চন্দনাইশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন : সমস্যা ও সম্ভাবনা

অভীক ওসমান | শনিবার , ১৮ নভেম্বর, ২০২৩ at ৫:৪৭ পূর্বাহ্ণ

আজি দখিন দুয়ার খোলা : সাম্প্রতিক সময়ে নানাবিধ বৈরী বাতাসে দেশের মানুষ যখন কিছুটা উৎকণ্ঠায় দিন যাপন করছেন, ট্রিলিয়ন ডলার ইকোনমির এই বাংলাদেশে গত ২৮ অক্টোবর ২০২৩ চট্টগ্রামে আমাদের সুপ্রিমো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কর্ণফুলী নদীর তলদেশের দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম টানেল বর্ণিল উৎসবমুখর পরিবেশে উদ্বোধন করলেন। খুলে গেলরেস্ট অব দি কান্ট্রির সাথে আমাদের দ্বিতীয় সীমান্ত টেকনাফ পর্যন্ত বিশাল অর্থনৈতিক সম্ভাবনার দুয়ার। দক্ষিণ চট্টগ্রামের সন্তান সাংবাদিক ওমর কায়সার রচনা করলেন ‘দইজ্জার তলে চলের গাড়ি’। বাস্তবায়িত হতে যাচ্ছে ‘ওয়ান টাউন টুইন সিটির স্বপ্ন’। শতাব্দীর স্বপ্ন দোহাজারীকক্সবাজার রেলপথ, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রাক্কালে, গ্লোবালাইজেশনের সময় যে সুবর্ণ সুযোগ তৈরি হলো। একটা অর্থনৈতিক উন্নয়নের বসন্ত এসে গেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই অঞ্চল ইকনমিকপাওয়ার হাউজে রূপান্তরিত হচ্ছে। সামগ্রিকভাবে টোটাল কানেক্টিভিটি কার্যকর হলে ১% জিডিপি বৃদ্ধি পাবে। এই উন্নয়নের রোড ম্যাপের মাঝখানে আমাদের জনপদ চন্দনাইশের অবস্থান। রবীন্দ্রনাথের ভাষায় ‘আজি দখিন দুয়ার খোলা’।

অবস্থান ও আয়তন : চন্দনাইশ উপজেলার আয়তন ২০১.৯৯ বর্গ কিলোমিটার (৪৯,৯১৩ একর)। চট্টগ্রাম জেলা সদর থেকে এ উপজেলার দূরত্ব প্রায় ৩৫ কিলোমিটার। এ উপজেলার উত্তরে রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ও পটিয়া উপজেলা; পশ্চিমে পটিয়া উপজেলা, আনোয়ারা উপজেলা ও সাতকানিয়া উপজেলা; দক্ষিণে সাতকানিয়া উপজেলা এবং পূর্বে সাতকানিয়া উপজেলা ও বান্দরবান জেলার বান্দরবান সদর উপজেলা অবস্থিত।

অর্থনীতিব্যবসা বাণিজ্য : ব্যবসাবাণিজ্যের দিক থেকে চন্দনাইশের যথেষ্ট ঐতিহ্য ও সুনাম রয়েছে। এ অঞ্চলে উৎপাদিত পেয়ারা সমগ্র দেশে বিক্রি হয়। বিশেষ করে কাঞ্চননগরের পেয়ারা অতি সুস্বাদু ও জনপ্রিয়। চন্দনাইশের হাশিমপুর ও কাঞ্চননগর গ্রামে রয়েছে প্রায় ২ হাজার পেয়ারা বাগান। তাছাড়া লেবু ও আনারস ব্যবসার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। চন্দনাইশ এর সবজি দেশের চাহিদা মিটিয়ে থাকে। চন্দনাইশের শঙ্খ নদীর চরে বিপুল পরিমাণ বালি পাওয়া যায়। তাছাড়া পাহাড়ি কাঠ দেশের আসবাবপত্র তৈরিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করছে। ব্যবসা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে বাঁশের চালি অবদান রাখছে। পাহাড়ী ছন গরীব মানুষের চাহিদা থাকায় বিভিন্ন অঞ্চলে বিক্রয় হচ্ছে।

