চট্টগ্রামের ঐতিহ্য নানা দিক দিয়ে সমৃদ্ধ। সেই ঐতিহ্য ইতিহাস দিয়ে হোক কিংবা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতির চর্চা দিয়ে হোক। চট্টগ্রাম অনেক কিছুরই পথিকৃৎ। আর চট্টগ্রামের খাবারেরও রয়েছে একটি দারুণ ঐতিহ্য। চট্টগ্রামের মেজবান আমাদের চট্টগ্রামের সংস্কৃতির একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে বহু আগে থেকেই। মেজবানের সুনাম দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও ছড়িয়েছে। আর চট্টগ্রামের মানুষরা বেশ অতিথিপরায়ণ। সারা দেশের লোকেরা এটা এক বাক্যে স্বীকার করবেন। এ চট্টগ্রামের ঐতিহ্যের কিছু খাবার আছে। এসব খাবারের পাশে শুঁটকির নামটি বেশ গৌরবের সহিত উচ্চারিত হয়। আমাদের বন্দর নগরী চট্টগ্রাম যে সব খাবারের জন্য বিখ্যাত শুঁটকির তাদের মধ্যে অন্যতম। চট্টগ্রামের শুঁটকির স্বাদ সহজে কেউ ভুলতে পারে না। দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে অনেকে চট্টগ্রাম শহরে বেড়াতে আসলে বা কক্সবাজার গেলে পরিবারের জন্য কেউ শুঁটকি ছাড়া ফেরে না। একসময় বলা হতো শুঁটকি হচ্ছে গরিবের খাবার। সেই শুঁটকি এখন আভিজাত্যের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে। আমাদের দেশে শীতকাল শাকসবজির উৎপাদনের একটি ভরা মৌসুম। এ সময় নানা ধরনের সবজির সাথে শুঁটকির রান্না নানা ধরনের বৈচিত্র্যের সমাহার ঘটায়। এই সময়ে কোনো হোটেল খেতে বসলে নানা খাবারের পাশাপাশি সীম দিয়ে ছুরি শুঁটকির তরকারির নাম শোনা যায়। নানা ধরনের সবজির সাথে ছুরি শুঁটকি, তেল–পেঁয়াজ–মশলা দিয়ে লইট্টা শুঁটকি এবং মরিচ–পেঁয়াজ–সরিষা মেখে ঝাল ঝাল চিংড়ি শুঁটকির ভর্তার কথা বলতেই এক ধরনের ভালোলাগা জেগে ওঠে। এই সমস্ত মুখোরোচক খাবারের জন্য শুধু চাটগাঁবাসী নয়, দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরও এক ধরনের আগ্রহ থাকে। গরিবের খাবার শুঁটকি এখন আর শুধু গরিবের নয় মধ্যবিত্তসহ সবশ্রেণির মানুষের খাবার টেবিলে জায়গা করে নিয়েছে। এমনকি বর্তমানে বিয়ের খাবারের মেন্যুসহ অভিজাত হোটেল রেস্তোরাঁয়ও এটি একটি উপাদেয় খাদ্য। অনন্য স্বাদের কারণে শুঁটকির জনপ্রিয়তা এখন দেশে–বিদেশে। চট্টগ্রামের অনেক লোকের বন্ধুবান্ধব রয়েছে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে। তাদের অনেকেই আবদার করেন তাদের কাছে চট্টগ্রামের শুঁটকি পাঠানোর জন্য। আবার নিজেদের অনেকের প্রিয়জন চট্টগ্রাম আসলে খুশি করার জন্য তাদেরকে উপঢৌকন হিসাবে নানা ধরনের শুঁটকি কিনে দিয়ে থাকেন। চট্টগ্রামের লোকদের অতিথিপরায়ণতার এটি অন্যতম একটি দিক। নানা কারণে বৃহত্তর চট্টগ্রামের শুটকির বাজার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। তার অন্যতম কারণ সাগর বেষ্টিত এ অঞ্চল হচ্ছে প্রচুর সামুদ্রিক মাছের চারণভূমি। এ সামুদ্রিক মাছ থেকেই নানা ধরনের শুটকি শুকিয়ে তৈরি করা হয়। সাধারণত দেখা যায় রুপচাঁদা, লইট্টা, ছুরি, ছোট চিংড়ি, পুঁটি, কাঁচকিসহ প্রায় ১৭ রকমের মাছ থেকে শুঁটকি তৈরি হয়। বৃহত্তর চট্টগ্রামের