চন্দ্রকুমার ও রূপবতী রাজকন্যা

ইসমাইল জসীম | বুধবার , ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৫ at ৮:১৭ পূর্বাহ্ণ

অনেক অনেক দিন আগের কথা। পূর্বদিকে ছিল এক শান্ত ও সমৃদ্ধ রাজ্য চাঁদপুর। রাজ্যটি ছিল পাহাড়, নদী আর বনে ঘেরা। চাঁদপুরের রাজা সৌমিত্র ছিলেন প্রজাদের প্রতি দয়ালু ও সুবিচারক। তাঁর একমাত্র পুত্র চন্দ্রকুমার ছিলো প্রজাদের অশেষ ভালোবাসার পাত্র।

চন্দ্রকুমার ছোটবেলা থেকেই আলাদা ছিলো। সে পাখির সঙ্গে কথা বলতো, বনের পশুপাখিকে সাহায্য করতো, আর রাজপ্রাসাদের প্রত্যেক চাকরের সঙ্গে বন্ধুর মতো ব্যবহার করতো। সে মায়াবী, সাহসী আর খুব বুদ্ধিমান ছিলো। রাজপ্রাসাদের জ্যোতিষী একদিন বলেছিলেন, এই রাজপুত্র একদিন এমন এক কাজ করবে, যার জন্য চিরকাল মানুষ তাকে মনে রাখবে।

এক বিকেলে রাজপ্রাসাদের বাগানে হেঁটে বেড়ানোর সময় চন্দ্রকুমার দেখল, দরিদ্র এক বৃদ্ধা রাজপ্রাসাদের দরজায় এসে ক্লান্ত হয়ে বসে পড়েছে। কেউ তাকে পানি পর্যন্ত দেয়নি। রাজপুত্র নিজ হাতে বৃদ্ধাকে পানি খাওয়ালো, ফল দিল, বিশ্রামের ব্যবস্থা করল।

বৃদ্ধা কৃতজ্ঞ চোখে তার দিকে তাকিয়ে বলল,

রাজপুত্র, তুমি শুধু দয়া নয়, তুমি সত্যিকারের রাজকুমার। মনে রেখো, তোমার সামনেই রয়েছে এক কঠিন পথ। কিন্তু হৃদয় ও সাহস নিয়ে সে পথ পেরোলে তুমি এক রাজকন্যার মুক্তি দিতে পারবে।’

চন্দ্রকুমার তখন এসব কথার মানে বুঝতে পারেনি, কিন্তু সে বৃদ্ধার মুখে কিছু একটার ইঙ্গিত টের পেয়েছিলো।

সেই রাতে রাজপুত্র এক অদ্ভুত স্বপ্ন দেখলো দেখলো এক প্রাসাদের আঙিনায় দাঁড়িয়ে আছে পাথরের মতো নিথর এক রাজকন্যা। তার চোখে যেন হাজার বছরের কান্না জমা। হঠাৎ এক বিশাল নাগিনী এসে বলল,

তুমি যদি তাকে ভালোবাসো, তবে প্রমাণ করো। তিনটি বাধা পার হয়ে এসো আগুনের পাহাড়, বরফের অরণ্য আর ধাঁধার গুহা।’

ঘুম ভেঙে যাওয়ার পরেও সে স্বপ্নের ছবি তার মনে গেঁথে ছিল। রাজা ও রানিকে সব খুলে বলায়, রাজা কিছুটা চিন্তিত হলেও, ছেলের সাহস ও বিচক্ষণতায় বিশ্বাস রেখে অনুমতি দিলেন।

চন্দ্রকুমার ঘোড়ায় চড়ে বেরিয়ে পড়ল। তিন দিন তিন রাত চলার পর সে পৌঁছালো আগুনের পাহাড়ে। সেখানে আগুনের গর্জনে পথ চলা প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সে ভয় না পেয়ে এগিয়ে গেল। হঠাৎ আগুনের মাঝে উঠে এলো এক দৈত্য।

দৈত্য গর্জে উঠল, ‘কে আসে আমার আগুন পাহাড়ে? জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যাবি!’

