চট্টগ্রামের হাজার বছরের কৃষ্টি সাহিত্য সংস্কৃতি ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণে প্রস্তাবনা

কুমার প্রীতীশ বল | মঙ্গলবার , ২৫ জানুয়ারি, ২০২২ at ৮:০৮ পূর্বাহ্ণ

চারশো বছরের সামান্য বেশি কলকাতার বয়স। ঢাকার বয়স তারচেয়ে বেশি, পাঁচ শত বছর কিংবা সামান্য বেশি। কিন্তু চট্টগ্রামের বয়স হাজার বছরের বেশি। ভাবা যায়, কত প্রাচীন একটি জনপদের আমরা উত্তরাধিকার! এই প্রাচীন জনপদের নামকরণ নিয়ে আছে নানা মত। বলা হয়ে থাকে, ‘১৬৬৬ খ্রিস্টাব্দে মোগলরা আরাকানিদের হটিয়ে এই এলাকা দখল করে নিয়ে নাম রাখে ইসলামাবাদ। মোগলদের আগে জেলা হিসাবে চট্টগ্রামের কোনো প্রশাসনিক কাঠামো কিংবা স্থায়ী সীমা ছিল না। ১৭৬০ খ্রিস্টাব্দে মীর কাশিম আলী খানের কাছ থেকে এই জেলাটি অধিগ্রহণের পর ব্রিটিশরা এর নামকরণ করে চিটাগাং। চট্টগ্রাম চাটিগাঁও অথবা চাটগাঁও নামেও পরিচিত।..বৌদ্ধদের ধারণা, চট্টগ্রাম নামটা চৈত কেয়াং বা চৈতগ্রাম শব্দের অপভ্রংশ। চৈতগ্রাম অর্থ বৌদ্ধ কীর্তিস্তম্ভের আবাসস্থল। এশিয়াটিক সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা স্যার উইলিয়াম জোনস বলেছেন এই অঞ্চলের সবচেয় সুন্দর ক্ষুদে পাখি চটগা থেকে চট্টগ্রাম নামের উৎপত্তি। কারো কারো ধারণা, বৌদ্ধদের স্বর্ণ যুগে শহর ও আশেপাশের এলাকাকে আরাকানিরা চিটাগুং নামকরণ করেন।ফখরুদ্দিন মোবারক শাহএর চট্টগ্রাম বিজয়ের পূর্ব থেকে চট্টগ্রাম চাটিগাঁও নামে পরিচিত। এর সঙ্গে হযরত বদর শাহ’র (.) আধ্যাত্মিক কাহিনী জড়িত। ইসলাম প্রচারের জন্য হযরত বদর শাহ (.) চট্টগ্রাম এসে দৈত্যদানবের কাছ থেকে এক চাটি পরিমান জায়গা এবাদত করার জন্য খুঁজে নেন। চাটির আলো ও আজানের ধ্বনির বিস্তারে এলাকা থেকে দৈত্যদানবরা পালিয়ে যায়। চাটি থেকে চট্টগ্রামের নামকরণ হয়েছে বলে ব্যাপক জনশ্রুতি রয়েছে।১৮৬০খিস্টাব্দে চট্টগ্রাম পার্বত্য এলাকা নামে আলাদা একটি প্রশাসনিক ইউনিট গড়ে উঠে এবং ১৮৮১ খিস্টাব্দে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রামের মধ্যে স্থায়ী সীমারেখা টানা হয়।’(সিদ্দিক আহমেদ, হাজার বছরের চট্টগ্রাম, দৈনিক আজাদী, ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা)। ১৯৯১ সালের আদমশুমারীতে চট্টগ্রামের আয়তন ৫,২৮২,৯৮ বর্গকিলোমিটার উল্লেখ আছে। চট্টগ্রাম নামের হাজার বছরের প্রাচীন জনপদটির স্বাভাবিক কারণেই রয়েছে হাজার বছরের কৃষ্টিসাহিত্যসংস্কৃতিইতিহাসঐতিহ্য। কিন্তু দীর্ঘদিন তা সংরক্ষণ এবং তদারকের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেউ ছিল না।