ব্যাংক : বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম জীবনীশক্তি হলো ব্যাংক এবং এই ব্যাংকগুলো দেশের মুদ্রা বাজারকে রাখে গতিশীল ও বৈদেশিক বাণিজ্যকে করে পরিশীলিত। চন্দনাইশ উপজেলায় ৩০টি ব্যাংকের শাখা অবস্থিত।

দর্শনীয় স্থান : চন্দনাইশ উপজেলার দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে : শুক্লাওম্বর দীঘি এর মেলা, জামিরজুরি বধ্যভূমি সহ মসজিদ, মন্দির, বৌদ্ধ বিহার সহ মোট ২৪টি স্পট। তাছাড়া মনীষীদের জন্মস্থান গুলো দর্শনীয় স্থান হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।

আমরা অতি অনিবার্যভাবে স্মরণ করছিমাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, দেশপ্রিয় যতীন্দ্রমোহন সেনগুপ্ত, যাত্রামোহন সেন, ভাষা সৈনিক প্রিন্সিপাল আবুল কাসেম, আহমদ ছফা সহ চন্দনাইশের শহীদ মুক্তিযোদ্ধাগণকে। যারা চন্দনাইশ তথা দেশের উন্নয়ন কাজ করে গেছেন।

অতীতে এমপি ও মিনিস্টার ছিলেন কর্ণেল অলি আহমেদ বীর বিক্রম। তিনি চন্দনাইশ অবকাঠামোর উন্নয়নের জন্য কাজ করে গেছেন। এমনকি রোডস এন্ড হাইওয়েজের দক্ষিণাঞ্চল অফিস দোহাজারীতে স্থানান্তর করেন। এক এগারো’র সময় চন্দনাইশের কৃতী সন্তান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক শিক্ষা ও বাণিজ্য উপদেষ্টা শিক্ষা ও অবকাঠামো উন্নয়ন করেছেন।

গত দেড় দশক ধরে আমাদের প্রিয় জ্যেষ্ঠজন নজরুল ইসলাম চৌধুরী এমপি অনেক উন্নয়ন করেছেন। তার উন্নয়নের ৩৩টি পয়েন্ট সংগ্রহ করেছি। এই ৩৩টি পয়েন্ট চন্দনাইশসাতকানিয়া (আংশিক) নির্বাচনী এলাকার। সোলার স্থাপন, ভোকেশনাল ট্রেনিং ইন্সটিটিউট ছাড়া সবগুলিই রুটিন কাজ। তার মধ্যে ৩,,,,১৩,২৬ পয়েন্ট চলমান, প্রক্রিয়াধীন, টেন্ডার পর্যায়ে রয়েছে। তবে ২০১৮ এই ডায়ালগে ইকনমিক জোনের জন্য তিনি ডিও লেটার ইস্যু করেছেন। তা কার্যকর হয়নি। চন্দনাইশ উপজেলা মডেল মসজিদ থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি। শংখ নদীর ভাঙন রোধে ২০ কিলোমিটার প্রতিরক্ষা বাঁধের জন্য ৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ের কথা বলেছেন। সূত্রমতে সেখানে সিলটেশন হচ্ছে। কিছু ড্রেসিং হয়েছে। অধিক ড্রেসিং প্রয়োজন এ ব্যাপারে ওয়াটার ডেভেলপমেন্টের সাথে যোগাযোগের প্রয়োজন রয়েছে।

ধোপাছড়িতে এগ্রোবেসড শিল্পায়ন ও পর্যটন স্পটের সম্ভাবনা : গত শতাব্দীর চট্টগ্রাম চেম্বারে “অভ্যন্তরীণ সম্পদের সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহার” একটা আন্দোলন শুরু হয়েছিলো। আমাদেরকেও চন্দনাইশের অভ্যন্তরীণ সম্পদ ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে।

শংখ নদী তীরবর্তী ধোপাছড়ি নদী জলসমতলপাহাড়ে সমৃদ্ধ। অনেক বিদেশি ও এই এলাকার পর্যটনের সৌন্দর্য উপভোগ করেছেন। যেহেতু ধোপাছড়ি দিয়াকুল থেকে দোহাজারী হয়ে শংখতীরবর্তী বরমা অঞ্চল হচ্ছে রবিশস্যের ভাণ্ডার নামে খ্যাত। গরিংগাহাট নামে একটি বিখ্যাত গঞ্জ ছিলো। এই জনপদের বিশেষ বেগুন, আখ ইত্যাদি বিখ্যাত। এই এলাকায় সরকার একটি এগ্রো বেইজড শিল্পাঞ্চল ও পর্যটন গড়ে তুলতে পারেন। নতুবা পিপিপির আওতায় করা যায়।

