত্রে ‘থ্রিলড’ হন অনেকে।
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের জন্ম নেওয়া এই কথাসাহিত্যিকের সৃষ্টিকর্ম কিংবা দর্শন নিয়ে নানা সমালোচনা থাকলেও তাঁর লেখা দুই বাংলায় ছিল সমান জনপ্রিয়। ৮১ বছর বয়সী এই লেখক গত কিছুদিন ধরে অসুস্থ হয়ে কলকাতার একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। সেখানেই গতকাল সন্ধ্যা পৌনে ৬টার দিকে মৃত্যু হয় বলে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম খবর দিয়েছে।
কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা জানিয়েছে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণের কারণে গত ২৫ এপ্রিল তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছিল। এরপর শ্বাসযন্ত্রের সমস্যা বাড়তে থাকে। আগে থেকেই সমরেশের সিওপিডি সমস্যা ছিল। হাসপাতালে ‘ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যা’ (স্লিপ অ্যাপনিয়া) বাড়তে থাকে।
সমরেশ মজুমদারের জন্ম ১৯৪২ সালে পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলার গয়েরকাটায়। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমণ্ডিত ডুয়ার্স এলাকায় কেটেছে তাঁর ছেলেবেলা। তাঁর গল্প–উপন্যাসে বারবার ঘুরেফিরে এসেছে সেখানকার অনন্য সৌন্দর্য। জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পড়েছেন। তারপর চলে আসেন কলকাতায়, ভর্তি হন স্কটিশ চার্চ কলেজে। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের ছাত্র ছিলেন তিনি। পরে স্নাতকোত্তরে পড়েন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে।
গ্রুপ থিয়েটার করতেন সমরেশ, নাটক লিখতে গিয়ে তার গল্প লেখার শুরু। একের পর এক উপন্যাস লিখেছেন; যে সংখ্যা দেড়শর বেশি। এর মধ্যে ‘উত্তরাধিকার’, ‘কালবেলা’, ‘কালপুরুষ’ সবচেয়ে জনপ্রিয়। ‘কালবেলা’কে বাংলা সাহিত্যের অন্যতম আধুনিক ‘ক্লাসিক’ বলেও মনে করেন অনেকে। উত্তাল নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা স্লোগান, বিপ্লব, রক্ত, বোমা ও প্রেমের এক তোলপাড় ফেলা এই কাহিনীর জন্য ১৯৮৪ সালে সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার পান তিনি।
এক সাক্ষাৎকারে সমরেশের কাছে প্রশ্ন রাখা হয়েছিল, জীবনকে আপনি কীভাবে দেখছেন? আপনি কি রাজনৈতিক জীবন–যাপন করেছেন? জবাবে তিনি বলেছিলেন, আমি সেই জীবন–যাপন করিনি, তবে দেখেছি। কিন্তু আমার বন্ধুরা যারা এই জীবন–যাপন করেছে, তারা খুব দমন–পীড়নের মধ্যে ছিল। কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে, কেউ জেল খেটেছে, কেউ আত্মগোপন করেছে দীর্ঘদিন। আবার জীবনে প্রেম ব্যাপারটা সিরিয়াস একটা ব্যাপার ছিল। যেসব বন্ধু আন্দোলন–সংগ্রাম করছে, তারা প্রেম করতে চাইত না। কারণ তারা জানত, প্রেম মানে পেছনে টানা। প্রেম মানে ঘরের বাঁধন। ফলে তারা এটাকে এড়িয়ে চলত। আর সে সময় প্রেম করা অনেক কঠিন ব্যাপার ছিল। হাতে হাত ধরে রাস্তায় হাঁটা সহজ ছিল না। চুম্বন–টুম্বন তো ভাবাই যায় না। এ রকম একটা পরিস্থিতি ছিল। এই যে পরিস্থিতি ছিল তার মধ্যে কালবেলা শেষ করলাম।
দ্য ওয়ালের প্রতিবেদনে বলা হয়, বিপ্লব, সংগ্রাম ও জীবনকে অন্যভাবে যাপনের কাহিনী কখনও সমরেশ ছেড়ে যাননি। তার ‘গর্ভধারিনী’ উপন্যাস কার্যত বৈপ্লবিক। সমাজতন্ত্র, সমাজ পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে হিমালয়ের কোলে, সান্দাকফু পেরিয়ে এক বরফঢাকা গ্রামে নিয়ে গিয়েছিলেন উপন্যাসের তরুণ চরিত্রদের।
তার উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অগ্নিরথ, স্বনামধন্য, এই আমি রেণু ইত্যাদি। গোয়েন্দা গল্পেও সিদ্ধহস্ত ছিলেন বর্ণনা করে ওয়াল লিখেছে, বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কম নেই। ফেলুদা, কাকাবাবু, ব্যোমকেশ সকলেই স্বকীয়ভাবে বিরাজ করছে, কিন্তু সবাই কলকাতায় থাকেন। রহস্য ধরতে হিল্লি–দিল্লি যান। সেখানে সমরেশের গল্পের গোয়েন্দা, তথা, সত্যসন্ধানী অর্জুন জলপাইগুড়ির ছেলে। কলকাতাতেও রহস্য সমাধান করতে হয়েছে। কিন্তু তার আসল জায়গা জলপাইগুড়ি। ‘খুঁটিমারি রেঞ্জ’, ‘খুনখারাপি’, ‘কালিম্পং–এ সীতাহরণ’–এমন সব গল্পে দুরন্ত রহস্য সমাধান করে সমরেশের গোয়েন্দা চরিত্র অর্জুন। তবে সমরেশ অর্জুনকে বাংলাতেই আটকে রাখেননি; নিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। উত্তরবঙ্গের সমস্ত সৌন্দর্য, আবেগ, রহস্য ধরা দিত তাঁর কলমে। কলকাতাবাসী বহু পাঠক তাঁর লেখায় চিনেছিল জলপাইগুড়ি শহরের কদমতলা, রূপমায়া সিনেমা, হাকিমপাড়া, শিল্পসমিতিপাড়া, রায়কতপাড়া।
রুপালি পর্দায়ও দেখা গেছে অর্জুনকে। সমরেশের উপন্যাস ‘কালবেলা’ও এসেছে সিনেমার পর্দায়। তাঁর আরও উপন্যাস নিয়েও হয়েছে সিনেমা, টিভি নাটক। বাংলাদেশেও সাতকাহন নিয়ে হয়েছে টিভি সিরিয়াল।
১৯৮২ সালে সমরেশ পান আনন্দ পুরস্কার। ‘কলকাতায় নবকুমার’র জন্য ২০০৯ সালে বঙ্কিম পুরস্কারে সম্মানিত করা হয়েছিল তাকে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ২০১৮ সালে সমরেশ মজুমদারকে ‘বঙ্গবিভূষণ’ সম্মানে ভূষিত করে।