২০০০ সালে গঠিত জেলা পরিষদে সরকার ২০১১ সালের ১৫ ডিসেম্বর পার্বত্য চট্টগ্রামের তিনটি জেলা বাদ রেখে বাকী ৬১টি জেলা পরিষদে প্রশাসক নিয়োগ দেন। ২০১৬ সালের ২৮ ডিসেম্বর প্রথমবারের মতো নির্বাচনের মাধ্যমে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধু জেলা গর্ভনর ব্যবস্থা চালু করে ১৯৭৫ সালের ২৩ জুন বাংলাদেশকে ৬১টি জেলায় বিভক্ত করে ৬১ জন গর্ভনর নিয়োগ দেন। চট্টগ্রামকে তখন দুটি ভাগে বিভক্ত করে অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ, এমপিকে চট্টগ্রাম এবং জাকিরুল হক চৌধুরীকে চট্টগ্রাম দক্ষিণের গভর্নরের দায়িত্ব অর্পণ করেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলে সবকিছু থমকে দাঁড়ায়। তারপর থেকে শুরু হয় উল্টোপথে যাত্রা। উল্টোপথের যাত্রীরা প্রায় ত্রিশ বছর ইতিহাস, ঐতিহ্যকে ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছে। সেই কালো ইতিহাসের অবসান ঘটিয়ে আলোর পথের যাত্রীরা আজ অদম্য বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে অঙ্গীকারাদ্ধ।

সেই আলোর পথের যাত্রীদের একজন চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রথম নির্বাচিত চেয়ারম্যান জনাব এম.এ সালাম। মেয়র যদি হন নগর পিতা, তাহলে চট্টগ্রাম জেলার ১৫টি উপজেলার নির্বাচিত অভিভাবক হলেন জনাব এম.এ সালাম। আমাদের ছাত্রজীবনে অগ্রজ ছাত্রযুব নেতা হিসাবে সালাম ভাইকে খুব কাছ থেকে দেখেছি। আন্দোলনসংগ্রামের অসংখ্য স্মৃতি এখনও মানসপটে ভাসে। তিনি অনেক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। তাঁকে দীর্ঘদিন বাড়িমুখী হতে দেয়নি হন্তারক বাহিনী। তাঁকে অনেকবার চেষ্টা করা হয়েছে হত্যার। খুন হয়েছেন তাঁর অনেক প্রিয়জন হন্তারক বাহিনীর হাতে। বাঙালির ইতিহাসঐতিহ্যসংস্কৃতি সম্পর্কে তাঁর অপরিসীম ভালোবাসা আছে। শতভাগ দেশপ্রেমিক, অসাম্প্রদায়িক এই মানুষটির দল ও দেশের প্রতি আনুগত্য শতভাগ। হাটহাজারি থেকে মনোনয়ন না দেওয়ায় কষ্ট পেলেও দলের বিরুদ্ধবাদী হননি। রাজনীতিতে তিনি হলেন প্রচারবিমুখ মানুষ। তাই, প্রথমবার চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান হিসাবে তাঁর নাম ঘোষিত হলে কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম। চ্‌টগ্রামের রাজনীতিতে আমার একজন প্রিয় মানুষকে জেলা পরিষদের দায়িত্ব প্রদানে চট্টগ্রামের কৃষ্টিশিল্পসংস্কৃতিইতিহাসঐতিহ্য সংরক্ষণ ও উন্নয়নে আশাবাদী হয়ে উঠি। দীর্ঘদিনের লালিত বিশ্বাস এবং আস্থার জায়গা থেকে তাই তাঁর সমীপে প্রস্তাবনাসমূহ পেশ করছি। বিষয়টা এমন নয় যে, তিনি এসব কিছু সম্পর্কে অবগত নন, চট্টগ্রামের সন্তান হিসাবে মাটি ও মানুষের সমস্ত খবর তাঁর অন্তর্গত। এখানে আমি শুধু একটি আলোকিত জনপদ নির্মানের লক্ষ্যে চট্টগ্রামের হাজার বছরের ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য কিছু স্বপ্ন বিনিময় করছি। চট্টগ্রামকে বীর চট্টগ্রাম সম্বোধনে সুকান্ত কবিতা লিখেছিলেন অসংখ্য বীর গাঁথার কারণে। সে সব বীরদের অনেকে আজ ইতিহাসের বিস্মৃতির পাতায় চলে গেছেন। আজকের প্রজনন্ম জানে না পূর্বপুরষদের সে সব বীরগাথা। অনেককে নামে এখনও সবাই চিনেন এবং জানেন, কিন্তু জন্মস্থান এবং অবদান সম্পর্কে বিস্তারিত অবগত নন। মনে করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে আমাদের। আমার বিশ্বাস, মনে করিয়ে দেওয়ার এ দায়িত্ব নিতে চেয়ারম্যান জনাব এম এ সালাম সবদিক থেকে প্রস্তুত।

