ফোকলোর শব্দের অর্থ ‘লোকবিজ্ঞান’ বা ‘লোক–সংস্কৃতি’ বা ‘লোকাচারবিদ্যা’। তার একাধিক ধারা রয়েছে। একটি ধারা হলো লোকসাহিত্য, যা মৌখিকধারার সাহিত্য হিসেবে চিহ্নিত। অবশ্য কোনো কোনো গবেষক পিছিয়েপড়া লিখিত সাহিত্যকেও লোকসাহিত্য বিবেচনা করেছেন। এক্ষেত্রে ড. আহমদ শরীফের কথা উল্লেখযোগ্য। তিনি উনিশ শতকের প্রথমার্ধের অনেককাল পর পর্যন্ত পদসাহিত্য রচিত হওয়ায়, সেই পদসাহিত্যকে ‘পিছিয়েপড়া মনের পরিচায়ক’ অভিহিত করে ‘লোকসাহিত্য হিসেবে বিচার করা উচিত’ বলে মন্তব্য করেছেন তাঁর সম্পাদিত ‘মুসলিম কবির পদসাহিত্য’ শীর্ষক গ্রন্থে। ফোকলোর–এর আরেকটি ধারা হলো লোকশিল্প। লোকসাহিত্যেরও আবার বিভিন্ন শাখা রয়েছে। বিশেষ করে আটটি শাখার কথা বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়: লোকসংগীত, লোকনাট্য, ছড়া, গীতিকা, লোককাহিনী, মন্ত্র, প্রবাদ–প্রবচন ও ধাঁধা।
চট্টগ্রামে প্রত্যেকটি শাখার অস্তিত্ব রয়েছে। আগে লোকসংগীতের কথা বলা যাক। বিভিন্ন ধরনের লোকসংগীত চট্টগ্রামে শোনা বা পাওয়া যায়। চর্যা, বারমাসী, গীতিকা বা পালাগান বা গাজির গান প্রভৃতি এক্ষেত্রে প্রথমেই উল্লেখযোগ্য। চর্যা পাওয়া গেছে চর্যাপদে। ১৯০৭ সালে পণ্ডিত হরপ্রসাদ শাস্ত্রী চর্যাপদ নেপালের রাজদরবারে আবিষ্কার করেন। প্রায় ৯ বছর পর তা নেপালে প্রাপ্ত অন্য তিনটি পুথির সাথে একত্রে প্রকাশ করেন ‘হাজার বছরের পুরান বাঙ্গালা ভাষায় বৌদ্ধগান ও দোহা’ নামে। চর্যাপদ আবিষ্কার ও প্রকাশের পর তা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি নিদর্শন হিসেবে চিহ্নিত হলেও, অনেক গবেষক কর্তৃক তা বাংলা লোকসংগীতের প্রাচীন নির্দশন হিসেবেও চিহ্নিত হয়। এই কারণে চট্টগ্রামের খুবই প্রাচীন লোকসংগীত নির্ণয়ের জন্য চর্যাপদ হয়েছে গুরুত্বপূর্ণ। পণ্ডিতদের দাবি, চর্যাপদের কয়েকজন চর্যাকার চট্টগ্রামের অধিবাসী। ৫ নম্বর চর্যার চর্যাকার চাটিল্লপাদানং সম্পর্কে ড. সত্যব্রত দে তাঁর ‘চর্যাগীতি পরিচয়’ গ্রন্থে বলেন: ‘চাটিল চট্টগ্রামবাসী হইতে পারেন’। দশম শতাব্দীতে চট্টগ্রামের পণ্ডিত বিহারে কাহ্নপাদানং, শবরপাদানং প্রমুখ চর্যাকার অধ্যাপনা করতেন বলে অনেক গবেষকের অনুমান। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, চর্যাপদে চাটিল্লপাদানং প্রমুখ রচিত চর্যা চট্টগ্রামের খুবই প্রাচীন লোকসংগীত।
