প্রতিপাদ্যসার : দ্বি–জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চা ও সৃষ্টির ক্ষেত্রে অসামপ্রদায়িক মনোবৃত্তি এবং সমপ্রীতির স্থলে ধর্মীয় আবেগ, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকেই প্রাধান্য দেবার প্রবণতা পরিলক্ষিত হয়। অধিকাংশ সাহিত্যিকদের রচনা ও তৎকালে পত্রপত্রিকার প্রকাশিত প্রায় সব কবিতা, গল্প, প্রবন্ধতেই পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদী ভাবধারা ও ইসলামি চেতনা ফুটিয়ে তুলতে সচেষ্ট ছিল। অবশ্য দু–একটি পত্রিকা এবং সেই সঙ্গে বেশ কিছু লেখক এধরনের প্রতিকূল পরিবেশেও আবহমান বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে সাহিত্য সৃষ্টির প্রয়াস ও প্রকাশে সচেষ্ট ছিলেন। তেমনি একটি পত্রিকা চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক কোহিনূর (১৯৫০)। এই পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ধর্মীয় হলেও বাংলা ভাষা ও সাহিত্য চর্চার ক্ষেত্রে খ্যাতিমান ও নবীন লেখকদের উদার পৃষ্ঠপোষকতা প্রদান করেছিল । আলোচ্য প্রবন্ধে এই বিষয়টিকেই উপস্থাপন করা হয়েছে।
১৯৫২ সালের ২১এ ফেব্রুয়ারির ঘটনা ও তৎপূর্ববর্তী ভাষা আন্দোলন (১৯৪৭– ১৯৫২), বাঙালির সমাজ ও জীবনের স্মরণীয় অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধ নিঃসন্দেহে আমাদের জাতীয় জীবনের শ্রেষ্ঠ অর্জন, কিন্তু ভাষা আন্দোলনই বাঙালির অধিকার আদায়, জাতিসত্তার উদ্বোধন ও স্বাতন্ত্র্যচেতনার প্রথম স্মারক। ভাষা আন্দোলনের মধ্যেই নিহিত ছিল মুক্তিযুদ্ধের ভাববীজ। সুতরাং বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন ছিল মুখ্যত একটি জাতীয় সংগ্রাম ।
আমাদের জাতীয় জীবনের এতবড় মাপের একটি ঘটনার সাহিত্যিক প্রতিফলন যেমন হয়েছে, তেমনি তৎকালীন বিভিন্ন পত্রপত্রিকা সাময়িকীতেও ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে নানা বিশ্লেষণ, সম্পাদকীয় প্রণয়ন, খবর পরিবেশন, ভাষা আন্দোলনের ইতিবাচক–নেতিবাচক দিকসহ নানা দৃষ্টিকোণ থেকে ভাষা আন্দোলনের মূল্যায়ন করা হয়েছে। তবে সেই সময়ের বেশিরভাগ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাহিত্য ও সংবাদ জাতির আশা আকাঙ্ক্ষা ও চেতনাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হয়েছিল; তার পরিবর্তে অধিকাংশ পত্র পত্রিকারই প্রকাশিত দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, প্রগতিবিরোধী, পাকিস্তানবাদী চিন্তাচেতনা ও ইসলামি ভাবাবেগে আচ্ছন্ন সংকীর্ণ সামপ্রদায়িক মনোভাবের।
ওই সময়ে প্রকাশিত অধিকাংশ পত্রপত্রিকাই ছিল মূলত চেতনার দিক থেকে ইসলামি মূল্যবোধ ও পাকিস্তানবাদী সামপ্রদায়িক আদর্শে উজ্জীবিত। পক্ষান্তরে ভাষা আন্দোলনের ফলে অর্জিত হয়েছিল অসামপ্রদায়িক চেতনা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ, যা ওই সময়ে প্রকাশিত বেশিরভাগ পত্রপত্রিকায় প্রতিফলিত ইসলামি চেতনার সম্পূর্ণ বিপরীত। এ ধরনের পরিবেশ পরিস্থিতিতেও তৎকালীন সময়ে প্রকাশিত দু–একটি পত্রপত্রিকা ভাষা আন্দোলনের গৌরবোজ্জ্বল ভূমিকাকে স্মরণ করে কবিতা, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল। এরকম একটি পত্রিকা চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক কোহিনূর (১৯৫০)। চট্টগ্রাম থেকে ১৯৫০ সালের ২২ ডিসেম্বর কোহিনূর ঈদে মিলাদুন্নবী সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয়েছিল। পত্রিকাটির সিরাতুন্নবী সংখ্যার (৬ জুলাই, ১৯৫১) সম্পাদকীয়তে পত্রিকা প্রকাশের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছিল :
সাহিত্যচর্চার মধ্য দিয়ে আমরা তবলীগের কাজ চালাইয়া যাইব এই আমাদের উদ্দেশ্য।
২য় বর্ষ ১ম সংখ্যায় বলা হয়েছিল,
বহু ভবিষ্য কবি ও লেখক উপযুক্ত কার্যক্ষেত্রের অভাবে নিজেদেরকে ফুটাইয়া তুলিতে পারিতেছেন না আমরা এই ক্ষুদ্র পত্রিকার মধ্যস্থতায় তাঁহাদেরকে প্রতিভাত করিতে চেষ্টা করিব।
(সাপ্তাহিক কোহিনূর ২য় বর্ষ, ১ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা–২৯)
পত্রিকা প্রকাশের উদ্দেশ্য ধর্মীয় হলেও সাহিত্যের মাধ্যমে বৃহত্তর ক্ষেত্রে মানুষের কল্যাণ সাধন করাই এই পত্রিকার অন্যতম লক্ষ্য ছিল। কোহিনূর পত্রিকা প্রসঙ্গে গবেষকের মন্তব্য,
১৯৪৭–এর দেশ বিভাগের প্রেক্ষাপটে পঞ্চাশের দশকের গোড়ায় (১৯৫০) চট্টগ্রাম থেকে আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ার সম্পাদিত সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকার প্রকাশ একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। তৎকালীন পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী কর্তৃক মুসলমান স্বাতন্ত্র্যবাদী ভাবাদর্শ আরোপ এবং বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠীর নানা ষড়যন্ত্রের প্রেক্ষাপটে এই পত্রিকার উদার ইসলামি দৃষ্টিভঙ্গি, বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রতি দৃঢ় সমর্থন এবং রবীন্দ্রনাথ ও নজরুলের ওপর বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
