ছোটবেলা থেকে একটা গান আমার খুব প্রিয়, “না বলে এসেছি, তা বলে ভেবো না/ না বলেই চলে যাবো”। হ্যাঁ কেউ কেউ না বলেই চলে যায়। সকলকে নির্বাক স্তব্ধ করে শোকের সাগরে ভাসিয়ে চলে গেলেন বিরলগুণের অধিকারী, চট্টগ্রাম লেডিস ক্লাবের প্রাক্তন সভানেত্রী, চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের সভাপতি, চট্টগ্রাম একাডেমির জীবন সদস্য আরো অনেক সেবামূলক প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সাথে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিত্ব বিশিষ্ট রম্যলেখক, প্রাবন্ধিক আমাদের সকলের শ্রদ্ধেয় ও প্রিয় আপা বেগম জিনাত আজম। জিনাত আপার সান্নিধ্যে এসেছি সেই তরুণ বয়স থেকেই রেডিও এবং চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘের মাধ্যমে। তখন আরো বটছায়া হিসেবে ছিলেন সালমা চৌধুরী, ফাহমিদা আমিন, বেগম রুনু সিদ্দিকী, মমতাজ সবুর ও আরো অনেকে। প্রতিটি প্রতিষ্ঠানকে তিনি নিবিড় পরিচর্যার মাধ্যমে সন্তানের মতো লালন করেছেন। তাঁর কাছ থেকে অনেক শিখেছি, অনেক পেয়েছি। তিনি তাঁর সন্তানদেরও যোগ্য করে গড়ে তুলেছেন। তাঁর বড় ছেলে মেরিন ইঞ্জিনিয়ার আতিক উল্লাহ খান। দীর্ঘদিন দেশেই আছেন। আর জাহাজে যাননি। তার সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের নাম ‘অঙ্গীকার’। এই অঙ্গীকারের মাধ্যমে জিনাত আপা লেডিস ক্লাব ও ইনার হুইল ক্লাবকেও সংযুক্ত করে অসহায়, নিপীড়িত ও প্রাকৃতিক দুর্যোগে কবলিত, আকস্মিক বিপদে পতিত অনেক মানুষের জন্য অকাতরে কাজ করেছেন। আতিক সকল কাজে আমাদের পাশে ছিল। মনে পড়ছে, করোনাকালীন অনেক অসাধারণ কাজ হয়েছে, মজনুর ইন্তেকালের (১ মে, ২০২১) দু’দিন আগেও বাকলিয়ার ‘সার্ক একাডেমি’তে ২০০ পরিবারকে ত্রাণ বিতরণ করা হয়েছে আতিকের নেতৃত্বে। শুধু এখানেই নয় আতিক তখন সারাদেশের জন্যই কাজ করেছে। জিনাত আপা যেমনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ তেমনি মায়াবী। মনে পড়ছে আমি যখন মজনুর ইন্তেকালের দু’দিন পর করোনায় আক্রান্ত হয়ে পার্কভিউতে গুরুতর অবস্থায় ভর্তি ছিলাম, তখন সাংবাদিক রাশেদ রউফ ভাইয়ের মাধ্যমে জানতে পেরেছিলাম জিনাত আপা এবং আনোয়ারা আপা শুধু একবার আমার কণ্ঠ শুনতে চায়। আমি রোগে এবং শোকে বিহ্বল, স্তব্ধ–পাথর। বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে শুধু একবার ‘হ্যালো’ বলেছিলাম। ওপ্রান্ত থেকে আমি দু’জনের কান্না ও দোয়া শুনেছি। এই হলেন জিনাত আপা। করোনার পর সব স্বাভাবিক হওয়ার পর যখন ক্লাব কার্যক্রম শুরু হলো, তখন আপা আমাকে দেখলেই বলতেন, ‘মর্জিনা তোমাকে দেখলেই মজনুর কথা মনে পড়ে। মজনু চলে যাওয়াতে আমাদের অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে। অনেক কাজ থেমে গিয়েছে।’ আমরা দু’জনেই আপার পরম স্নেহ ও ভালোবাসায় সিক্ত ও ধন্য ছিলাম। আজ আমারও বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, আপনিও অসময়ে চলে গেলেন। আপনি অনেক অসহায়ের সহায় ছিলেন, অন্ধকারে আলো ছিলেন, অকূলের কূল ছিলেন এতিমদের পরমাশ্রয় ছিলেন। লেডিস ক্লাবের এতিমখানা সেক্রেটারি বোরহানা কবির, সভানেত্রী খালেদা আউয়াল আপা, পারভীন জালাল, মিনু আলম, সুরমা কাদের ও আরো অনেকের সাথে আপনার মায়াবী স্পর্শ ও নির্দেশনায় সুন্দর চলছে। আপনি আমাদেরও অভিভাবক এবং বটছায়া ছিলেন।