বারমাসী সম্পর্কে বলতে হয়, চর্যাপদের পরে কিংবা বাংলা সাহিত্যের মধ্যযুগে চট্টগ্রামে তা অজস্র রচিত হয়েছে। বারমাসী গীতিকার চেয়ে প্রাচীন। উদ্ভবকালে তা গীতিকাহিনী হিসেবে লম্বা আকারে রচিত হতে শুরু করে বলে এখনও লম্বাগীতি নামেও পরিচিত। তাতে একটি মাত্র কাহিনী থাকে। বাংলা বারো মাসের নামের আশ্রয়ে কাহিনী বর্ণনা করা হয়। মধ্যযুগে ও পরবর্তীকালে চট্টগ্রামে রচিত হওয়া অধিকাংশ বারমাসীতে নারীর প্রেম–বিরহকাতরতা–সাংসারিক কারণে প্রাপ্ত বেদনা ও মানসিক দুর্দশা করুণ মধুর রূপে প্রকাশিত। আঠারো–উনিশ শতকে আলী রজা ওরফে কানুফকির (১৭৫৯–১৮৩৭), উনিশ–বিশ শতকে আস্কর আলী পণ্ডিত (১৮৪৬–১৯২৭), আবদুল জলিল সিকদার (১৮৫৭–১৯৩৪), সেকান্দর গাইন (১৮৬০–১৯৪২), খাদেম আলী, মোহাম্মদ নছিম, শোকর আলী প্রমুখ দরবেশি বা আধ্যাত্মিক বিষয়, কারবালার ঘটনা, পীরের মৃত্যু, পুত্রহারা পিতার বিলাপ, শিকারের কাহিনী প্রভৃতি নিয়ে বারমাসী রচনা করে তাতে বিষয়ের পরিবর্তনে ভূমিকা রাখেন।
বারমাসীর পরে গীতিকার বয়ান। ইংরেজিতে এই গীতিকাকে বলা হয় ‘ballad’। গীতিকাহিনী রচনার দিক দিয়ে বারমাসীর সাথে একমাত্র মিল রয়েছে গীতিকার। বারমাসীর মতো তাতেও থাকে একটি কাহিনী। চট্টগ্রামে তা পালাগান নামে ব্যাপক পরিচিত। চট্টগ্রামে গাজির গান নামেও গীতিকার পরিচিতি রয়েছে। ইসলাম ধর্মানুসারে, ধর্মযুদ্ধে কেউ মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজি। কিন্তু চট্টগ্রামে গাজির গানের গাজি হলেন গীতিকা বা পালাগানের গায়ক। চট্টগ্রামের বাইরে গাজির গান বলতে বুঝানো হয়, মানত কেন্দ্রিক গান। বিপদ–আপদ–বালা–মসিবত–রোগমুক্তি ও সন্তানপ্রাপ্তির জন্য নিরক্ষর বা অশিক্ষিত লোকজন গাজির গানের আয়োজন করত। নাউট্যা পোয়া (নাটুয়া বালক), বাইন (বাদক) ও দোহারি নিয়ে একজন গাজি (গায়েন বা গায়ক) গাজির গান পরিবেশন করতো।
চট্টগ্রামে ষোলো শতক থেকে উনিশ শতকের মধ্যে প্রচুর গীতিকা বা পালাগান বা গাজির গান রচিত হয়েছে। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ষোলো শতক থেকে উনিশ শতকের সৃষ্টি হলো গীতিকা। সম্ভবত ষোলো শতক থেকেই চট্টগ্রামে গীতিকা রচিত হচ্ছে। এখানের ‘ভেলুয়া’ গীতিকাটি ষোলো শতকের ঘটনা নিয়ে রচিত হয়। হামিদুল্লাহ খান প্রণীত ‘তারিখ–ই–হামিদী’ গ্রন্থে বলা হয়, ষোলো শতকে হোসেন শাহের পুত্র নসরত শাহের সময়ে এই ঘটনা ঘটে। চট্টগ্রামে প্রচুর গীতিকা রচিত হলেও অনেক গীতিকা বিলুপ্ত। স্যার আশুতোষ চৌধুরী ‘ভেলুয়া’সহ ৭৬টি গীতিকা, আবদুস সাত্তার চৌধুরী বাংলা একাডেমি নিয়োজিত সংগ্রাহক হিসেবে ১৯৬১–১৯৬৬–র মধ্যে ২১টি গীতিকা সংগ্রহ করেন। শামসুল আরেফীনের ‘বাংলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য’ গ্রন্থের প্রথম খণ্ডে ‘ভেলুয়া’ (অন্য পাঠ) নামে একটি এবং দ্বিতীয়–চতুর্থ খণ্ডে ‘দুই সতীনের ঝগড়ার কবিতা’ নামে একটি গীতিকা সংকলিত হয়েছে। সংগ্রাহক শামসুল আরেফীন। স্যার আশুতোষ চৌধুরী সংগৃহীত ৭৬টি গীতিকার মধ্যে ৯টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডক্টর দীনেশচন্দ্র সেনের সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘পূর্ববঙ্গ গীতিকা’ গ্রন্থে সংকলিত হয়। ৭৬টি গীতিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ‘সুজা তনয়ার বিলাপ’, ‘কমল সওদাগর’, ‘হাতীখেদা’, ‘পরীবানুর হঁঅলা’, ‘নিজাম ডাকাতের পালা’, ‘কাফন চোরা’, ‘ভেলুয়া’, ‘নছর মালুম’, ‘মজুনা’, ‘নুরুন্নেহা ও কবরের কথা’ ও ‘দেওয়ান মনুহর’ ইত্যাদি।