কক্সবাজার, সোনাদিয়া, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, সেন্টমার্টিন দ্বীপসহ বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী এলাকায় শুকনো মৌসুমে সামুদ্রিক মাছের শুঁটকি করা হয় বেশি। কোনো একটা জায়গায় শিল্প গড়ে উঠার পিছনে নানা কারণ থাকে। যেমন বাংলাদেশে চা শিল্প বা গার্মেন্টস শিল্প গড়ে উঠার পিছনে কিছু প্রাকৃতিক কারণ যেমনি আছে তেমনি অপ্রাকৃতিক কারণও আছে। এভাবেই কোনো জায়গায় শিল্প গড়ে ওঠে। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম কেন্দ্রিক শুঁটকি শিল্প একটি প্রচুর সম্ভাবনাময় শিল্প। সস্তা শ্রমিক ও নৌপথে সহজ যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণেই দিন দিন প্রসার ঘটছে শুঁটকির বাজার। শুধু দেশে নয় বিদেশেও ছড়িয়ে আছে চট্টগ্রামের শুঁটকির খ্যাতি। বিদেশে অবস্থান করা অনেকের আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধবদেরকেও চট্টগ্রাম থেকে বিদেশে শুঁটকি পাঠাতে দেখা যায়। তথ্য উপাত্ত পর্যালোচনায় দেখা যায় ১৯৮০ সালের দিকে শুধুমাত্র বাংলাদেশে শুঁটকি তৈরি হতো। এখন সমুদ্র উপকূলবর্তী বিভিন্ন দেশেও শুঁটকি তৈরি হচ্ছে। আমাদের দেশীয় শুঁটকি আমেরিকা, মালয়েশিয়া, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, দুবাইসহ আরও কয়েকটি দেশে রপ্তানি হয়ে থাকে। কিন্তু রপ্তানিকৃত পণ্য হিসাবে এটি এখনও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠেনি। কারণ পর্যাপ্ত সরকারি সুযোগ সুবিধা ও পৃষ্ঠপোষতার অভাব। আমাদের দেশে শীতকাল এবং শীতকাল আসার আগে ও পরে শুষ্ক মৌসুমে সবচেয়ে বেশি শুঁটকি তৈরি হয়। চট্টগ্রামে শুঁটকির ৪০টিরও অধিক আড়ত আছে বলে জানা যায়। চট্টগ্রামের সবচেয়ে বড় শুঁটকির আড়ত আছদগঞ্জ ও চাক্তাই থেকে সারাদেশের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা শুঁটকি নিয়ে যায়। দেশে প্রতিনিয়ত শুঁটকির চাহিদা বাড়ছে সত্যি কিন্তু চাহিদা অনুসারে উৎপাদন বাড়ছে না। ফলে দেশে প্রচুর শুঁটকি উৎপাদন হওয়া সত্ত্বেও শুঁটকির ঘাটতি দেখা দেয়। অথচ যে পরিমাণ সুযোগ সুবিধা থাকা দরকার বা পর্যাপ্ত কাঁচামাল থাকা দরকার এ শিল্প বিকাশের জন্য তা থাকা সত্ত্বেও এ শিল্পের বিকাশের গতি অতি মন্থর। এ শিল্প দ্বারা প্রচুর লোকেরও কর্মসংস্থান হয়েছে। এক সময় চট্টগ্রামই ছিল শুঁটকি তৈরির সূতিকাগার। কিন্তু নব্বই দশকের দিকে বরিশাল পটুয়াখালী ও সুন্দরবনসহ দেশের সাগর উপকূলীয় কয়েকটি জায়গায়ও বাণিজ্যিকভাবে শুঁটকি উৎপাদন শুরু হয়। তবে এর পরিমাণ ছিল খুব কম। যেকোনো পণ্য উৎপাদনের ক্ষেত্রে মানসম্পন্ন পণ্য উৎপাদন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এখানে অভিযোগ আছে কিছু ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে দেশ–বিদেশে চট্টগ্রামের শুঁটকির কদর কমে গেছে অনেকটা। কারণ শুঁটকিতে কৃত্রিম রাসায়নিক মিশানোর কারণে শুঁটকির গুণগত মান ও স্বাদ উভয়টা নষ্ট হচ্ছে। যেভাবে গার্মেন্টস ও চা শিল্প বিকশিত হয়েছে নানা পৃষ্ঠপোষকতায় সেভাবে এ বিষয়টার দিকেও নজর দিয়ে এটিকে একটি উল্লেখযোগ্য রপ্তানিমুখী পণ্যে পরিণত করার প্রয়াস নেয়া দরকার। মনে রাখতে হবে শুঁটকি শুধু নিতান্তই সুস্বাদু খাদ্যই নয়, এর রয়েছে নানা ধরনের পুষ্টিগুণ। দৈনিক প্রথম আলোর গত ৯ ডিসেম্বর ২০২৩ ‘ভালো থাকুন’ কলামে কনসালট্যান্ট পুষ্টিবিদ হাসিনা আকতার লিপি তাঁর লেখা কলামে শুঁকটির নানা পুষ্টিগুণ নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেন, এতে রয়েছে প্রোটিন, আ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, সোডিয়াম, পটাশিয়াম, ফসফরাসসহ নানা ধরনের উপাদান–যা গর্ভবতী, ক্ষীণকায় ব্যক্তি, হাড়, দাঁত, ডিএনএ, আরএনএ গঠনে ভূমিকা রাখাসহ নানা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা সৃষ্টি করে। শুঁটকি মাছে কোলেস্টেরল ও স্যাচুরেটেড ফ্যাট কম থাকায় হৃদরোগ ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীরাও নিশ্চিন্তে এই খাবার খেতে পারেন। শুঁটকি মাছে ক্যালরি কম থাকায় যাঁরা ওজন কমাতে চান, তাঁরাও খাদ্যতালিকায় এটি রাখতে পারেন বলে তিনি পরামর্শ দিয়েছেন। গত ১৯ জানুযারি ২০২১ প্রথম আলোতে এক লেখায় সোনিয়া সাবরিন নামে অন্য একজন পুষ্টিবিদ বলেন, শুঁটকিতে রয়েছে ভিটামিন বি ১২, সেলেনিয়াম ও নায়াসিন নামে আরো কিছু উপাদান যা স্নায়ুতন্ত্রের সুস্থতা ও মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা সঠিক রাখতে এবং লোহিত রক্তকণিকা গঠনে সাহায্য করে। শুঁটকি স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র ও ত্বক সুস্থ রাখে। শুঁটকির এই যে উপকারিতা তা দেশ–বিদেশে প্রচার প্রসার পেলে এর প্রচুর বাজার তৈরি হতে পারে। কারণ ব্যবসায়ে বলা হয় ‘প্রচারই প্রসার।’ গত ১৩ জানুয়ারি ২০২৪ একাত্তর টিভিতে শুঁটকি নিয়ে প্রতিবেদক শাকিলা শম্পা এক প্রতিবেদনে জানান, বৃহত্তর চট্টগ্রাম থেকে সামুদ্রিক মাছ সংগ্রহ করে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গড়ে উঠেছে এক বড় শুঁটকি পল্লী। সেখানে প্রতিবেদক নানা সমস্যা তুলে ধরার পাশাপাশি সম্ভাবনার কথাও তুলে ধরেছেন। প্রতিবেদনে বলা হয় এখানে বছরে প্রায় ১০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয় এবং স্থানীয় মৎস্য কর্মকর্তা জানান শুঁটকি শিল্পকে কৃষি ঋণের আওতায় আনার প্রক্রিয়া চলছে। এখান থেকে প্রচুর শুঁটকি রপ্তানির কথাও বলা হয়। শুঁটকি শিল্পের বিকাশের জন্য এটি একটি আশাপ্রদ সংবাদ। সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকা ছাড়িয়ে এভাবে দেশব্যাপী বিকশিত হতে পারে এ শুঁটকি শিল্প। দেশের অনেক রপ্তানিযোগ্য পণ্য যথাযথ উদ্যোগের অভাবে হারিয়ে গেছে। নানা কারণে আমাদের রপ্তানিকৃত পণ্য চামড়াও আজ হুমকির সম্মুখীন। রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসাবে শুঁটকি প্রচুর বৈদিশিক মুদ্রা উপার্জনের খাত হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। যার জন্য প্রয়োজন উদ্যোগ ও পৃষ্ঠপোষকতা।
লেখক : প্রাবন্ধিক, শিশুসাহিত্যিক। সহকারী অধ্যাপক, বিএমসি ডিগ্রি কলেজ।