সূচনালগ্ন থেকেই কোহিনূর পত্রিকা বাংলাভাষা ও সাহিত্যের চর্চা, নবীন লেখকদের আত্মপ্রকাশের সুযোগ সৃষ্টি করে দেবার পাশাপাশি সমাজ ও সংস্কৃতির চর্চার ক্ষেত্রেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছিল ।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের অব্যবহিত আগে ও পরে কোহিনূর পত্রিকায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন নিয়ে বেশ কিছু লেখা প্রকাশিত হয়েছিল। এর মধ্যে কবিতা, প্রবন্ধ, সম্পাদকীয়, সংবাদ ও অন্যান্য পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ। নিঃসন্দেহে এগুলোর ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে এবং ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে কোহিনূর পত্রিকার ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি প্রতিফলিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে গবেষক ড. মাহবুবুল হক কোহিনূর পত্রিকার সম্পাদক আবদুল খালেক ইঞ্জিনিয়ারের চিন্তাচেতনা ও দৃষ্টিভঙ্গি বিশ্লেষণ করে মন্তব্য করেছেন :
ইসলামি ভাবধারায় উদ্বুদ্ধ হলেও সামপ্রদায়িক রাষ্ট্র পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকারের নীতি–অবস্থানের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক ছিল না। বরং তিনি ছিলেন পাকিস্তান সরকারের উর্দু প্রীতির পুরোপুরি বিরুদ্ধে এবং বাংলা ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থন। ৩
আমাদের বিবেচনায় দুটি কারণে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক ‘কোহিনূর‘ পত্রিকার প্রকাশ স্মরণীয় হয়ে আছে। প্রথমত, ১৯৫০ সালে অর্থাৎ পাকিস্তানের জন্মের প্রাথমিক কালেই পূর্ববাংলার একটি মফস্বল শহর চট্টগ্রাম থেকে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার আবির্ভাব নি:সন্দেহে একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা। উল্লেখযোগ্য এই কারণে, যেখানে ঢাকা থেকেই ১৯৪৯ সালের পূর্বে কোন সাময়িক পত্রিকা প্রকাশিত বা ছাপা হয়নি ।৪
দ্বিতীয়ত, কোহিনূর পত্রিকা প্রকাশের সূত্র ধরেই এই পত্রিকার সম্পাদক ইঞ্জিনিয়ার আবদুল খালেক প্রতিষ্ঠিত চট্টগ্রামের প্রথম বৈদ্যুতিক ছাপাখানা কোহিনুর ইলেকট্রিক প্রেসেই (১৯২৮) ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা মাহবুবুল আলম চৌধুরী প্রণীত ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি’ পুস্তিকা আকারে ছাপা ও বিতরণ করা হয়েছিল । আর সে কারণেই এই পত্রিকার মুদ্রাকর ও প্রকাশকের নামে মামলা দায়ের করেছিল তৎকালীন পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী। এ সংক্রান্ত একটি সংবাদ কোহিনূর পত্রিকায় ২য় বর্ষ ৩৩শ সংখ্যায় ছাপা হযয়েছিল এভাবে,
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জের
গত ভাষা আন্দোলন সংশ্লিষ্ট ব্যাপারে “কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবী নিয়ে এসেছি” পুস্তিকা ছাপাইবার অপরাধে ‘কোহিনূর’ ইলেকট্রিক প্রেসের ম্যানেজার ও সাপ্তাহিক ‘কোহিনূরে‘র সহকারী মৌলবী দবীর আহামদ চৌধুরীকে মুদ্রাকর হিসাবে এবং নব নির্বাচিত মিউনিসিপ্যাল কমিশনার মৌলবী কামালুদ্দিন খাঁ বি.এ. কে প্রকাশক হিসেবে গ্রেফতার করা হইয়াছিল। প্রেসের খাতা জব্দ করা হইয়াছিল । তাঁহাদিগকে জামিন দেওয়া হইয়াছিল। বহু ঘুরা ফেরার পর গত ২৩শে অক্টোবর তারিখ ডে. মা. জনাব মৌলবী কে রহমান ছাহেবের বিচারে তাঁহারা বেকসুর খালাস পাইয়াছেন।
আমরা তাহাদিগকে অভিনন্দিত করিতেছি।৫
মূলত এই দুটি ঐতিহাসিক ভূমিকা পালনের কারণে কোহিনূর পত্রিকার নাম ইতিহাসে স্থায়ীভাবে লেখা থাকবে।
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে কোহিনূর পত্রিকা প্রকাশের (১৯৫০) পূর্বে ঢাকা থেকে প্রকাশিত পত্রপত্রিকার সংখ্যা ছিল হাতেগোনা। ভাষা আন্দোলন চলাকালীন অর্থাৎ ১৯৫২ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশিত সংবাদপত্রের সংখ্যা ছিল মাত্র ৫টি। ৬ এ সমস্ত পত্রিকায় ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে প্রবন্ধ, নিবন্ধ, সম্পাদকীয় যেমন ছাপা হয়েছে আবার পাকিস্তান সরকার ও তার নীতির প্রতি আনুগত্যের দিকটিও প্রকাশিত হয়েছে। এই সময়ে সিলেট থেকে প্রকাশিত আরেকটি সাপ্তাহিক পত্রিকা নওবেলাল ভাষা আন্দোলনে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছিল ।
এ প্রসঙ্গে আরো উল্লেখ করা যেতে পারে বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে বিভিন্ন পত্রিকা যেমন কোলকাতা থেকে প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ, ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদ, সিলেট থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক নওবেলাল ইত্যাদি বাংলা ভাষার পত্রপত্রিকার পাশাপাশি ঢাকা ও পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত কয়েকটি উর্দু ভাষার পত্রিকাও ভাষা আন্দোলনকে নিয়ে সংবাদ, কবিতা ইত্যাদি ছেপেছিল। এদের মধ্যে দুটি উর্দু পত্রিকা হচ্ছে একটি ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক পাসবান (১৯৪৭) অপরটি পশ্চিম পাকিস্তানের করাচি থেকে প্রকাশিত উর্দু সাহিত্যপত্র আফকার। উর্দু ভাষার একজন বিশিষ্ট কবি নওশাদ নূরী যিনি আমৃত্যু ঢাকায় বসবাস করেন, উনিশশো বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে প্রথম উর্দু কবিতা ‘মহেঞ্জোদারো’ শিরোনামে আফকার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে কোহিনূর পত্রিকায় মোট চারটি কবিতা, তিনটি প্রবন্ধ বেশ কয়েকটি সম্পাদকীয় ও পাকিস্তানের বিখ্যাত দুটি সংবাদপত্র ডন ও ইভনিং টাইমসের উদ্ধৃতি দিয়ে দুটি সংবাদ পরিবেশিত হয়েছিল। এ সমস্ত সংবাদ ও সাহিত্য ছাপানোর মধ্যে দিয়ে কোহিনূর পত্রিকা মূলত ভাষা আন্দোলনের সপক্ষে এর বলিষ্ঠ অবস্থানকেই তুলে ধরেছিল।