চট্টগ্রামে গীতিকা বা পালাগান বা গাজির গান গেয়েছিলেন ওমর বৈদ্য, সেকান্দর আলী ওরফে সেকান্দর গাইন (গায়েন), পৈথানচন্দ্র দে, অলিয়র রহমান (অইল্যা আঁধা), নূর হোসেন, বেলায়েত আলী, নবচন্দ্র ধুপি, গুণা মিঞা, আঁধা মকবুল, হাকিম খাঁ, হায়দার আলী, ওজু পাগলা, জেবল হোসেন (রাউজান), ইসমাইল (লাম্বুর হাট) ও আরো অনেকে।
চট্টগ্রামে চর্যা, বারমাসী, গীতিকা বা পালাগান বা গাজির গান ছাড়াও হঁঅলা, মাইজভাণ্ডারি গান, জাহাঁগিরি সংগীত, জারি গান বা মর্সিয়া, কীর্তন, হাইল্যা সাইর ও পাইন্যা সাইর, ফুলপাঠ গান, হালদাফাডা গান, গোরব পোয়ার গান, চাটগাঁইয়া গান, কবিগান, বৃষ্টি ডাকার গান, রোদ ডাকার গান, কর্ণফুলীর গান, শঙ্খ নদীর গান, ইলিশ মাছের গান, মাঝিমাল্লাদের গান, মুর্শিদি গান, পোনা নর্তকীর গান, রেঙ্গুন বিষয়ক গান, মারফতি গান, মোহছেন আউলিয়ার গান, ঋতুর গান, পুরাণ অবলম্বনে সৃষ্ট গান, নকশবন্দিয়া তরিকার গান, ভিক্ষুকের গান, আলী নগর দরবারের গান, দুর্ভিক্ষের গান, মুক্তিযুদ্ধের গান, ভাষা আন্দোলনের গান, জেলেদের গান ও ইসলামি গান প্রভৃতিও রয়েছে। কয়েকটির বর্ণনা প্রদান করা হলো।
হঁঅলা: চট্টগ্রামে মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে কানফোরা (কানছেদানি), নাকফোরা (নাকছেদানি), খৎনা ও বিবাহের অনুষ্ঠানে হঁঅলা গাওয়া হত। মেয়েরা গোল হয়ে বসলে মাঝখানের খালি জায়গায় শিল্পী হালকা নাচ সহকারে হঁঅলা গাইতো। হঁঅলাকে মেয়েলি গানও বলা হয়।
হিন্দুদের অন্নপ্রাসন ও বৌদ্ধদের কোনো কোনো অনুষ্ঠানেও হঁঅলা ঢুকে পড়েছিল। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে হঁঅলার পরিবেশনায় প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষের প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ। সুললিত সুরে মেয়ে শিল্পীর হঁঅলা পরিবেশনার কারণে কানফোরা, বিবাহ প্রভৃতি অনুষ্ঠান পেতো নতুন মাত্রা। বর্তমানে গ্রামীণ জনপদে কদাচিৎ এসব অনুষ্ঠানে হঁঅলা গাইতে দেখা যায়। হঁঅলার ইতিবৃত্ত বিচারে অনুমেয়, সতেরো শতকের পূর্বে চট্টগ্রামে হঁঅলা গাওয়া হতো।
চট্টগ্রামের হঁঅলাগুলোর মধ্যে সম্ভবত সবচে’ জনপ্রিয় ও বিখ্যাত ‘মনুমিয়া–মলকাবানুর হঁঅলা’।
