চট্টগ্রামের শুঁটকির সুখ্যাতি রয়েছে দেশে–বিদেশে। রসনা বিলাসীদের রসনায় শুঁটকি জনপ্রিয় খাবার। আর সেটি যদি হয় চট্টগ্রামের শুঁটকি তাহলে তো কথাই নেই। চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের সঙ্গে মিশে আছে শুঁটকি।
কর্ণফুলী নদীর তীরে গড়ে উঠেছে বেশ কয়েকটি শুঁটকিপল্লী। কর্ণফুলীর উত্তরে বাকলিয়া এবং দক্ষিণে ইছানগর, চরপাথরঘাটা এলাকায় শুঁটকির ব্যবসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন কয়েক হাজার মানুষ। এখন শুঁটকির মৌসুম। শীতকালে বাতাসে আর্দ্রতা কম থাকায় শুঁটকি দ্রুত শুকায়। প্রতি বছর হালকা শীতে শুঁটকি তৈরির ধুম পড়ে যায় চট্টগ্রামের শুঁটকিপল্লীগুলোতে। এখন মৌসুম শুরু হওয়ায় কর্ণফুলীর তীরে শুঁটকি শ্রমিকরা ব্যস্ত সময় পার করছেন। গত কয়েক মাস ধরে এখানে নানা জাতের শুঁটকি উৎপাদনের কাজ চলছে। একদিকে শুকানো, পাশাপাশি প্রক্রিয়াজাতকরণের ব্যস্ততা বেড়েছে। এসব শুঁটকি যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। এছাড়া রপ্তানিও হচ্ছে। শীতকালে বেশি শুঁটকি উৎপাদন হয় এবং এ সময় চাহিদাও বেশি থাকে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা।
প্রতিদিন সূর্যের তাপে এসব এলাকার শতাধিক স্পটে ছোট–বড় ২০ থেকে ২৫ প্রজাতির মাছ শুকানো হচ্ছে। নভেম্বরের শুরুতে কদর বেশি থাকে ছোট জাতের শুঁটকির। এক–দুই মাস পর বেশি শীতে বড় শুঁটকির মৌসুম শুরু হবে।
যেভাবে শুকানো হয় : চট্টগ্রামের তিনটি বৃহৎ শুঁটকিপল্লী হলো ইছানগর, চরপাথরঘাটা ও উত্তর বাকলিয়ার ক্ষেতচর। সরেজমিনে ইছানগরে গিয়ে দেখা গেছে, শুঁটকিপল্লীতে শুঁটকি শুকানো হচ্ছে কয়েক ধাপে। প্রথমে মাছের পেট থেকে নাড়ি–ভুঁড়ি বের করে একটি দল। আরেক দল পেট কাটা মাছ ধুয়ে নিচ্ছে পানিতে। কেউ সেই ধোয়া মাছ শুকাচ্ছে, কেউ হালকা শুকানো মাছে লবণ লাগাচ্ছে। এরপর শুঁটকি শুকাতে দেওয়া হয় চাঙে। প্রকারভেদে শুঁটকি শুকাতে সময় লাগে এক থেকে চার সপ্তাহ। শুঁটকি উৎপাদনের সঙ্গে জড়িতরা বলছেন, এখানে কোনো প্রকার ফরমালিন ও ওষুধ ছাড়াই প্রাকৃতিক উপায়ে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়। স্বাদের মতো এখানকার শুঁটকিতে বৈচিত্র্যও আছে।
ইছানগরের ডায়মন্ড সিমেন্টের নদীর তীর ঘেঁষে গড়ে ওঠা শুঁটকিপল্লীতে বাঁশ দিয়ে তৈরি চাঙে বড় বড় শুঁটকিগুলো শুকানো হচ্ছে। পাশে সারি সারি মাচানে ছোট জাতের নানা রকমের শুঁটকি শুকাতে দেওয়া হয়েছে। এখানে অনেক শ্রমিক কাজ করছেন। এই শুঁটকিপল্লীর শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কক্সবাজারে অনেক শুঁটকিপল্লী বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কক্সবাজারের অনেক ব্যবসায়ী ওখান থেকে মাছ এনে এখানে শুকান। এখান থেকে চাক্তাই, ঢাকা, কুষ্টিয়া, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় শুঁটকি যায়। অনেক নামীদামি শুঁটকি বিদেশেও যায়। একই চিত্র দেখা গেছে চরপাথরঘাটা ও বাকলিয়া এলাকায়। চারদিকে জাল দিয়ে ঘেরা সারি সারি মাচান ও চাঙে নানা জাতের শুঁটকি শুকাচ্ছেন শ্রমিকরা।
চট্টগ্রামে যেসব শুঁটকি উৎপাদন হয় : এখন যেসব মাছের শুঁটকি তৈরি হচ্ছে তার মধ্যে আছে ছুরি, ফাঁইস্যা, লইট্টা, ইচা, মইল্যা, কেচকি, লাক্ষ্যা, কোরাল, রূপচাঁদা, পোয়া ও ছোট–বড় মিশালি জাতের শুঁটকি। শুঁটকির মধ্যে সবচেয়ে দামি লাক্ষ্যা ও রূপচাঁদা। এরপর রয়েছে ছুরি, লইট্যা ও নোনা ইলিশ। তবে এখানে লাক্ষ্যা কম হয়।