প্রথমেই কোহিনূর পত্রিকায় প্রকাশিত চারটি কবিতা নিয়ে আলোচনা করা যাক। যে কবিতাগুলো কোহিনূর পত্রিকায় ছাপা হয়েছিল তার মধ্যে একটি কবিতা ‘বাংলা ভাষা’ ভাষা আন্দোলনের চূড়ান্ত রূপ অর্থাৎ ২১এ ফেব্রুয়ারি সপ্তাহ খানেক পূর্বেই ১৯৫২ সালের ১৫ই ফেব্রুয়ারি কোহিনূরের ২য় বর্ষের ৫ম সংখ্যায় বের হয়েছিল । কবির নাম মতিউল ইসলাম। ২১এ ফেব্রুয়ারির অব্যবহিত পরের রচনাও কোহিনূর পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল যথাক্রমে উমরতুলের ‘শাশ্বত স্বাক্ষর’ ২য় বর্ষ সপ্তম সংখ্যা, এস. এম. ফজলুল হকের ‘বাংলা ভাষা’ ও মুতাসিম বিল্লাহর ‘বাংলা ও বাঙালী‘ কোহিনূরের ২য় বর্ষ ৮ম সংখ্যায় ১৪ মার্চ, ১৯৫২ সালে।
কোহিনূরের ২য় বর্ষ পঞ্চম সংখ্যায় (১৫ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২) কবি মতিউল ইসলামের (১৯১৪–১৯৮৪) ‘বাংলা ভাষা‘ শীর্ষক কবিতাটি প্রকাশিত হয়। কবি হিসেবে তিনি ছিলেন ইসলামী ভাবাদর্শে উজ্জীবিত।৯ পাকিস্তানি চেতনায় স্নাত এ কবি লিখেছেন ‘কায়েদে আজম তোমার জন্য‘ (১৯৫০) নামের কাব্য। এমত চেতনা দ্বারা গ্রস্ত কবি ১৯৫২তে লিখছেন বাংলা ভাষার প্রশন্তি গাথা। এ পরিবর্তন খুবই তাৎপর্যবাহী।
বাংলা বাঙালির প্রাণের ভাষা। বাঙালির আবেগ, স্বপ্ন, কল্পনা সবকিছু বাণীরূপ পেয়েছে এ ভাষায়। উল্লেখিত কবিতায় কবি এসবকে স্বীকৃতি দিয়েছেন। হাজার বছর থেকে কবি–সাহিত্যিকরা এ ভাষায় তাদের সৃজনশীলতার বিকাশ ঘটিয়েছেন। পাকিস্তানি শাসকচক্রকে সাবধান করে দিতে কবি লিখেছেন, ‘বাংলা নিয়ে চলবেনা চালাকি।‘ এবং একইভাবে জনতাকে উদ্বোধিত করছেন, “তোলো আওয়াজ বলো সবে। “(অন্যতম) রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া চাই।”
স্বরবৃত্ত ছন্দে রচিত ১৮ চরণের এই কবিতায় কবি মাতৃভাষা বাংলার অপরিহার্যতা সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। বাংলাকে তিনি গানের ভাষা, প্রাণের ভাষা হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এটির সঙ্গে বাংলা ভাষাকে নিয়ে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের কথা উল্লেখ করে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ।
কবি উমরতুল এর কবিতাটির শিরোনাম ‘শাশ্বত স্বাক্ষর’ সাপ্তাহিক কোহিনূর এর ২য় বর্ষ ৭ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এটি। তেষট্টি পংক্তির অপেক্ষাকৃত দীর্ঘ এই কবিতায় কবি কোনো নিয়মিত ছন্দ ব্যবহার করেন নি। কবিতাটির নিতান্ত আভরণহীনতা ও সরল, বিষণ্ন, বিস্রন্ত গঠন একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত আঘাতে ব্যথিত বাঙালির মানসিক অবস্থারই ভাবাদ্যোতক বাঙালির ভাষাগত আবেগকে, অনুভূতিময় শব্দরাজির সাহায্যে কবি ফুটিয়ে তুলতে চেয়েছেন। বাংলার শ্যামল–কোমল রূপের কথা স্মরণ করেছেন কবি। সঙ্গে সঙ্গে বাংলা ভাষা আমাদের সত্তায় কীভাবে লীন হয়ে রয়েছে সে কথাও ব্যক্ত করেছেন। আমাদের অতীত স্বপ্ন, ভবিষ্যতের আশা–আকাঙ্ক্ষা সবটার সঙ্গেই যে মাতৃভাষার ওতপ্রোত যোগ সে কথা পুনর্ব্যক্ত হয়েছে কবিতাটিতে। একুশে ফেব্রুয়ারির মিছিলে ভাষার দাবিতে সংঘবদ্ধ জনতাকে নির্বিচারে গুলি করে যে মেরে ফেলা হয়েছে, এই হত্যাকান্ডের বিচারের দাবিতে কবি সোচ্চার হয়েছেন। একুশে ফেব্রুয়ারির অব্যবহিত পরেই রচিত এই কবিতা ধারণ করে আছে ঐ দিনের হৃদয়বিদারক হত্যাকান্ডের পর জনমানুষের মধ্যেকার ক্ষোভ ও প্রতিবাদকে ।
এম ফজলুল হক লিখিত ‘বাংলা ভাষা‘ কবিতা কোহিনূরের ২য় বর্ষ ৮ম সংখ্যায় পত্রস্থ হয়। কবিতাটিতে বাংলা ভাষার প্রতি কবির অকৃত্রিম দরদ প্রকাশিত হয়েছে। রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে ‘বাংলা‘ যে অবিকল্প, সে কথা পুনর্ব্যক্ত তাঁর কবিতায়: ‘মোরা বাংলা দেশের অধিবাসী, তাই আমরা বাংলা ভাষাই চাই‘। এই ভাষার জন্য বাংলার ছাত্র যুবসমাজ রক্ত দিয়েছে, প্রয়োজনে আরো রক্ত দেবার প্রত্যয় ঘোষিত হয়েছে কবিতাটিতে। জনতাকে সরাসরি সম্বোধন করে কবি লিখেছেন:
“রক্ত–রাঙ্গা বাংলা ভাষাই চাই
এত মোদের জীবন–মরণ পণ অ–ভাই ।”
(সাপ্তাহিক কোহিনূর ২য় বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা–১৪১)
কোহিনূরের পূর্বোক্ত সংখ্যায় অপর যে কবিতাটি প্রকাশিত হয়েছে তা মোতাসিম বিল্লাহ‘র ‘বাংলা ও বাঙালী‘। কবিতাটিতে কবি সমকালীন সমাজে বাংলা ভাষা নিয়ে যেসব সমালোচনা প্রচলিত ছিল তার অসারতা প্রমাণ করতে সচেষ্ট। যেমন ‘বাংলা হিন্দুর ভাষা‘ এমনটি যারা মনে করতেন কবি তাদেরকে প্রশ্ন করছেন ‘দেশটা তাহলে কাদের?।
তাঁর কান্ডজ্ঞান প্রসূত মত, বাংলা হিন্দু–মুসলমানের মিলিত সম্পদ। যারা মুসলমানের ভাষা হিসেবে আরবি‘কে বাংলার বিকল্পরূপে ভাবছিলেন তাদের প্রতি তার নিবেদন।
খোল আরবীর ঘোমটা
করো তুমি সেখা দৃষ্টি–
ইসলামের অনেক পূর্ব্বে
হয়েছিল তার সৃষ্টি। ”
(সাপ্তাহিক কোহিনূল ২য় বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা–১৪০)
রাষ্ট্র ভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানি শাসকদের জবরদস্তি যে তাদের নির্বুদ্ধিতারই পরিচায়ক তা কবি চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখাবার লিখছেন।
এই বাংলারে যদি মনে করো–
পাকিস্তানেরো অংশ
তাহলে তাহার ভাষা আর প্রাণ
কেন বা করছো ধ্বংশ?”