মাইজভাণ্ডারি গান: চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার মাইজভাণ্ডার গ্রামে জন্মগ্রহণকারী সাধক সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (১৮২৬–১৯০৬) এই গ্রামে মাইজভাণ্ডারি তরিকার প্রবর্তন করলে, এই তরিকাকে কেন্দ্র করে মাইজভাণ্ডারি গানের সূচনা হয়। তরিকাটির প্রবর্তনকালের পর থেকে আজ অব্দি অগণিত মাইজভাণ্ডারি গান রচিত হয়েছে। এই গানের সূচনাপর্বের গীতিকার হলেন আস্কর আলী পণ্ডিত, আবদুল গণি কাঞ্চনপুরী (১৮৬৪–১৯২৭), আবদুল হাদী কাঞ্চনপুরী, আবদুল্লাহ বাঞ্জারামপুরী, মাওলানা বজলুল করিম মন্দাকিনী প্রমুখ।
জাহাঁগিরি সংগীত: চট্টগ্রামের সাতকানিয়া উপজেলার মির্জারখীল গ্রামে জন্মগ্রহণকারী শেখ মোখলেছুর রহমান এই গ্রামে জাহাঁগিরিয়া তরিকার প্রবর্তন করলে, এই তরিকাকে কেন্দ্র করে জাহাঁগিরি সংগীতের উৎপত্তি হয়। উৎপত্তিকাল উনিশ শতকের শেষার্ধ। তখন সাধক শেখ মোখলেছুর রহমানের শানে অনেক গান রচিত হয়েছে। পরবর্তীকালে তাঁর পুত্র আবদুল হাই প্রমুখকে নিয়ে গান রচিত হয়। উল্লেখযোগ্য গীতিকার হলেন আবদুল জলিল সিকদার, মোজহেরুল আলম ওরফে ছাহেব মিয়া, কমর আলী হেফাজতুর রাহমান খান ও খাদেম আলী প্রমুখ।
জারি গান বা মর্সিয়া : জারি শব্দের অর্থ বিলাপ বা ক্রন্দন। কারবালার ঘটনা বা ১০ মহরমকে কেন্দ্র করে রচিত গানকে জারি গান বা মর্সিয়া বলা হয়। কারবালার যুদ্ধে ইমাম হোসেন এবং তাঁর সহযোগী অন্যান্যদের করুণ পরিণতি বরণের কাহিনী, তাঁর আত্মীয় নারী ও শিশুদের বন্দি হওয়ার কথা এই গানে বর্ণনা করা হয়। চট্টগ্রামে সাধারণ মুসলমানরা কালের পর কাল ধরে ইমাম হোসেনের শহীদ হওয়ার দিনে অর্থাৎ ১০ মহরমের দিনে মহরম বা আশুরা উদযাপন করছে। সেদিন, তার আগের দিন ও পরের দিন তারা রোজা আদায় করে। সেদিন তারা সত্তর দানার ভাত ও মাংসও ফাতেহা দেয়। এছাড়া অনেকে জারি গানও শোনে। চট্টগ্রাম শহরে একসময় ব্যাপকভাবে শিয়া মুসলমানরাও মহরম বা আশুরা উদযাপন করতো। ‘হায় হোসেন, হায় হোসেন’ বলে শিকল ও শিকলে যুক্ত করা ছুরির ধারালো ফলা দ্বারা আঘাত করে নিজেদের রক্তাক্ত ও আহত করতো।
সেদিন তারা চট্টগ্রাম কলেজ সংলগ্ন প্যারেড ময়দানে লাঠি খেলা ও তাজিয়া মেলার আয়োজন করতো, এছাড়া বাঁশের মাথায় চট যুক্ত করে তাতে কেরোসিনের সাহায্যে আগুন লাগাতো। সেদিন তারাও বিষাদিত মনে সাধারণ নৃত্যসহযোগে গাইতো ‘শহরবানুর বিলাপ’ নামে জারি গান।
কীর্তন: চৈতন্যের মৃত্যুর পরে চট্টগ্রামে কীর্তনের চর্চা শুরু হয়। সেসময় থেকে চট্টগ্রামে পাল্টা কীর্তন, পালা কীর্তন, নাম কীর্তন, ঢপ কীর্তন, বুদ্ধ কীর্তন প্রভৃতি হয়েছে। এখনও কদাচিৎ হয়। এখন হিন্দুদের মহোৎসবগুলোতে অষ্টপ্রহর কিংবা ষোড়শপ্রহর নাম সংকীর্তন হতে বেশ দেখা যায়। বিশ শতকের সত্তর দশক পর্যন্ত পালা কীর্তন হয়েছে। মনোরঞ্জন দে, সত্যেন্দ্র রুদ্র, কৃষ্ণ ঠাকুর, জ্ঞানসাধু, শ্যামা ঠাকুর, মহেন্দ্র চক্রবর্তী, বামা ঠাকুর ও বনবীথী সেনগুপ্তা প্রমুখ পালা কীর্তন, গোপাল ব্যানার্জি ও তাঁর জনক মাখনলাল ব্যানার্জি পদাবলী কীর্তন করে খ্যাতি অর্জন করেন। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে বেশ বুদ্ধ কীর্তন হয়েছে সত্তর দশকের পর পর্যন্ত। ওস্তাদ জগদানন্দ বড়ুয়ার জনক মোহনচন্দ্র বড়ুয়া (১৮৮১–১৯৭৫), যিনি নিজেও কীর্তনিয়া ছিলেন, তিনি বুদ্ধ কীর্তন রচনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
হাইল্যা সাইর ও পাইন্যা সাইর: হাইল্যা সাইর ও পাইন্যা সাইরকে বলা যেতে পারে কৃষকের গান। চট্টগ্রামে আমন মৌসুমে একদিনে কয়েক কানি জমিতে ধান–চারা রোপণের আয়োজন করা হলে, ২৫/৩০ জন হাইল্যা (চাষা বা কৃষক) একত্রে হাইল্যা সাইর গেয়ে ধান–চারা রোপণ করে। একজন থাকে মূল গায়ক, অন্যরা দোহার। তারা ধুয়া বা ঘোষা গায়। চট্টগ্রামের সন্দ্বীপ উপজেলায় হাইল্যা সাইরকে পাইন্যা সাইর বলা হয়। বর্ষাকালে কৃষকরা দু’দলে বিভক্ত হয়ে জমিতে ধান–চারা রোপণ করার সময় এই গানের প্রতিযোগিতা করে। গান শুনতে গ্রামের লোকজনের সমাগম ঘটে। দল দু’টোতে একজন করে মূল গায়ক বা কবিয়াল থাকে।
ফুলপাঠ গান: হিন্দুদের মধ্যে কারও সন্তান–সন্ততি না হলে, তার কোলজুড়ে সন্তান আসার জন্য এ–গান মানত করা হতো। নানা সূত্রে জানা যায়, মৎস্যজীবী ও বাদ্যকর শ্রেণির অনুন্নত হিন্দু সম্প্রদায় ডোম নাচ সহকারে এ–গান পরিবেশন করতো।
হালদাফাডা গান: পার্বত্য চট্টগ্রামের খাগড়াছড়ি জেলার মানিকছড়ি উপজেলার বাটনাতলী ইউনিয়নের সালদা নামে পাহাড়ি গ্রামটি হালদা নদীর উৎসস্থল। সালদা গ্রামে রয়েছে সালদা নামে পাহাড়ি ঝর্ণা। এই সালদা থেকে হালদা নামের উৎপত্তি। বৃহত্তর চট্টগ্রামে আন্তর্জাতিকভাবে প্রসিদ্ধ এই হালদা নদীর নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে হালদাফাডা গান। মলয় ঘোষ দস্তিদার তাঁর এক গানে হালদাফাডা গানের কথা স্মরণ করেছেন: ‘হালদাফাডা গান হুনাইয়া মাঝি/সাম্পান যার গই পাল তুলি’।
গোরব পোয়ার গান: গোরব পোয়া মানে রাখাল বালক। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে এখনও রাখাল বালকদের গরু ও মহিষ চরানো এবং তাদের গান গাওয়ার চিত্র নজরে পড়ে। চট্টগ্রামে সেই চিত্র এখন নেই বললেই চলে। তবে বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মতো, নিকট অতীতে, চট্টগ্রামেরও ঘরে ঘরে হাল–চাষের প্রয়োজনে গরু পালন করা হতো। গৃহস্থ কর্তৃক গরুর দেখাশুনার জন্য নিয়োজিত হতো গোরব পোয়া বা রাখাল বালক। তারা মাঠে মাঠে গরুর পাল চরাতো। তখন এক ধরনের গানও গাইতো। সেগুলোকে অভিহিত করা হতো ‘গোরব পোয়ার গান’। সেই গানে প্রকাশ পেতো তাদের সুখ–দুঃখ ও আনন্দ–বেদনা।
খ.
