কর্ণফুলী নদীতে জেগে ওঠা চর বাকলিয়ায় আধুনিক ও বিশ্বমানের পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে চায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন (চসিক)। এ লক্ষ্যে চরটির ২০০ একর অকৃষি খাসজমি প্রতীকী মূল্যে দীর্ঘমেয়াদী বন্দোবস্ত চেয়ে ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছেন মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। এর আগে সাবেক মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর মেয়াদকালে চর বাকলিয়ার ৩৫ একর ভূমিতে বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছিল। এ প্রকল্প নিয়ে পরিবেশবাদীসহ সচেতন মহলের আপত্তি থাকায় আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।
চর বাকলিয়াকে ঘিরে পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে ভূমি বরাদ্দের প্রস্তাব দেয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করে সিটি মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন আজাদীকে বলেন, চট্টগ্রামের বিপুল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে কাজে লাগিয়ে এ নগরকে আন্তর্জাতিক মানের পর্যটন শহর হিসেবে গড়ে তুলতে চাই। চর বাকলিয়া এলাকাকে চিহ্নিত করে কাজ করছি। চর বাকলিয়ায় পর্যটন শিল্পের বিকাশ ঘটানোর সুযোগ আছে। সেখানে পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে ভূমি বরাদ্দ দেয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে বলেছিলাম। এখন ভূমি মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাব দিয়েছি।
মেয়র বলেন, ‘ওয়ান সিটি টু টাউন’ করার পরিকল্পনা আছে। শহরের কেন্দ্রীয় এলাকার চাপ কমাতে এবং নাগরিক সেবা সহজলভ্য করতে শহরকে দুই অঞ্চলে ভাগ করে পরিকল্পিত উন্নয়ন করা হবে। একটি অঞ্চল থাকবে বর্তমান নগর কেন্দ্র, অপরটি হবে কর্ণফুলী নদীর অপর পাড়ের নতুন টাউনশিপ।
কী আছে ভূমি বরাদ্দের প্রস্তাবে : ভূমি মন্ত্রণালয়ে দেয়া মেয়রের প্রস্তাবনায় বলা হয়– ওয়ান সিটি টু টাউন বাস্তবায়নসহ বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য পর্যটন শিল্প গড়ে তোলার লক্ষ্যে চট্টগ্রাম শহরের কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুর দেড় কিলোমিটার অদূরে নদীর মাঝখানে জেগে ওঠা বোয়ালখালী উপজেলার চর বাকলিয়া মৌজার ৩২৩ থেকে ৫৪৪ দাগের ২০০ একর খাসজমি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের অনুকূলে বন্দোবস্ত প্রদান করা প্রয়োজন। প্রস্তাবনায় বলা হয়, কর্ণফুলী নদীর কূলঘেষে জেগে ওঠা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত এই চরাঞ্চলে আধুনিক ও বিশ্বমানের পর্যটন শিল্প বাস্তবায়ন করা গেলে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে। সেই সাথে দেশি–বিদেশি অনেক পর্যটক সৌন্দর্য উপভোগ করতে চট্টগ্রামে আসবেন। এটা দেশের অর্থনীতির ভিত মজবুতকরণে সহায়ক হবে।
‘ওয়ান সিটি টু টাউন’–এর বিষয়ে একই প্রস্তাবনায় বলা হয়, বর্তমানে চট্টগ্রাম মহানগরীতে প্রায় এক কোটি জনসংখ্যার বসবাস। এছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ চিকিৎসা, ব্যবসা, অফিস–আদালতের জরুরি কাজ ও অন্যান্য প্রয়োজনে এই মহানগরীতে আগমন করে থাকেন।। কিন্তু এই বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য মহানগরীতে স্বাস্থ্য সুরক্ষা ও বিনোদনের তেমন কোনো সুযোগ–সুবধা বিদ্যমান নেই। এই বিশাল জনসংখ্যার প্রয়োজনে সিটি কর্পোরেশন এলাকায় পর্যাপ্ত পর্যটন কেন্দ্রসহ অবকাঠামোগত উন্নয়নের প্রয়োজন রয়েছে। কিন্তু অবকাঠামোগত উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক জমি না থাকায় কর্ণফুলী নদীর দক্ষিণ পাড় সিটি কর্পোরেশনের অন্তর্ভুক্ত করে ওয়ান সিটি টু টাউন বাস্তবায়নের কার্যক্রম চলমান রয়েছে।
জানা গেছে, শাহ আমানত সেতু থেকে আনুমানিক দেড় কিলোমিটার উজানে নদীর মাঝখানে চর বাকলিয়া। ১৯৩০ সালে অর্থাৎ কালুরঘাট সেতু নির্মাণের কারণে পলি জমে ধীরে ধীরে নদীর মাঝখানে এই চর জেগে ওঠে। বর্তমানে চরটি সরকারি ১ নম্বর খাস খতিয়ান ভুক্ত।
বেসরকারি উন্নয়ন ও গবেষণা সংস্থা ইফেক্টিভ ক্রিয়েশন অন হিউম্যান ওপিনিয়ন (ইকো) ২০২২ সালে তাদের একটি গবেষণায় চর বাকলিয়ার উদ্ভিদবৈচিত্র্য তুলে ধরে এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধিকল্পে সে গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করে। গবেষণায় চর বাকলিয়ায় মোট ১৫৫ প্রজাতির উদ্ভিদ সনাক্ত করা হয়। যার মধ্যে ৬৪ প্রজাতির বৃক্ষ, ২০ প্রজাতির বিরুৎ, ৫৭ প্রজাতির গুল্ম, ১২ প্রজাতির লতানো উদ্ভিদ ও পরাশ্রয়ী উদ্ভিদের সংখ্যা ছিলো ২ টি। ১৫৫ টি উদ্ভিদের ভিতর ১১৩ টি ঔষধি গাছ বিদ্যমান। চরে গাছপালার মধ্যে– পাহাড়ি শিমুল, বেগুণি হুরহুরি, প্রাজাসেন্ট্রা, হরগোজা, ভূঁই উকড়া, ঝুমকো লতা, আকন্দ, স্বর্ণলতা, ঘাগড়া, শিয়াল কাঁটা, শিরিষসহ নানা প্রজাতির উদ্ভিদ আছে। এছাড়া দেশীয় আম, জাম, কাঁঠাল, নারিকেলসহ নানা রকমের ফলজ গাছও আছে।
চসিক সূত্রে জানা গেছে, ২০২৩ সালে চীনের প্রতিষ্ঠান ‘সেভিয়া–চেক–অর্চাড জেভি’র ‘চর বাকলিয়া’য় বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্লান্ট বসাতে চসিককে প্রস্তাব দেয়। ওই প্রস্তাবে সম্মতি দেয় স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়। প্লান্ট বসাতে চর বাকলিয়ায় ৩৫ একর খাস ভূমি বন্দোবস্ত এর জন্য চসিককে প্রশাসনিক অনুমোদনও দেয়। এরপর বর্জ্য থেকে বিদ্যুৎ প্লান্ট বসাতে চসিকের অনূকূলে প্রতীকী মূল্যে ভূমি বরাদ্দ চেয়ে মন্ত্রণালয়ে আবেদন করা হয়। খাস জমি বন্দোবস্ত পাওয়া গেলে তা ‘সেভিয়া–চেক–অর্চাড জেভি’র ব্যবহারে আপত্তি নেই বলে জানায় চসিক। তবে সেখানে বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনে আপত্তি জানায় পরিবেশবাদীরা। সরকার পতনের পর ২০২৪ সালের অক্টোবর মাসে প্রকল্পটি বাতিল করা হয়।