চানখালী তীরবর্তী সম্ভাবনা : চানখালী বিধৌত আনোয়ারা বাঁশখালী সংশ্লিষ্ট এলাকা বরকল বরমায় ‘টিনের হাট’ এখন বিলুপ্ত। যাত্রা মোহন সেন লঞ্চ যাত্রীদের জন্য একটি টিনশেড করে দিয়েছিলেন। পরে এটি রমজান আলী চৌধুরী নামে শনি ও বুধবার বসত। যা এখন নিলামের অভাবে বিলুপ্ত। চাঁনখালী তীরবর্তী এই গঞ্জ বাঁশখালীআনোয়ারাচন্দনাইশকে সংযুক্ত করেছে। ফার্নিচার, বালি সংরক্ষণ, লবণ, মৎস্য ইত্যাদি খাতে একটা মিনি শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলা যায়।

লালদীঘির মেলায় যে বিখ্যাত হাত পাখা উঠে তা আমাদের চন্দনাইশের ঐতিহ্য। আরব আমিরাতে যে হাতে বোনা টুপি রপ্তানি হতো তাও চন্দনাইশের শাহ আলম কোম্পানীর। জোয়ারা সাতবাড়ি নৌ আরগা পারা খ্যাত মৃৎশিল্পের পীঠস্থান ছিল। কাঞ্চননগরের কাছে এক ধরনের থামী গামছা বোনা হতো। কর্পোরেট পুঁজির কাছে তা বিলুপ্ত হয়ে গেছে। সুতরাং বিলুপ্ত প্রায় শিল্পগুলোকে চন্দনাইশের ঐতিহ্যের স্বার্থে পুনর্জীবিত করা দরকার।

চন্দনাইশ পৌরসভায় কুইশাল্লামার সেতু সংশ্লিষ্ট বরুমতি বড় খালের মোহনায় আখতারুজ্জামান চৌধুরী সরোবর নামে বিনোদন অঙ্গন গড়ে উঠেছে। এতে মুক্তমঞ্চ, কমিউনিটি সেন্টার, লেক ইত্যাদি থাকবে। এটা পর্যটন হিসেবে গড়ে উঠবে এবং কর্মসংস্কারমুখী হবে।

আমাদের ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানগণ নিজ নিজ এলাকায় যে ঐতিহ্য ঐতিহাসিক ও দর্শনীয় স্থান তা নিজ উদ্যোগে উন্নয়ন করতে পারেন। উদাহরণস্বরূপ মাওলানা ইসলামাবাদী, দেশপ্রিয় যতীন্দ্র মোহন সেন, প্রিন্সিপাল আবুল কাশেম, আহমদ ছফা এদের বাড়ি জাতীয় জাদুঘরের সহায়তায় দর্শনীয় স্থান হিসেবে সংরক্ষণ করতে পারবেন।

চন্দনাইশে বেসরকারী খাতে উন্নয়ন : আমরা জানি, সকল উন্নয়ন ও কল্যাণ রাষ্ট্র ও সরকারের পক্ষে সম্ভব নয়। চন্দনাইশে বেসরকারি খাতের সেবা ও উন্নয়ন কাজ বেশ প্রশংসনীয়। চন্দনাইশ সমিতি তাদের শিক্ষা স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি উন্নয়নে ১৭টি পয়েন্ট পেশ করেছে। তারা ১৫ নং পয়েন্টে বলেছেন প্রান্তিক কৃষকদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করেছেন। ১৭ নং পয়েন্টে বলছেন আগামীতে কর্মসংস্থানের জন্য চন্দনাইশ কেরিয়ার কার্নিভাল হিসেবে পরিচিত হবে। তারা একটা হাসপাতাল তৈরি করবে। আমরা মনে করি, এখানে করোনা জাতীয় অদৃশ্য রোগ, ডায়বেটিস এগুলোর প্রাধান্য থাকবে। আমার মনে হয় না এরকম উদ্যোগ অন্য কোন থানায় রয়েছে। একই সাথে চন্দনাইশ ছাত্র সমিতি, চন্দনাইশ ছাত্র ঐক্যও কাজ করে যাচ্ছে।