লোকসংগীতের পরে লোকসাহিত্যের অন্যতম শাখা ধাঁধা, প্রবাদ–প্রবচন, মন্ত্র, লোককথা বা লোককাহিনী, লোকনাট্য ও ছড়ার বিবরণ:
ধাঁধা: ধাঁধাকে লোকসাহিত্যের প্রাচীনতম শাখাগুলোর মধ্যে অন্যতম গণ্য করা হয়। ‘ধন্দ’ থেকে উৎপত্তি হওয়া ধাঁধা শব্দের আরেক নাম হেঁয়ালি, যার অর্থ সংশয় বা সন্দেহ। এটাও বলা হয় যে, ধাঁধার আরেক অর্থ ‘দুরূহ সমস্যা’। পল্লির অধিবাসীদের অভিজ্ঞতা ধাঁধার মধ্যে লিপিবদ্ধ থাকে। একটি ধাঁধায় থাকে একটিমাত্র প্রশ্ন, উত্তরটিও তার মধ্যে লুকায়িত থাকে। বস্তুত উপমা–রূপক–প্রতীকের সাহায্যে মূল বিষয় আড়াল করে ধাঁধা রচনা করা হয়। ফলে ধাঁধা থেকে জবাব বের করার জন্য উত্তরদাতাকে উপমা–রূপক–প্রতীকের রহস্যভেদ করার কসরত করতে হয়। এ থেকে বোঝা যায়, ধাঁধায় কল্পনার মিশ্রণ থাকলেও তা আবেগমুক্ত ও বুদ্ধিগ্রাহ্য; জ্ঞান ও রসের বিষয়।
চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে আমাদের সংগৃহীত কয়েকটি ধাঁধা উপস্থাপন করছি:
১.
একূলত্তুন ওই কূলত যায়, ধফর ধফর আছার খায়। উত্তর: ঝাড়ু
(একূল থেকে ওই কূলে যায়, ধড়ফর করে আছার খায়)
২.
আঁধার ঘরে বাঁদর নাচে, না না করলে আরও নাচে। উত্তর: জিহ্বা
৩.
লম্বা বেটি লম্বা চুল, পোয়া বেয়াগ্গুন ঘোল ঘোল। উত্তর: সুপারি গাছ
(লম্বা মেয়ে লম্বা চুল, সকল ছেলে গোল গোল)
প্রবাদ–প্রবচন: প্রবাদ মানে বিশেষ উক্তি বা বিশেষ কথন। বেদ–উপনিষদ ও চর্যাপদে প্রবাদের প্রয়োগ রয়েছে। প্রবাদ সহজ–সরলভাবে রূপক অর্থ প্রকাশ করে, যা খুবই গভীর ও গুরুত্বপূর্ণ। অর্থের দিক দিয়ে প্রবাদকে বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা যেতে পারে; যেমন, ‘সাধারণ অভিজ্ঞতামূলক,…নীতিমূলক,…সমালোচনামূলক,…সামাজিক রীতিবিষয়ক,…ব্যঙ্গাত্মক’।
চট্টগ্রামে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে অজস্র প্রবাদ–প্রবচন। এই অঞ্চল থেকে আমাদের সংগৃহীত কয়েকটি প্রবাদ–প্রবচন তুলে ধরছি :
১.
বিল্লা কুঁউরে ইয়াল ন ধরে।
(বিলের কুকুর শিয়াল ধরে না)
২.
কান টানলে মাথা আসে।
৩.