প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করতে চাই, চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন তত্ত্বাবধানে জামাল খানের কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন একটি প্রসংশনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। আমি অন্য একটি লেখায় অনুসরণীয় এই দৃষ্টান্ত সম্পর্কে বিস্তারিত লিখে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছি। সম্প্রতি সেই প্রশংসনীয় উদ্যোগের ধারাবাহিকতার দ্বিতীয় পর্যায়ে আরও ৩১ জন বরেণ্য ব্যক্তিত্বের ম্যুরাল কাউন্সিলর শৈবাল দাশ সুমন মহসিন কলেজের দেয়ালে স্থাপন করেছেন। এখানে জালালাবাদ যুদ্ধের সেনাপতি, চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের অন্যতম বিপ্লবী, সূর্যসেনের অনুসারী লোকনাথ বলের জন্ম কোলকাতা উল্লেখ করা হয়েছে। তথ্যটি ঠিক নয়। সঠিক তথ্য হলো বিপ্লবী লোকনাথ বলের জন্মস্থান চট্টগ্রাম জেলার বোয়ালখালি থানার ধোরলা গ্রামে। এ বীরের রক্তের উত্তরাধিকারী হিসাবে আমরা অনেকে এখনও চট্টগ্রামে বসবাস করছি। একটা সময়ে সংখ্যাধিক্যের কারণে বল পরিবারের সদস্যরা ধোরলাকানুনগোপাড়া দুই গ্রাম মিলিয়ে বসবাস করতেন। বিপ্লবী লোকনাথ বলের জন্মভিটা এখনও ধোরলা গ্রামে আছে, তবে বেদখল অবস্থায়। বিপ্লবী লোকনাথ বল মৃত্যুবরণ করেন কোলকাতায়। নগর পিতা এবং কাউন্সিলর মহোদয়কে বিনীত অনুরোধ করব ভুলটি সংশোধনের। একই সঙ্গে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের কাছে প্রস্তাব করব, এ চট্টগ্রাম বীর প্রসবিনী। যেমন কমরেড মোজাফর আহমদের বাড়ি সন্দ্বীপ। তিনি এ উপমহাদেশের কমিউনিস্ট আ্‌েদালনের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব। চৌধুরী হারুণউর রশীদ’র জন্মস্থান পটিয়া, অধ্যাপক পুলিন দে’র বাড়ি ধলঘাট, এই ধলঘাটে আরও জন্মগ্রহণ করেছেন পূর্ণেন্দু দস্তিদার, বিপ্লবী প্রীতিলতা। সূর্যসেনের সঙ্গে ফাঁসির কাষ্ঠে আত্মাহুতি প্রদানকারী তারকেশ্বর দস্তিদারের বাড়ি বোয়ালখালি থানার সারোয়াতলী গ্রামে, বোয়লখালীর শ্রীপুর গ্রামে কল্পনা দত্তের বাড়ি, ধোরলা কানুনগোপাড়ায় সুবোধ বল, লোকনাথ বল, শহীদ টেগারা বল, শহীদ প্রভাস বল প্রমুখ। এছাড়াও সূর্যসেন, বিনোদ চেীধুরী, মহিউদ্দিন চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ, এম. . হান্নান, এম.এ মান্নান, আকতারুজ্জামান চৌধুরী বাবুসহ হাজার বছরের চট্টগ্রামের বিভিন্ন জনপদে যেসব বীরের জন্ম হয়েছে, তাঁদের সবার জন্মভিটায় স্মৃতিফলক স্থাপনের মাধ্যমে ইতিহাসের দায় মুক্তি ঘটাতে হবে। শুধু রাজনীতি নয়, শিল্পসাহিত্যসংস্কৃতির ক্ষেত্রেও আছেন হাজার বছরের চট্টগ্রামের অবিস্মরণীয় অবদান। হাটাজারিতে আলাওলের পদ্মাবতী, পটিয়ার সুচক্রদন্ডী গ্রামের আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ, আহমদ শরীফ, রাউজানের কবি নবীন চন্দ্র সেন, আবদুল হক