চন্দ্রকুমার সাহস করে বলল, ‘আগুন ধ্বংস করে ঠিক, তবে সে আলো দেয়, জীবনেও প্রয়োজন হয় তার। আমি ধ্বংস নয়, আলো খুঁজতে এসেছি।’

দৈত্য থেমে গেল। তার আগুনের রূপ নিভে গিয়ে সে এক সোনালি মূর্তি হয়ে গেল। বলল, ‘তুই সত্য বলেছিস, পথ তোর জন্য খুলে দিলাম।’

চন্দ্রকুমার পাহাড় পার হয়ে এগিয়ে গেল বরফের অরণ্যের দিকে।

এখানে সব ছিল বরফে ঢাকা। গাছের পাতা নেই, পাখি নেই, শুধু সাদা শূন্যতা। ঠান্ডা এতই তীব্র যে শ্বাস নেওয়াই কষ্টকর। পথে সে দেখতে পেল কিছু হরিণ, খরগোশ আর ছোট পাখি বরফে জমে যাচ্ছে।

রাজপুত্র নিজের কোট খুলে পশুপাখিদের জড়িয়ে ধরল, আগুন জ্বেলে তাদের উষ্ণতা দিল। সে বুঝেছিলো এই অভিশাপ কেবল দয়ার মাধ্যমে ভাঙা যাবে।

যেই না সে নিঃস্বার্থভাবে প্রাণীগুলোকে রক্ষা করল, অরণ্য থেকে বরফ গলতে শুরু করল। গাছেরা পাতা মেলল, পাখিরা গান গাইতে লাগল।

চন্দ্রকুমার এগিয়ে চলল শেষ ও সবচেয়ে কঠিন পথে ধাঁধার গুহার দিকে।

এই গুহার ভেতরে এক অন্ধকার পরিবেশ। হঠাৎ সে শুনতে পেল এক কণ্ঠস্বর

তুমি কি আলো চাও না কি সত্য?

বলো কে অন্ধকারেও পথ খুঁজে পায়?’

চন্দ্রকুমার চোখ বন্ধ করে গভীরভাবে ভাবল। তারপর বলল,

যে হৃদয়ে সত্য থাকে, সেই চোখ বন্ধ রেখেও আলো দেখতে পারে।’

অমনি অন্ধকারে আলো ফুটল। গুহা কাঁপতে কাঁপতে পথ খুলে দিল।

চন্দ্রকুমার পৌঁছাল এক পরিত্যক্ত প্রাসাদে। সেখানে সত্যিই পাথরে পরিণত এক রাজকন্যা দাঁড়িয়ে ছিল। তার চোখ বুজে, ঠোঁট থেমে, হৃদয় নীরব। ঠিক তখনই সেই নাগিনী এসে বলল,

তাকে ফিরে পেতে হলে তোর হৃদয় দিয়ে সত্যিকারের প্রেম প্রমাণ করতে হবে। নিজের কিছু চাওয়ার নেই তবেই সে মুক্তি পাবে।’

চন্দ্রকুমার ধীরে গিয়ে রাজকন্যার চোখের সামনে দাঁড়াল। চোখে জল নিয়ে বলল,

তোমার মুক্তির জন্য আমি আমার জীবনও দিতে রাজি, কারণ তুমি কেবল এক রূপবতী নও তুমি একজন ন্যায়ের প্রতীক। আমি চাই না তুমি শুধু ফিরে আসো, আমি চাই সত্য জয়ী হোক।’

তার চোখের অশ্রু পড়ে যেতেই পাথর ভাঙতে শুরু করল। রাজকন্যা চোখ খুলল। ধীরে ধীরে সে প্রাণ ফিরে পেল।

তার নাম ছিল রূপবতী। এক অভিশপ্ত রাজার অভিশাপে সে পাথর হয়েছিল শত বছর আগে। সে জানত না কোনোদিন মুক্তি পাবে কিনা। চন্দ্রকুমার তাকে ফিরে আনল চাঁদপুরে।

সেখানে মহা উৎসব হলো। রাজা সৌমিত্র রূপবতীকে নিজের কন্যা বলে গ্রহণ করলেন। কিছুদিন পর চন্দ্রকুমার রাজ্যভার গ্রহণ করল, আর রূপবতী তার পাশে হয়ে উঠল এক সত্যিকার রানি।

চন্দ্রকুমার আর রূপবতী রাজত্ব করতেন ভালোবাসা, ন্যায় আর সাহস দিয়ে। তাদের রাজ্যে কেউ অনাহারে থাকত না, কেউ অবিচারে কাঁদত না।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরহস্যেঘেরা অ্যান্টার্কটিকা
পরবর্তী নিবন্ধহালদায় অভিযান সাড়ে ৫ হাজার মিটার জাল জব্দ