লড়তে চড়তে বারো মাস।
(নড়তে চড়তে বারো মাস)
মন্ত্র: রোম, মিসর ও গ্রিস অঞ্চলে হাজার হাজার বছর আগে মন্ত্রের ব্যবহার ও মন্ত্রের উপর বিশ্বাস ছিল। বৈদিক সাহিত্যেও মন্ত্রের প্রয়োগ রয়েছে, যেমন, গায়ত্রী মন্ত্র ও কুবের মন্ত্র। এই মন্ত্র দুটোসহ বৈদিক সাহিত্যের অন্যান্য মন্ত্রগুলোকে প্রায় তিন হাজার বছরের পুরনো মনে করা হয়। বৈদিক সাহিত্যে প্রয়োগের কারণে এই মন্ত্রগুলো যে সাহিত্যিক ঘরানার, তা সহজে বোঝা যায়। কিন্তু প্রাচীনকাল থেকে অনেক লৌকিক মন্ত্রও রচিত হয়েছে। এসব লৌকিক মন্ত্র মানুষের কল্যাণ ও অকল্যাণ সাধনের কাজে প্রাচীনকাল থেকে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। বিশ ও একুশ শতকে বিজ্ঞানের চরম উৎকর্ষ সত্ত্বেও অজস্র সাধারণ মানুষ আজও বিশ্বাস করে, সেসব মন্ত্র দ্বারা কল্যাণ ও অকল্যাণ সাধন করা সম্ভব। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রচলিত একটি লৌকিক মন্ত্রের অংশবিশেষ:
বর্মা ঝাড়ার মন্ত্র
নিপক ডাইনের আছর ছাড়।
ন ছাইল্যে মাইজ্যম তোরে,
বড় পীর সাহেব গদার বারি।
দোহাই আল্লাহর।
ছাড় ! ছাড় !
লোককথা বা লোককাহিনী: ইংরেজিতে লোককথা বা লোককাহিনীকে Folktale বলা হয়। লোককথা বা লোককাহিনী অনেক ধরনের হয়ে থাকে; যেমন, Fairy-tales (রূপকথা বা পরীকাহিনী), Novlla (রোমাঞ্চ কথা), Novlla-Marchen, Etiological বা Tale Nature-Sage, Tales of Lying (গাঁজাখোরী গল্প), Enigma (বুদ্ধি পরীক্ষার গল্প), Chain Tale (শিকারী গল্প) প্রভৃতি। স্টিথ থম্পসন ও আর্না কর্তৃক সম্পাদিত The Types of the Folktale গ্রন্থে লোককথা বা লোককাহিনীকে ২৪৯৯ ভাগে ভাগ করা হয়েছে।
আমাদের দেশে চট্টগ্রামের চন্দনাইশসহ বিভিন্ন অঞ্চলে বিভিন্ন ধরনের লোককাহিনী এখনও শুনতে পাওয়া যায়। চট্টগ্রামের চন্দনাইশের হাশিমপুর ইউনিয়নের উত্তর হাশিমপুরের ভাইখলিফা পাড়া নিবাসী আমেনা বেগমের স্মৃতি থেকে আমরা সংগ্রহ করেছি একটি লোককাহিনী, যা আসলে Fairy-tales (রূপকথা বা পরীকাহিনী)-এর অন্তর্ভুক্ত, তার নাম ‘নবকুমার, দুধকুমার ও রাক্ষস’।
লোকনাট্য: সাধারণ লোকজনের জীবন বা গল্প অবলম্বনে যে–নাটক গড়ে উঠে, যা মানুষের মুখে মুখে প্রচলিত ও প্রচারিত থাকে, তা’ই লোকনাট্য। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চলে লোকনাট্য পরিবেশিত হওয়ার কথা শোনা যায়। পটিয়ার সুচক্রদন্ডী গ্রামের উমাচরণ সাব জজের বাড়িতে, ১৮৭৩ খ্রিস্টাব্দে, মহাভারত ও রামায়ণের একটি কাহিনী অবলম্বনে একটি থিয়েটার মঞ্চস্থ হয়েছিল। এটা ছিল পটিয়া অঞ্চলের প্রথম মঞ্চস্থ থিয়েটার। শ্যামাচরণ খাস্তগীরের নির্দেশনায় মঞ্চস্থ হওয়া এই থিয়েটারটি চট্টগ্রামের প্রথম মঞ্চস্থ থিয়েটার বলেও দাবি করা হয়।