(সাপ্তাহিক কোহিনূর ২য় বর্ষ, ৮ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা–১৪০)
‘পূর্ব বাংলার সাহিত্যের রূপ কি হবে’ শীর্ষক মুহম্মদ মনসুরউদ্দিন লিখিত একটি প্রবন্ধ কোহিনূর পত্রিকার ২য় বর্ষ ৭ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি শাসনামলে ‘পাকিস্তানবাদী সাহিত্যচর্চা নিয়ে এদেশের শিক্ষিত মুসলমানগণ চিন্তা–ভাবনা করেছিলেন। এঁদের অনেকেরই ধারণা ছিল ‘পাকিস্তানবাদী’ সাহিত্যের ভিত্তি হবে মধ্যযুগের পুঁথি সাহিত্য। এমন একটা সময়ে মুহম্মদ মনসুর উদ্দিন আলোচ্য প্রবন্ধে নতুনতর কথা শোনালেন। পাকিস্তানি ভাবধারায় স্নাত সাহিত্যচিন্তকদের সঙ্গে মনসুরউদ্দিন নিজের পার্থক্য সূচিত করেছেন। প্রবন্ধটিতে প্রতিফলিত হয়েছে তাঁর পরিচ্ছন্ন ইতিহাসজ্ঞান, যুক্তিনির্ভর অগ্রসর চেতনার। এসবের দ্বারা তাঁর চিন্তার বিশেষত্ব ধরা পড়েছে।
তিনি উদাহারণ দ্বারা বোঝাতে চেয়েছেন-‘ইসলামের বিরোধী হলেও ইসলাম প্রাচীন সাহিত্যিকে গলা টিপে মেরে ফেলেনি।’ মোহাম্মদ (দ.) এর আবির্ভাবের পূর্বে রচিত আরবি সাহিত্য স্বাভাবিকভাবেই ইসলামের মৌল প্রতিপাদ্যের সঙ্গে বিরোধপূর্ণ তাই বলে নবী তা বাতিল করে দেননি। তাই যারা বাংলার প্রাচীন সাহিত্য পঠন–পাঠন ও চর্চার সঙ্গে জড়িত তাদের পাকিস্তান বিরোধী বলে চিহ্নিত করা যৌক্তিক হয় না। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ও আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের প্রসঙ্গ উল্লেখ করেই লেখক ঐ মন্তব্য করেছেন।
সে সময়ে পাঠ্যপুস্তককে পাকিস্তানিকরণ করা হয়েছিল। ব্যঙ্গচ্ছলে লেখক সে প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেছেন,
ইদানীং আমাদের যে পাঠ্য পুস্তক প্রাইমারী বা সেকেন্ডারী স্কুলে প্রচলন রয়েছে তার মধ্যে সাহিত্যকে অদ্ভুতভাবে ইসলামী করণ (পাকিস্তানী) করা হয়েছে। এ যেন কারো মন্দির ভগ্ন করা হয়েছে অথচ লাত মানাতের মূর্তিগুলো অটুট রয়েছে।
(সাপ্তাহিক কোহিনূর ২য় বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা–১২৪)
ঐ সময় পূর্বে পাকিস্তানি শাসকবর্গের যেমন তেমনি বাঙালি মুসলমানেরও রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে অস্বস্তি ছিল। ঐ সময় প্রতিবেশে মনসুরউদ্দিন লিখেছেন:
রবীন্দ্রনাথ আমাদের কাছে বড় কেননা রবীন্দ্রনাথের ভাষা বাঙ্গালা ভাষা এবং বাঙ্গালী মুসলমানের মাতৃভাষা বাঙ্গলা, সেই হিসেবে রবীন্দ্রনাথ আমাদের নিকটতম আত্মীয়। ইকবালের চাইতেও সগৌত্র কারণ, ইকবালের উর্দু–ভাষা আমাদের কাছে বোবার ইঙ্গিত সম।
(সাপ্তাহিক কোহিনূর ২য় বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা–১২৫)
কাজী নজরুল ইসলামের সাহিত্য থেকে উদ্ধৃত করে লেখক তাঁর উদার মানবতাবাদী চরিত্রের প্রশংসা করেছেন। তিনি আশা করেছেন, ‘নজরুল ইসলাম আমাদের নূতন সাহিত্য রচনায় প্রভূত সাহায্য করবেন।’
আলী আকবর ক্বাদেরী লিখিত ‘ভাষা সমস্যা’ প্রবন্ধটি ২য় বর্ষ ৭ম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। একুশে ফেব্রুয়ারির অব্যবহতি পরে প্রকাশিত এই প্রবন্ধে আলোচিত হয়েছে মূলত রাষ্ট্রভাষা হিসেবে আরবিকে বিকল্প হিসেবে গ্রহণের বিষয়টি। সংখ্যায় ক্ষুদ্র হলেও একটি গোষ্ঠী যে আরবির পক্ষে ওকালতি করেছিলেন, সেই ঐতিহাসিক সত্যটির জানান দিচ্ছে এই প্রবন্ধ। আরবিকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের নিমিত্ত লেখক কতগুলো যুক্তি দিয়েছেন। তার মতে আরবি পবিত্র ভাষা এবং ‘পৃথিবীতে আল্লাহর খলিফা রূপে শাসনকার্য চালাইবার উত্তম বাহন‘। এর সপক্ষে তিনি একটি হাদিস উদ্ধার করেছেন । হাদিসটি নিম্নরূপ :
আরবদিগকে তিন কারণে ভালবাস। কেননা আমি আরববাসী, পবিত্র কোরান আরবী ভাষায় অবতীর্ণ (লিখিত এবং পঠিত) আবার বিহিশতবাসীদের ভাষাও হইবে আরবী। আমি নবীয়ে উম্মি, কোরান উম্মুল কিতাব, মক্কা শরীফ উম্মুল ক্বোরা এবং আরবী উম্মুল লিছান।
(সাপ্তাহিক কোহিনূর ২য় বর্ষ, ৭ম সংখ্যা, পৃষ্ঠা–১১৭)
দ্বিতীয়ত তিনি আরবি ভাষার ব্যাকরণগত সৌন্দর্য তুলে ধরেছেন এবং আরবি ভাষা যে খুব সহজবোধ্য ও স্বল্পআয়াসে আয়ত্ব করা সম্ভব, সে কথাও বলেছেন। তৃতীয়ত, মুসলমান জন্ম থেকে মৃত্যু অবধি প্রাত্যহিক জীবনে ও ইবাদত–বন্দেগীতে আরবি ভাষা ব্যবহার করে বলে এ ভাষার সঙ্গে একটি সহজাত সম্পর্কে তারা জড়িয়ে থাকে।
এভাবে লেখক আরবি ভাষার পক্ষে সাফাই গেয়েছেন। তাঁর যুক্তিগুলো যে দৃঢ়ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত নয় তা সাধারণ বুদ্ধিতেই ধরা পড়ে। তবে তাঁর প্রবন্ধটির গুরুত্ব অন্যখানে। বিশেষ করে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কী হবে ? এ প্রশ্নে পূর্ববাংলার গুটি কয়েক মানুষ ব্যতীত সকলেই নিঃসন্দেহ ছিল যে বাংলা অবিকল্প। কিন্তু যে গুটি কয়েক মানুষ ঐসময় ভিন্নমত পোষণ করেছিলেন তাদের মুখপাত্রের ভূমিকা নিয়েছেন প্রাবন্ধিক আলী আকবর ক্বাদেরী ।
অধ্যপক মুহম্মদ মনসুরউদ্দীন এম.এ কোহিনূরের ২য় বর্ষ ৪র্থ সংখ্যায় একটি ছোট সরস রচনা লিখেছেন। ‘বাংলা হরপ, ভাষা ও সাহিত্যের দুর্দিন। তিনি পাকিস্তানি শাসনামলে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের দুর্দিন লক্ষ্য করছেন। তিনি লিখছেন, পূর্ব পাকিস্তান; হাসিল করবার পর বাংলাভাষা ও হরফ ও সাহিত্য লাওয়ারিশ মাল । মালিকহীন পথের সার মেয়ের মত ”
এমনিতে বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিত্তবান, শিক্ষিত মুসলমানদের পৃষ্ঠপোষকতা বঞ্চিত, তদুপরি শুরু হয়েছে সংস্কারের মত্ততা। বাংলা হরফের বদলে আরবি হরফে বাংলা লেখা প্রচলনের চেষ্টার মধ্যে তিনি কৌতুক ভিন্ন আর কিছু দেখেন নি । কতিপয় পন্ডিত যে বাংলা বর্ণমালা হতে ঙ ও ঞ প্রভৃতি বর্ণ পরিত্যাগের পরামর্শ দেন তা তাঁর নিকট নিজের নাক কেটে উর্দুর যাত্রাভঙ্গের শামিল। বাংলা ভাষা বিশেষ করে এর হরফ পরিবর্তন নিয়ে যে উন্মত্ততা ঐ সময়ে দেখা দিয়েছিল সে সত্যের প্রকাশ ঘটেছে লেখাটিতে। ঐ ধরনের উন্মত্ততার বিপরীতে যে একটি সাবলীল স্রোত প্রবহমান তার সাক্ষ্য পাওয়া যায় মনসুরউদ্দীনের এই লেখায়। তিনি এ সূত্রে তাঁর নিজের অবস্থানটি প্রবন্ধের দ্বারা পরিষ্কার করেছেন।
পুঁথি সংগ্রাহক মনীষী আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ ৩য় বর্ষ ১৯–২০সংখ্যায় ‘একটি প্রাচীন পুঁথি পরিচয়‘ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। এখানে তিনি মূলত একটি পুঁথির– যার নাম ‘বেনজির বদর মণি’– তার পরিচয় দান করেছেন। পুঁথির পরিচয়জ্ঞাপক অংশটি:
আরবী হরফে লেখা। আদ্যন্ত খন্ডিত। পত্রাঙ্ক নাই। মোট ৬৮ পাতা বিদ্যমান মধ্যে মধ্যে কয়েক পাতা নাই। অত্যন্ত পুরু কলের কাগজ। আট পেজি আকারের বহি । প্রায় ৮০ বৎসর পূর্বের লেখা। সৈয়দ নাছির রচিত
(সাপ্তাহিক কোহিনূর ৩য় বর্ষ,-১৯–২০ সংখ্যা, পৃষ্ঠা–৩০৫)
পুঁথির বিষয় মানুষ ও পরীর মধ্যেকার প্রেমব্যাপার। বেনজির নামের এক রাজপুত্রের রূপে মুগ্ধ হয় পরীকন্যা মাহারুফ। পরীকন্যা বেনজিরকে পরীরাজ্যে হরণ করে নিয়ে যায়। মাহারুফ প্রদত্ত কলের ঘোড়ায় করে বেনজির ইচ্ছামতো ঘুরতে পারে। কিন্তু তাতে মাহারুফের এক শর্ত রয়েছে। সে অন্য রমণীর সঙ্গে প্রেম করতে পারবে তবে রতি ক্রিয়া করলে শাস্তি অনিবার্য। ঘটনা সে দিকেই গড়ায়, বেনজির বদর মণি নামের আর এক পরীকন্যার প্রেমে পড়ে যায়। এ বিষয়ে মাহারুফ অবগত হলে বেনজিরকে শাস্তিস্বরূপ এক নোংরা অন্ধকূপে বন্দি করে আর বিরহ তাপে বদর মণি দিনকে দিন ক্ষীণপ্রাণ হয়ে পড়ে।
কোহিনূরে প্রকাশিত এই প্রাচীন পুঁথি পরিচয় থেকে একটি জিনিস স্পষ্ট হয়, পত্রিকাটি প্রাচীন বাংলা সাহিত্যের ও তার সংগ্রহের পৃষ্টপোষকতা করতে এবং শিক্ষিত সমাজের নিকট ঐসব পুঁথির কাহিনি তুলে ধরতেও সচেষ্ট ছিল । একথা বলার কারণ, এ বিষয়ে আরো চারটি প্রবন্ধ আমাদের দৃষ্টিগোচর হয়েছে যা কোহিনূরের বিভিন্ন সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। এবার আমরা ঐসব প্রবন্ধের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দেবো।
কোহিনূরের ২য় বর্ষ ২য় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিলো আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের ‘সাহিত্য রাজ্যে লোফালুফি‘ প্রবন্ধটি। এ প্রবন্ধে মূলত তিনি যে বিষয়ের অবতারণা করেছেন তা হলো মধ্যযুগের সাহিত্যেই তিনি দেখেছেন একজন কবির কাহিনিবীজ ব্যবহার করে অপর কবি তাকেই নবরূপ দিচ্ছেন। তার মতে, “এর ফলে অসম্পূর্ণ সম্পূর্ণ হয়, অসুন্দর সুন্দর হয়, যাহা কোরক অবস্থায় থাকে, তাহা বিকশিত হইয়া ফলে ফুলে পরিশোভিত হয়।” বর্তমানকালে যাকে ঐতিহ্যের অঙ্গীকার বোঝায় তাকেই তিনি সাহিত্য রাজ্যে লোফালুফি বলে চিহ্নিত করেছেন।
উদাহরণ হিসেবে তিনি একটি পরম্পরা উল্লেখ করেছেন।
রাম প্রসাদ কবি রঞ্জনের ‘বিদ্যা সুন্দরের‘ উপ রঙ ফলাইয়া ভারতচন্দ্র রায় গুনাকর তাহায় নূতন রূপ দান করেন। ভারতচন্দ্রের উপর তুলিকা চালাইয়া নিধিরাম কবিরত্ন “বিদ্যাসুন্দরের” আর এক চিত্র অঙ্কন করেন। আবার কবিরত্নের চিত্রের উপর রঙ চড়াইয়া সাতকানিয়া ধর্মপুরের কবি গোবিন্দদাস এক চিত্র ও সাবিরিদ খাঁ এক চিত্র অঙ্কিত করিয়া সাহিত্য রাজ্যে উপহার দেন ।
(সাপ্তাহিক কোহিনূর ২য় বর্ষ, ২য় সংখ্যা, পৃষ্ঠা–৩৪)
লেখক একইভাবে ‘নবী বংশ”, ‘রসুল বিজয়’, ‘গোরক্ষ বিজয়’, প্রভৃতি কাহিনি যে একাধিক কবির হাতে ভিন্ন ভিন্ন রূপ পরিগ্রহ করেছে সে সব উল্লেখ করে সাহিত্য রাজ্যের এরকম লোফালুফিকে স্বাগত জানিয়েছন।