ক্লাব ও সংঘের যেকোনো কাজ আপনার নির্দেশনা ও পরামর্শে সুচারুভাবে করার জন্য প্রাণিত হতাম। লেখিকা সংঘের সেক্রেটারি সেলিমা আক্তার আপনার সাথে অত্যন্ত আনন্দ ও উৎসাহের সাথে কাজ করেছে। যেকোনো মিটিংয়ের আগে আপনার একটা ফোন আমরা পেয়ে অত্যন্ত প্রাণিত হয়েছি, উপস্থিত থাকার তাগিদ অনুভব করেছি। আমরা হঠাৎ করে অভিভাবকশূন্য হয়ে গেলাম। আমরা জানি, ‘জন্মিলে মরিতে হইবে।’ তবু ভাবছি কি করে মেনে নেব, ‘তোমার আসন শূন্য আজি’। আপনার মত বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, ভদ্র, বিনয়ী, নম্র, নিরহংকার হাসি–খুশী আর একজন নেত্রী পাওয়া দুর্লভ। মিলাদ শেষে আপনার ক্রন্দনরত মোনাজাত আজো কানে বাজে। চতুর্থ সপ্তাহে ক্লাবে ধর্মীয় আলোচনা হয় দৈনন্দিন জীবনের গুরুত্বপূর্ণ ধর্মীয় ও নৈতিক শিক্ষাগুলো আপনার কাছ থেকেই শিখেছি। আপনার মানবিক কার্যাবলীতে আমরা ছিলাম চিরমুগ্ধ। আমরা অনেক বছর আগে সিলেট লেখিকা সংঘের আমন্ত্রণে পুরো চট্টগ্রাম লেখিকা সংঘ আপনার ও ফাহমিদা আপার নেতৃত্বে সিলেট গিয়েছিলাম। উপলক্ষ ফাহমিদা আপার সম্মাননা গ্রহণ।
আমাদেরকে গোছগাছ করে দিয়েছিলেন পারভীন ভাবীর স্বামী তৎকালীন কমিশনার জালাল ভাই এবং জিনাত আপার স্বামী আজম দুলাভাই। আমার স্বামী সাখাওয়াত হোসেন মজনু আমাদের সফরসঙ্গী হয়েছিল। কত বর্ণাঢ্য স্মৃতি এখন মনের ক্যানভাসে ভাসছে। জিনাত আপা একটি প্রতিষ্ঠান। লিখে শেষ করা যাবে না। কতো কথা, কতো ঘটনাবলী। সদা এবাদত এবং আপন কাজে নিমগ্ন শান্তশিষ্ট মানুষটি হঠাৎ চলে যাবেন ভাবতেই পারিনি। আমাদের লেডিস ক্লাবের প্রিয় সদস্য বোন আমার নিকটতম প্রতিবেশী মাহমুদা বেগম যখন এ খবরটা আস্তে ধীরে কয়েকবার ফোন করে আমাকে জানিয়েছেন। শুনে আমি তো হতবাক, কথা বলতে পারছিলাম না স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। বিশ্বাস হচ্ছিল না, নিশ্চিত হওয়ার জন্য সাংবাদিক রাশেদ রউফ ভাইকে ফোন করেছিলাম। দুপুরের পর আমি এবং মাহমুদা আপা দেখতে গিয়েছিলাম। ফ্রিজারে ঘুমিয়ে আছেন নিশ্চিন্তে। পৃথিবীর জটিলতা থেকে মুক্ত হলো সহজ সরল একজন মানুষ। কিছুই করার নেই।
‘শুধু চেয়ে চেয়ে দেখলাম, / তুমি চলে গেলে…’
প্রাণভরে সকলেই দোয়া করলো। হে আল্লাহ এই ধর্মপ্রাণ মহীয়সী নারীকে তুমি জান্নাতুল ফেরদৌসের মেহমান হিসাবে কবুল করে উচ্চতম মোকামে স্থান দিও। (আমিন)
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক; সাবেক প্রধান শিক্ষক
কৃষ্ণকুমারী সিটি কর্পোরেশন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়