একটু বড় আকারের শুঁটকির জন্য বাঁশ দিয়ে চাঙ সাজানো হয়। আর ছোট জাতের শুঁটকি শুকাতে তৈরি করা হয় মাচান। শুঁটকি উৎপাদনের কাজ আগস্ট থেকে শুরু হয়ে চলে ৯ মাস। মার্চ পর্যন্ত বেশি শুঁটকি উৎপাদন হয়।
ইছানগরের শুঁটকিপল্লীর কয়েকজন শ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি মৌসুমে বিক্রি হয় কয়েক কোটি টাকার শুঁটকি। এবারের শীতে বাড়তি শুঁটকি বিক্রি হওয়ার আশায় আছেন ব্যবসায়ীরা। সরকারের পক্ষ থেকে শুঁটকিপল্লী গড়ে দিলে তাদের সুবিধা হতো বলে জানান ব্যবসায়ীরা। তারা জানান, ফরমালিন ছাড়াই রোদে শুকিয়ে প্রাকৃতিক উপায়ে এখানে শুঁটকি উৎপাদন করা হয়।
শুকানো শেষে পাইকারি ব্যবসায়ীরা নিয়ে যান দেশের বিভিন্ন বাজারে। নদী তীরবর্তী হওয়ায় এখানে মাছ সংগ্রহ ও শুঁটকি বাজারজাত করা সহজসাধ্য। প্রায় শতাধিক মাচানে প্রতিদিন চলছে শুঁটকি শুকানোর কাজ। এসব মাচানে শতাধিক নারী–পুরুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থাও হয়েছে। সাগর থেকে মাছ ধরে কর্ণফুলী নদীতে আসা ফিশিং জাহাজ থেকে সরাসরি মাচানে নিয়ে শুকানো হয়। ফলে শুঁটকির মান ও স্বাদ ভালো থাকে। এখানে শুঁটকি তৈরিতে খরচ তুলনামূলক কম। নদী ও সাগর থেকে আহরণ করা মাছ সহজে ও কম খরচে এখানে আনা যায়। এখানকার শুঁটকি নগরীর আছদগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি হয়।
চাক্তাই এলাকার শুঁটকি ব্যবসায়ী সাইফুল ইসলাম বলেন, বছরের অন্য সময়ের তুলনায় শীতকালে শুঁটকির চাহিদা বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তাই উৎপাদনের মৌসুম হওয়ায় শুঁটকির দাম কিছুটা কম। এখানকার শুঁটকি আঞ্চলিক সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন স্থানে। তিনি জানান, শীতকালে বেশি শুঁটকি উৎপাদন হয়। চাহিদাও এ সময় বেশি থাকে।
তিনি বলেন, মাছ সংগ্রহ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে রোদে শুকানোর কারণে এই এলাকার শুঁটকি স্বাদে, গন্ধে, ক্ষেত্র বিশেষে দেশের প্রসিদ্ধ সোনাদিয়া–রাঙাবালির শুঁটকিকেও ছাড়িয়ে যায়। আনোয়ারা–কর্ণফুলীর মাছ শুকাতে কোনো ধরনের কেমিক্যাল কিংবা বিষাক্ত দ্রব্য এখানে মেশানো হয় না। অন্য এলাকার শুঁটকির চেয়েও এসব শুঁটকির ঘ্রাণ আলাদা, খেতেও সুস্বাদু। আছদগঞ্জে আমাদের শুঁটকি সোনাদিয়া থেকে আসা শুঁটকির চেয়েও বেশি দামে বিক্রি হয়। কর্ণফুলীর মুখরোচক শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্য, হংকং, চীন ও তাইওয়ানের মতো দেশেও আমাদের শুঁটকির কদর রয়েছে।
শুটকি ব্যবসায়ীরা বলছেন, আছদগঞ্জে শুঁটকির ৪০টি আড়ত রয়েছে। ছোট–বড় দোকান রয়েছে ২৭০টির মতো। ওখানে চট্টগ্রাম ও কঙবাজারের উৎপাদিত শুঁটকি আসে। প্রতি মৌসুমে চট্টগ্রামের এসব শুঁটকি আড়তে মাছের গুঁড়াসহ ৪০ থেকে ৪৫ হাজার মেট্রিক টন শুঁটকি আসে; যার বাজার মূল্য ৮০ থেকে ১০০ কোটি টাকা।
এদিকে লাক্ষ্যা ও রূপচাঁদা শুঁটকি সাধারণের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। বর্তমানে এক কেজি রূপচাঁদা শুটকি ২৫০০ থেকে ৩০০০ টাকা এবং লাক্ষ্যা ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। ছুরি শুটকি ১০০০ থেকে ১২০০ টাকা কেজি, লইট্যা শুঁটকি সাড়ে ৬শ থেকে ৭শ টাকার মধ্যে বিক্রি হয়। ইচা শুঁটকি প্রতি কেজি ১০০০ থেকে ১২শ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
চট্টগ্রাম মৎস্য অধিদফতর সূত্র জানায়, এক সময় চট্টগ্রামে ৪০ থেকে ৪৫ প্রজাতির মাছের শুঁটকি তৈরি করা হতো। এখন অনেক কমে এসেছে।