পুথি সাহিত্য বিষয়ে তৃতীয় যে প্রবন্ধটি আমাদের দৃষ্টিগোচরীভূত হয়েছে তা সৈয়দ মোস্তফা আলীর ‘পূর্ব বাংলার পুঁথি সাহিত্য‘। এটি কোহিনূরের ২য় বর্ষ ৩য় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। আঠারো শতক ও উনিশ শতকের প্রথমার্ধে পূর্ব বাংলায় পুঁথি সাহিত্যের ব্যাপক প্রচার প্রসার ঘটে বলে লেখক উল্লেখ করেছেন। এসব পুঁথি গাথা কবিতার মতোই ‘মুখে মুখে প্রাণ আকুল করা সুর ছন্দে গীত হতো’ । বিশ শতকে তা লেখকের দৃষ্টিতে ‘মৃত সাহিত্য’ বলে বিবেচিত হয়েছে। কিন্তু এর গুরুত্বের কথা লেখকও স্বীকার করেছেন, “এই সাহিত্য তখনই আমাদের প্রশংসা অর্জন করতে পারে যখন আমরা দেখি ইহা কোন বিশেষ সামাজিক অর্থনৈতিক প্রতিবন্ধকতার বিরুদ্ধ পটভূমিকায় সমৃদ্ধি লাভ করিয়াছে।”
মুদ্রণযন্ত্রের প্রসারে এ পুঁথিগুলি যখন পুস্তকাকারে মুদ্রিত হতে থাকে তখন এসবের ছন্দবদ্ধ জনিত ত্রুটিসমূহ প্রকাশিত হয়। অশিক্ষিত রচয়িতাগণের অশিক্ষিত শ্রোতৃগণের দিকে লক্ষ্য রেখে লেখা এসব পুঁথি যখন গীত হতো এসব ত্রুটি সেভাবে লক্ষগোচর হতো না। আধুনিক সাহিত্যের সঙ্গে এসব পুঁথি সাহিত্যের একটি বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন প্রাবন্ধিক, তা হলো অশিক্ষিত সাধারণ মানুষের নিবিড় সংযোগের বিষয়টি। পুথি সাহিত্যের সঙ্গে সাধারণ মানুষের যে নিবিড় সংযোগ লাভের সুযোগ ঘটে আধুনিক সাহিত্য তা থেকে বঞ্চিত।
আধুনিক কালে অনেক অমুসলিম লেখক পুঁথি সাহিত্যে আরবি, ফারসি, উর্দু শব্দের আধিক্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। অপর যে বিষয়ে অমুসলিম লেখকগণ অভিযোগ করেন তা হলো এর বিষয়। তাদের অভিযোগ পুঁথি কাহিনি যেসব বিষয় অবলম্বনে রচিত হয় যেমন আরবের পটভূমিতে লেখা আরবি কাহিনি, মুসলমানদের স্পেন বিজয়, আরবে ইসলামি বিপ্লব ইত্যাদি – তা পূর্ববঙ্গের মুসলমানদের চিন্তা, অভিজ্ঞতা ও ভাবাদর্শের সঙ্গে সাজুয্যপূর্ণ নয়। প্রাবন্ধিক মনে করেন অমুসলিম লেখকদের এমনতর অভিযোগ ‘এক ধরনের অজ্ঞতার উপর প্রতিষ্ঠিত, যাহা বিদ্বেষজনিত হইয়া এ সমস্ত মুসলিম পদরচয়িতাগণকে হেয় প্রতিপন্ন করার চেষ্টা’। এমনটি বলার পরও লেখক এর সঙ্গে যে কথাটি বলেন তাও গুরুত্বপূর্ণ। তিনি বলছেন এসব পদরচয়িতা ভিন্নদেশীয় বিষয় নিয়ে কবিতা রচনা করেছেন সত্য “তবুও তাহারা তাহাদের সামাজিক অনুশাসন এবং তাদের চারিদিক্কার পৃথিবীর পরিমন্ডলকে কখনও বিস্মৃত হননি।” প্রসঙ্গত লেখক আমাদের স্মরণ করিয়ে দিচ্ছেন পুঁথি রচয়িতাগণ যে সবসময় ভিন্ন দেশীয় বিষয়ই অবলম্বন করেছেন এমনটি নয়। যেমন সিলেটের শাহজালাল (র🙂 সিলেট বিজয় নিয়ে পুঁথি রচিত হয়েছে। শুধু তাই নয় তার ৩৬০ জন শিষ্যও সিলেটের পুঁথি সাহিত্যে স্থান লাভ করেছেন। এবং এখানে আরো যেটি প্রাবন্ধিক লক্ষ করতে বলেন, তা হলো শুধু মুসলমানগণই নয় এ ধরনের কাহিনি রচয়িতার মধ্যে অমুসলিমগণও ছিলেন। যেমন হিন্দু ব্রাহ্মণ ভবানন্দ ।
পুঁথি সাহিত্য প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিকের মতামতের একটা ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। পাকিস্তান পর্বে পাকিস্তানি সাহিত্যের ভিত্তিভূমি হিসেবে অনেকেই যে পুঁথি সাহিত্যের দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করেছিলেন, এ সময়ে রচিত এই প্রবন্ধের সে বিষয়ে ভাবগত সঙ্গতিও রয়েছে। কারণ হিসেবে লেখকের একটি মন্তব্য উদ্ধৃত করা যায়– ‘এই পুঁথি সাহিত্য বাস্তবিকই পূর্ব বাংলার মুসলিম সংস্কৃতির অবিচ্ছিন্ন অংশ।’
মুহম্মদ হাফিজুর রহমান বি.টি লিখেছেন ‘আরেক দৃষ্টিকোণ থেকে কাজী দৌলত’। এটি ২য় বর্ষ ৪র্থ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছিল। লেখক এ প্রবন্ধে কবি হিসেবে কাজী দৌলতের বৈশিষ্ট্যসমূহ চিহ্নিত করতে চেয়েছেন। এবং এতে তিনি অবলম্বন করেছেন কাজী দৌলতের ‘সতীময়না ও লোরচন্দ্রানী’ কাব্যের। কাব্যটি কবি সম্পূর্ণ করে যেতে পারেন নি। এটি সম্পূর্ণ করেন মহাকবি আলাওল। এসূত্রেই তিনি আলাওল ও কাজী দৌলতের মধ্যেকার কবিস্বভাবগত বৈশিষ্ট্য আলোচনা করেছেন। দুজনের কবিত্ব তুলনা প্রসঙ্গে প্রাবন্ধিক লিখেছেন,
লোর চন্দ্রানী কাজী দৌলতের অপূর্ব সৃষ্টি। বাহুল্য বজ্জিত কাব্য রচনায় দৌলত কাজী অতুলনীয়। পুনরুক্তি দোষে তাঁর কবিতা দুষ্ট নয়। কবি নৈর্ব্যক্তিকতা আলাওলের কাব্যে বাহুল্য ও পুনরুক্তি লক্ষিত হয়। কাব্যকে যে বৈশিষ্ট্য দান করে আলাওলের এ মহাকাব্যে তা পাওয়া যায় না। এ হিসাবে “সতীময়না” কাব্যে নৈর্ব্যক্তিকতাই কাজী দৌলতের কবি প্রতিভকে অপূর্ব সুষমামন্ডিত করেছে।
সাপ্তাহিক কোহিনূর ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, পৃষ্ঠা–৭১
‘সতীময়না লোর চন্দ্রানী’র যে অংশ আলাওল রচনা করেছেন সে অংশের কবিকৃতির সঙ্গে কাজী দৌলত রচিত অংশের তুলনামূলক আলোচনা করে প্রাবন্ধিক লিখেছেন,
আলাওলের রচিত অংশে পান্ডিত্য আছে। শব্দাড়ম্বর আছে, অস্বাভাবিকতার ছোঁয়াচ আছে, কিন্তু দৌলত কাজীর রচনায় যে প্রাঞ্জলতা, স্বাভাবিকত্ব ও স্বল্পভাষিতার উজ্জ্বল নিদর্শন আছে, আলাওলের অংশে তা‘ নেই।