চৌধুরী, ধলঘাটের শশাঙ্ক মোহন সেন, কানুনগোপাড়া গ্রামের উপমহাদেশের প্রতীতযশা ঐতিহাসিক কালিকা রঞ্জন কানুনগো, রত্নগর্ভা মুক্তাকেশী, . বিভূতি ভূষণ দত্ত, সাতকানিয়া উপজেলার কেঁওচিয়া গ্রামের সাহিত্যিক আবুল ফজল, সৈয়দ ওয়ালিওল্লাহ, মাহাবুব আলম চৌধুরী, সুচরিত চৌধুরী, নৃত্য শিল্পী বুলবল চৌধুরী, রুনু বিশ্বাস, সংগীত শিল্পী শেফালী ঘোষ, শ্যাম সুন্দর বৈষ্ণব, মলয় ঘোষ দস্তিদার, কবিয়াল রমেশ শীল, ফনিভ্থষণ বড়ুয়া, রাই গোপাল দাশ, সাংবাদিকসাহিত্যিক লোকমান খান শেরওয়ানী এবং তাঁর অনন্য সঙ্গী শিশির কণা (বিবাহ পরবর্তী নাম শবনম খানম শেরওয়ানী), অধ্যাপক মোহম্মদ খালেদ, মাহাবুব আলম, ইঞ্জিনিয়ার আবুদল খালেক, শেখচাটগাম খ্যাত কাজেম আলী মাস্টার, আসকর আলী পন্ডিত প্রমুখ। একটি সার্চ কমিটির মাধ্যমে তালিকা তৈরি করে প্রত্যেকের অবিস্মরণীয় অবদানকে নতুন প্রজন্মের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার জন্য জন্মভিটায় স্মৃতিফলক নির্মাণ করতে হবে। মহসিন কলেজের অনুরূপ চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন স্কুলকলেজের দেয়ালে চট্টগ্রামের সব বিশিষ্টজনদের ম্যুরাল তৈরি করার মাধ্যমে তাঁদের অমর গাঁথাকে স্মরণীয় করে রাখতে হবে। জেলা পরিষদের নতুন ভবন হচ্ছে। এখানে একটি মিউজিয়াম হতে পারে লন্ডনের মাদাম তুশোর মিউজিয়ামের আদলে। দর্শনার্থী,পর্যটকদের জন্য বাংলা এবং ইংরেজি দুই ভাষায় গুণীজনদের জীবন কথা এবং ইতিহাসঐতিহ্য সম্বলিত লিফলেট, পুস্তিকা প্রকাশ করা যেতে পারে। এই মিউজিয়ামে চট্টগ্রামের যে সব গুণীজন একুশে পুরস্কার, স্বাধীনতা পুরস্কার, বাংলা একাডেমী পুরস্কার পেয়েছেন তাঁদের পরিচিতি থাকবে। মিউজিয়ামে পাঠাগার থাকবে। এখানে চট্টগ্রামের সমস্ত দৈনিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক এবং মাসিক পত্রিকাগুলো পাওয়া যাবে। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত নতুন, পুরাতন লিটল ম্যাগাজিনসমূহ থাকবে। চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত এবং চট্টগ্রামের বাইরে প্রকাশিত চট্টগ্রামের লেখকদের বই এই পাঠাগারে থাকবে। এখানে সংগৃহীত চট্টগ্রামের প্রাচীন পুঁথিসাহিত্য থাকবে, যা থেকে চেনা যাবে হাজার বছরের চট্টগ্রামকে। এজন্য যথেষ্ট বাজেট থাকতে হবে। ১৯৩৩ সালে রাউজান সাহিত্য সম্মেলনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম, আবদুল কাদির প্রমুখ অংশগ্রহণ করেন। ১৯৫১ সালের ১৬ মার্চ থেকে ১৯ মার্চ চট্টগ্রামের হরিখোলা মাঠে প্রথম বারের মতো সাহিত্যসাংস্কৃতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এখানে এসে কবি সুকান্ত বীর চট্টগ্রাম কবিতা পাঠ করেন। এছাড়াও চট্টগ্রামে বিভিন্ন সময়ে সুভাস বসু, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সরোজিনী নাইডু, কবি সুকান্ত প্রমুখ সভাসমাবেশ করেছেন, রাত্রিযাপন বা বিশ্রাম নিয়েছিলেন। এসব ভবন এবং স্থানকে চিহ্নিত করে স্মারকফলক স্থাপনের মাধ্যমে দর্শনীয় স্থান