চন্দনাইশে কর্মরত বেসরকারি সংস্থার কার্যক্রম : ওডেবসমাজ উন্নয়ন, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, নারীর ক্ষমতায়ন ও নারীর প্রতি নির্যাতনবৈষম্য প্রতিরোধ কার্যক্রম। পল্লী প্রগতি সংস্থা– (পিপিএস)- শিক্ষা কার্যক্রম, শিশু অধিকার কার্যক্রম, ইপসাসমাজ উন্নয়ন, দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, নারীর প্রতি নির্যাতন, বৈষম্য প্রতিরোধ কার্যক্রম, তামাক আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিতকরণ, মানব পাচার প্রতিরোধ কার্যক্রম, ক্ষুদ্র উদ্যক্তা উন্নয়নের জন্য অর্থনৈতিক ক্ষমতায়ন কার্যক্রম। কারিতাসক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, নিরাপদ অভিবাসন কার্যক্রম, ব্র্যাকশিক্ষা কার্যক্রম, ক্ষদ্র ঋণ কার্যক্রম, নিরাপদ অভিবাসন কার্যক্রম, হীড বাংলাদেশক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, সূর্যের হাসি ক্লিনিকস্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম, গর্ভবতী মায়ের স্বাস্থ্য সেবা কার্যক্রম, নিরাপদ মাতৃত্ব ও পরিবার পরিকল্পনা কার্যক্রম, বিচক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, প্রত্যাশীক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, নিরাপদ অভিবাসন কার্যক্রম’, আশাক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, মমতাক্ষুদ্র ঋণ কার্যক্রম, সমৃদ্ধি কার্যক্রম, নারীর ক্ষমতায়ন, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, নারীর প্রতি নির্যাতন বৈষম্য প্রতিরোধ। এখানে দেখা যাচ্ছে ১১টি এনজিওয়ের মধ্যে ৮টি মাইক্রোক্রেডিট ফাইনেনসিং এর সাথে জড়িত।

বর্তমান রুলিং পার্টি দ্বাদশ নির্বাচলের প্রাক্কালে কর্মসংস্থানকে প্রাধান্য দিয়ে ইশতেহার প্রণয়ন করছেন। চন্দনাইশ উন্নয়নকেও কর্মসংস্থানমুখী ভাবতে হবে। আমরা অবহিত হয়েছি যে, ফ্রেন্ডস গ্রুপচন্দনাইশ সদরের কমার্শিয়াল মার্কেট কাম রেসিডেন্সিয়াল একটা প্রকল্প করছেন। এটি পথিকৃৎ প্রকল্প। সিপিডিএল আনোয়ারায় আবাসন প্রকল্প সমপ্রসারিত করেছে। আমার মনে হয় এয়ারবেল এ ধরনের উদ্যোগ নিতে পারে। তাছাড়া রাজ টিম্বার, সালমা আদিল ফাউন্ডেশন বেসরকারি খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। অতীতে ‘পটিয়া টাউন এসোসিয়েশন’ থেকে চট্টগ্রাম চেম্বারে ইসি মেম্বার, ডাইরেক্টর পদে প্রতিনিধিত্ব করতো। বর্তমানে চন্দনাইশ ট্রেড এসোসিয়েশন গঠন করে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিয়ে তা করা যেতে পারে। চন্দনাইশের এক ইফতার সন্ধ্যায় ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী দক্ষিণ চট্টগ্রাম সমিতি গঠন করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন। আসুন ‘চন্দনাইশ টু দ্যা ফোর’ চন্দনাইশবাসী আমরা এই উদ্যোগ গ্রহণ করি।

লেখক : বরমা কলেজের প্রতিষ্ঠাকালীন অধ্যক্ষ, চট্টগ্রাম চেম্বারের সাবেক সচিব

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের অতিথি শিক্ষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধনতুন চট্টগ্রামকে দেখবে বিশ্বের মানুষ : চাই উন্নয়নের ধারাবাহিকতা
পরবর্তী নিবন্ধআবুরখীল গ্রামে ধুতাঙ্গ কুটিরে কঠিন চীবর দান অনুষ্ঠান