সাপ্তাহিক কোহিনূর ২য় বর্ষ, ৪র্থ সংখ্যা, পৃষ্ঠা–৭১
সাহিত্য, বিশেষ করে মধ্যযুগের সাহিত্য নিয়ে তুলনামূলক সমালোচনা ঐ সময়ের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে বেশ তাৎপর্যপূর্ণ। প্রাবন্ধিক এখানে অনেকটাই নৈর্ব্যক্তিকতার সঙ্গেই মধ্যযুগের দুই প্রতিভার তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। সাধারণত এ ধরনের লেখায় অনেক সময়ই আলোচকের প্রচ্ছন্ন পক্ষপাত প্রকাশ হয়ে পড়ে, এ ক্ষেত্রে তেমনটি ঘটে নি। মতামত প্রকাশ করেই প্রাবন্ধিক ক্ষান্ত হন নি সঙ্গে সঙ্গে মতের পক্ষে কখনো দীনেশচন্দ্র সেন আবার কখনো আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের দোহাই মেনেছেন। এদিক থেকেও সমালোচকের দৃষ্টিভঙ্গিকে আধুনিক বলতে হয়।
প্রাচীন কাব্য তথা পুঁথিসাহিত্য ও তার একনিষ্ঠ সংগ্রাহক মুনশী আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদকে নিয়ে লিখিত একটি প্রবন্ধ কোহিনূর ৩য় বর্ষ ২১–২২ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। প্রবন্ধের শিরোনাম ‘প্রাচীন কাব্য মহাকবি আলাওল ও মনীষী আবদুল করিম‘; প্রবন্ধকার শীমনোতোষ বিকাশ গুহ, এম, কম, এম, এ (ইকন)। এক সময়ে চট্টগ্রামে বৈঠকী কাব্যপাঠ তথা পুথিপাঠের আসর বসতো। তার মধ্যে মহাকবি আলাওলের পুথি জনগণের নিকট ছিল সবচেয়ে আকর্ষণীয়। পন্ডিতগণ শুধু পুথি পাঠই করতেন না সঙ্গে সঙ্গে দুর্বোধ্য বিষয়গুলো সহজ ভাষায় সাধারণ শ্রোতাদের বুঝিয়েও বলতেন।
আলাওল ছিলেন পন্ডিত কবি। তিনি আরবি, ফারসিতে যেমন দক্ষ ছিলেন তেমনি সংস্কৃতেও। এ সব ভাষা ও শাস্ত্রের পন্ডিত আলাওলের কাব্যে তাই প্রচুর আরবি, ফারসি ও সংস্কৃত শব্দের ব্যবহার রয়েছে। কাজেই পন্ডিতের সাহায্য ছাড়া সাধারণ শ্রোতাগণের পক্ষে অসম্ভব ছিলো আলাওল কাব্যের রসোপলব্ধি। একারণে ঐ সময়েএ অঞ্চলে ‘একশ্রেণীর আলাওল পন্ডিতের সৃষ্টি’ হয়েছিলো বলে প্রাবন্ধিক জানিয়েছেন ।
লেখক এসূত্রে স্মরণ করেছেন আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের অবিস্মরণীয় অবদানকে। তিনি লিখেছেন, সর্বপ্রথম প্রাচীন কবিগণের অপূর্ব রূপ সৃষ্টি সম্পর্কে বাংলার শিক্ষিত সমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেণ [করেন] চট্টগ্রামের অক্লান্ত কর্মী ণীরব [নীরব] সাধক ও মনিষী [মনীষী] আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদ বিশ্ববাসীর সামনে হাজির করেছেন। এর ফলে একদিকে যেমন বাংলা সাহিত্যের একটি অনালোচিত অধ্যায় উন্মোচিত হয়েছে তেমনি চট্টগ্রামও প্রাচীন সাহিত্যের মারফত বিশ্ব সুধীজনের দৃষ্টি আকর্ষণে সক্ষম হয়েছে।
আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদের এ গৌরবজনক ভূমিকার প্রশংসা করে প্রবন্ধকার প্রবন্ধের শেষে একটি মানবিক নিবেদন পেশ করেছেন। তখন সাহিত্যবিশারদ সাহেব দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত, চিকিৎসাহীন অবস্থায় মৃত্যুর দিন গুনছেন। সারস্বত সমাজের নিকট প্রাবন্ধিক সাহিত্যবিশারদের চিকিৎসা ও শুশ্রূষার আবেদন করে প্রবন্ধটি শেষ করেছেন ।
১ম বর্ষ ২০ তম সংখ্যায় মুহম্মদ মুনসুর উদ্দিন এম.এ লিখেছেন ‘চট্টগ্রামের বাংলা সাহিত্য সাধনা‘ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ। এ প্রবন্ধে তিনি মধ্যযুগ থেকে বিশ শতকের প্রথমার্ধ পর্যন্ত চট্টগ্রামের উল্লেখযোগ্য সাহিত্যসেবীদের স্মরণ করেছেন। প্রথমেই উল্লেখিত হয়েছে কাজী দৌলত ও তার ‘সতীময়না লোরচন্দ্রাণী‘র কথা । উল্লেখিত হয়েছে কাজী দৌলত ও তার ‘সতীময়না ও সতীময়নার হাতে লেখা পুথির একটি মাত্র পান্ডুলিপি ছিল আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের সংগ্রহে, অন্য কোথাও এর অন্য পান্ডুলিপির সন্ধান করে লেখক ব্যর্থ হয়েছেন। তার দুঃখ, এই গ্রন্থটি সম্পাদিত হয়ে প্রকাশিত হয় নি। এছাড়া তিনি আলাওল, আলীরাজা, শেখ ফৈজুল্লা ও হায়াত মাহমুদ –এর উল্লেখ করেছেন।
আধুনিক কালের লেখকদের মধ্যে নবীনচন্দ্র, শশাঙ্কমোহন, আশুতোষ চৌধুরীর নাম উল্লেখ করেছেন। গাথা সাহিত্যের প্রতি আশুতোষ চৌধুরীর অকৃত্রিম আগ্রহের কথা যেমন উল্লেখ করেছেন প্রাবন্ধিক তেমনি পুথি সংগ্রাহক আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের অবদানকে সানন্দে স্বীকৃতি দিয়েছেন। আধুনিককালের সাহিত্যিকদের মধ্যে মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, দিদারুল আলম ও মাহবুবুল আলমের নাম স্মরণ করেছেন।
‘পাকিস্তানে বাঙ্গালা সাহিত্যের অগ্রগতির আবশ্যকতা ও আমাদের কর্তব্য‘ শীর্ষক একটি প্রবন্ধ ৩য় বর্ষ ১৭–১৮ সংখ্যয় প্রকাশিত হয়েছে। এটি লিখেছেন আবদুল রব। তিনি এই প্রবন্ধে পাকিস্তান লাভের পর বাংলা সাহিত্যের যে দুর্দশাগ্রস্ত অবস্থা তার দিকে পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। প্রথমত তিনি দেখেছেন যে পূর্ব পাকিস্তানিদের পড়বার জন্য মানসম্মত মাসিক, পাক্ষিক, সাপ্তাহিক সাহিত্য পত্রিকার অভাব। দ্বিতীয়ত, পাঠাগারের স্বল্পতা। তৃতীয়ত, ভারতীয় সাহিত্য পত্রিকার অনুপ্রবেশ ও তার পঠনে পাকিস্তানি আদর্শ, ভাবধারার বিকৃতি লাভ ।