হিসাবে পরিচিত করতে হবে। এপ্রসঙ্গে স্মরণে আসে, অনেক বছর আগে বোধন আবৃত্তি পরিষদের সভাপতি আবদুল হালিম দোভাষ সস্ত্রীক, বাচিকশিল্পী পারভেজ চেীধুরীসহ কোলকাতা গিয়েছিলাম। আমরা নিউ মার্কেটের কাছাকাছি বেশি ভাড়া দিয়ে কম সুবিধাসম্পন্ন একটি হোটেলে উঠেছিলাম। এর একমাত্র কারণ ছিল, ঐ হোটেলের দেয়ালে একটি স্মারকফলকে লেখা ছিল-‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই বাড়িতে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ কবিতাটি রচনা করেন।’

সমকালের কয়েকজনকে দিয়ে কিংবা সাম্প্রতিক ঘটনাপ্রবাহের মাধ্যমে হাজার বছরের চট্টগ্রামকে উপস্থাপন করা সম্ভব নয়। এজন্য হাজার বছরের ইতিহাসঐতিহ্যব্যক্তিত্ববীরগাঁথাকে নির্মোহভাবে তুলে আনতে হবে। একাত্তরের মুক্তি সংগ্রাম এবং সংগ্রামের কুশীলবদের পাশাপাশি বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনে সীপাহি বিদ্রোহ, যুব বিদ্রোহ, ধলঘাট যুদ্ধ, গৈরলা যুদ্ধ, রেলওয়ে পুলিশ লাইন যুদ্ধ, জালালাবাদ যুদ্ধ এবং এসব লড়াইয়ের কুশীলবদের পরিচিত করাতে হবে। এঁদের চিহ্নিত করে বিশেষ দিবসে সম্মাননা জানাতে হবে। স্কুলকলেজে সম্মাননা এবং স্মৃতিচারণ অনুষ্ঠান করা উচিত। থানায়, থানায় মুক্তিযুদ্ধের বিজয় মেলা করতে হবে। চট্টগ্রাম জেলার বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। হাজার বছরের চট্টগ্রামকে স্বাধীনতার স্বাদ দিতে যাঁরা শহীদ হয়েছেন, তাঁদের তালিকা প্রণয়ন করতে হবে।

চট্টগ্রামের হাজার বছরের ব্যবসাবাণিজ্য এবং কুশীলবদের অবদানের কথা স্মরণ করতে হবে। সেসব প্রাচীন জমিদারব্যবসায়ীদের স্মৃতি সংরক্ষণ করতে হবে। পর্যটন বাস চালু করে চট্টগ্রাম জেলার দর্শনীয় স্থান পরিদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে। গ্রামে গিয়ে দেখেছি, জেলা পরিষদ জেলার রাস্তাঘাট এবং ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো নির্মাণে বরাদ্দ প্রদান করছে। তবে আমার প্রস্তাবিত চট্টগ্রামের হাজার বছরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস ঐতিহ্য সংরক্ষণের জন্য রাষ্ট্রীয় অর্থের দরকার নেই। স্পন্সর নিয়ে একাজ সম্পন্ন করা সম্ভব। বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে সিএসআর বৃদ্ধি করতে বলেছে। চট্টগ্রাম জেলা পরিষদ সুযোগটি গ্রহণ করতে পারে। চট্টগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের সহযোগিতাও নিতে পারে। চট্টগ্রামের গুণীজনদের সহযোগিতা নিয়ে সার্চ কমিটি এবং একটি বাস্তবায়ন কমিটি গঠনের মাধ্যমে পরিকল্পনা প্রণয়ন করে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান এম.. সালাম চট্টগ্রামের হাজার বছরের কৃষ্টি, সংস্কৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য সংরক্ষণে এগিয়ে আসবেন বলে আশা করছি।

লেখক : কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধএই তো জীবন
পরবর্তী নিবন্ধজেলা মন্ত্রী, উন্নয়ন সমন্বয় এবং প্রসঙ্গ কথা