সাহিত্যের ঐতিহাসিক–সামাজিক ভূমিকার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে প্রাবন্ধিক নব্য পাকিস্তানের চিন্তানায়কদের এ ব্যাপারে আরো মনোযোগ আকর্ষণ করেন। তিনি আরো স্মরণ করিয়ে দেন, “সাহিত্যের মধ্য দিয়াই জাতীয় জীবনের সংগ্রামী শক্তি উদ্দীপীত হয়, ভবিষ্যতে আনন্দোজ্জ্বল আশার আলো বিকিরণে সহায়তা মিলে।”
সবশেষে লেখক অভিমত দিয়েছেন, পাকিস্তানের বাংলা সাহিত্য পাশ্চাত্য ও হিন্দু ভাবধারা সর্বোতোভাবে পরিহার করবে এবং তৎপরিবর্তে মুসলমানদের জাতীয় কৃষ্টি, তাহজিব তমদ্দুন ও ধর্মীয় বৈশিষ্ট্যকে অঙ্গীকার করবে।
সাহিত্য ও সাহিত্যিক নিয়ে আলোচনার সঙ্গে সঙ্গে সাহিত্যের ইতিহাস আলোচনা ও কোহিনূরের পাতায় স্থান লাভ করেছিল। ১ম বর্ষ ৫ম সংখ্যায় বাংলা সাহিত্যের ইতিহাস শীর্ষক অধ্যাপক আব্দুল লতিফ চৌধুরী এম.এ এর একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। এতে তিনি বাংলা সাহিত্যেও প্রাচীন যুগ হতে আধুনিককাল পর্যন্ত কালানুক্রমিক সাহিত্য ধারা ও তার প্রধান সাহিত্যিক ও সাহিত্য সম্পর্কে আলোচনা করেছেন। তার আলোচনার ধারাটি গতানুগতিক। তা হলেও এতে লেখকের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়েছে।
উপসংহার : পঞ্চাশের দশকের পূর্ব পাকিস্তানের মফস্বল শহর চট্টগ্রাম থেকে ‘সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকার প্রকাশ নানা দিক দিয়েই গুরুত্বপূর্ণ। বাঙালির জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটি অধ্যায় ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে খবর প্রকাশ, সম্পাদকীয় প্রণয়ন, প্রবন্ধ ও কবিতা প্রকাশ করে পত্রিকাটি একদিকে যেমন বাঙালির শাশ্বত আবেগের প্রতি শ্রদ্ধা প্রকাশ করেছে অন্যদিকে সামাজিক দায়বদ্ধতারও স্বাক্ষর রেখেছে। এরই মধ্য দিয়ে পত্রিকাটি বাঙালির গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসের অংশ হয়ে পড়েছে। সাহিত্য, বিশেষ করে বাংলার প্রাচীন সাহিত্য নিয়ে যেসব প্রবন্ধ ‘কোহিনূরে’র পাতায় ছাপা হয়েছে তার সাহিত্যমূল্য যেমন অনস্বীকার্য, তেমনি রয়েছে ঐতিহাসিক গুরুত্ব। এর পাতায় শুধু খ্যাতিমান সাহিত্যিকরাই নয় অনেক নবীন লেখক বা লেখকযশপ্রার্থীরাও লিখেছেন। শুধু নবীন–প্রবীণ লেখকদেরই সমাবেশ ঘটেনি সঙ্গে সঙ্গে অপেক্ষাকৃত ভিন্ন ভাবাদর্শের লেখকরাও স্বচ্ছন্দে তাদের মতামত কোহিনূর পত্রিকায় প্রকাশ করতে পেরেছেন। এর মধ্যদিয়ে পত্রিকার সম্পাদকীয় নীতির উদারতার স্বাক্ষর রেখেছিল কোহিনূর পত্রিকা। পঞ্চাশের অবরুদ্ধ দশকে ভাষা আন্দোলনে সম্পৃক্ত হয়ে পত্রিকাটি একদিকে যেমন সাহসের পরিচয় দিয়েছে, অন্যদিকে হয়েছে গৌরবের অংশীদার। একই সাথে প্রতিষ্ঠিত লেখকদের সঙ্গে প্রতিশ্রুতিশীল লেখকদের লেখালেখির সুযোগ করে দিয়ে সাপ্তাহিক কোহিনূর পত্রিকা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যচর্চার বিকাশে উজ্জ্বল ভূমিকা রেখেছে ।
সূত্র নির্দেশ
১ সাপ্তাহিক কোহিনূর, সিরাতুন্নবী সংখ্যা, ৬ জুলাই, ১৯৫১।
২ ড. মাহবুবুল হক, অন্বেষার আলোয় চট্টগ্রাম, শৈলী প্রকাশন, চট্টগ্রাম, ২০১২, পৃষ্ঠা–৫২। ৩ পূর্বোক্ত, পৃষ্ঠা–৫২।
৪ ড. হুমায়ুন আজাদ, ভাষা আন্দোলনের সাহিত্যিক পটভূমি, আগামী প্রকাশনী, ১৯৯০, ঢাকা, পৃষ্ঠা–১৫
৫ সাপ্তাহিক কোহিনূর, ২য় বর্ষ, ৩৩–৩৪ শ সংখ্যা, ২৭ অক্টোবর, ১৯৫২।
৬ ড. মোঃ আনোয়ারুল ইসলাম, সংবাদপত্র ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস, নভেল পাবলিশিং হাউস, ঢাকা, ২০১৩, পৃষ্ঠা–৪৩।
৭. মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বাংলাদেশের নানান ভাষা, প্রথমা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৪, পৃষ্ঠা–১৮।
৮ এ প্রসঙ্গে গবেষক সাবিনা নার্গিস লিপি তাঁর ভাষা আন্দোলন ও চট্টগ্রামের কোহিনূর পত্রিকা শীর্ষক প্রবন্ধে কোহিনূর পত্রিকায় ১৯৫১–১৯৫২ এর মার্চ পর্যন্ত সময়কালে ভাষা আন্দোলন বিষয়ক তিনটি কবিতা, দুইটি প্রবন্ধ, ছয়টি সংবাদ, দুইটি অন্যান্য পত্রিকার মন্তব্য এবং সাতটি সম্পাদকীয় নিবন্ধের কথা উল্লেখ করেছেন। এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার জন্য দেখুন, দ্যা চিটাগাং ইউনিভারসিটি জার্নাল অব আর্টস এ্যান্ড হিউম্যানিটিজ, খণ্ড ১৭, জুন ২০০১, পৃষ্ঠা ২১৫–২২৩।
৯ শহীদ ইকবাল, বাংলাদেশের সাহিত্যের ইতিহাস, আলেয়া বুক ডিপো, ঢাকা, ২০০৯, পৃষ্ঠা–২৫।
লেখক : অধ্যাপক, বাংলা বিভাগ, পরিচালক, নজরুল গবেষণা কেন্দ্র, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।