চট্টগ্রাম শহরেও তৎকালে লোকনাট্য পরিবেশিত হয়েছে। ১৮৯৭ সালে প্রকাশিত হয়েছিল ‘একশৃঙ্গ নাটক বা ভগবান বুদ্ধদেবের পূর্ব্ব জীবনী’। নাটকটির রচয়িতা চট্টগ্রাম কলেজের সংস্কৃতের অধ্যাপক কৃষ্ণপদ বিদ্যারত্ন (শর্মা)। চৌধুরী জহুরুল হক এই নাটকটির সংগ্রাহক। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগ নাটকটি পুনর্মুদ্রণ করেছিল। আজ থেকে প্রায় একশত বছর পূর্বে এই নাটকটি মঞ্চায়ন করা হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। পরবর্তীকালে অর্থাৎ বিশ শতকের প্রথমার্ধে আরও নানাভাবে চট্টগ্রাম শহরে ও শহরের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে লোকনাট্য পরিবেশিত হয়েছে। এক্ষেত্রে রাউজানের তেজেন্দ্র ধর ও হরেন্দ্র ধরের কথা উল্লেখনীয়। রাউজানের ধর পরিবারের এই ব্যক্তিদ্বয় বিশ শতকের প্রথম দশকে লোকনাট্য পরিবেশনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। বোয়ালখালীর কদুরখীলে মিলন মন্দির নামে একটি মন্দির ছিল, যেখানে একটি মুক্তমঞ্চ ছিল। এটি মণ্ডপ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। এই মুক্তমঞ্চে বা মণ্ডপে সার্বজনীন পূজা শেষে প্রতিমা বিসর্জনের পরে একে লোকনাট্য পরিবেশনের মঞ্চ হিসেবে ব্যবহার করা হতো। এছাড়াও বোয়ালখালীর কদুরখীলের বিভিন্ন স্থানে ও কানুনগো পাড়ায়; পটিয়ার ধলঘাট, কেলিশহর, খরনখাইন, হাবিলাস দ্বীপ, বাগদণ্ডী প্রভৃতি এলাকায় লোকনাট্য মঞ্চায়িত হতো। পটিয়ায় তৎকালীন লোকনাট্য মঞ্চায়নে সুবোধ রায় ও বীরেন্দ্র চৌধুরী নামে দু’ব্যক্তি উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে যেসব নাট্য সংগঠন চট্টগ্রাম শহরে ও শহরের বাইরে বিভিন্ন অঞ্চলে লোকনাট্য পরিবেশন করেছিল, সেসব সংগঠনের মধ্যে ‘ডেঙ্গাপাড়া সুহৃদ সংগীত সম্মিলনী’ প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। সংগীত ও নাটকের এই সংগঠনটির নেতৃত্বে ছিলেন চট্টগ্রামের ডেঙ্গাপাড়ার অশ্বিনীকুমার দাশ। এর সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিলেন যোগেশ চক্রবর্তী, সাতকড়ি দাশ, তারাকিঙ্কর ঘোষ, বিজয় দত্ত, শীতল দত্ত, সুরেন ঘোষ প্রমুখ। নাটক পরিচালক ছিলেন ডা. বিনোদ মিত্র। ‘ডেঙ্গাপাড়া সুহৃদ সংগীত সম্মিলনী’ তার প্রতিষ্ঠাকাল থেকে যাত্রা ও পৌরাণিক নাটক মঞ্চায়ন করেছিল। অশ্বিনীকুমার দাশের বাড়ির আঙিনায় নাটক মঞ্চায়নের জন্য মুক্তমঞ্চ স্থাপন করা হয়েছিল।
পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আমলেও চট্টগ্রাম শহর ও শহরের বাইরের বিভিন্ন অঞ্চলে অনেক লোকনাট্য পরিবেশিত হয়েছে।
ছড়া: লোকসাহিত্যে ছড়া বলতে লৌকিক ছড়াই বোঝানো হয়। লৌকিক ছড়াকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করা যায়, যেমন, শিশুতোষ ছড়া অর্থাৎ ছেলে ভোলানো ও ঘুমপাড়ানির ছড়া, সামাজিক ছড়া, খেলার ছড়া, ঐতিহাসিক ছড়া, রাজনৈতিক ছড়া ইত্যাদি। ছড়ার ছন্দে রচিত হওয়া কিশোর কবিতাকেও ছড়ার একটি শ্রেণি মনে করা হয়। চট্টগ্রামে প্রাচীনকাল থেকে লৌকিক ছড়ার চর্চা থাকলেও বর্তমানে লৌকিক ছড়ার সন্ধান মেলে খুবই কম। এই অঞ্চল থেকে আমাদের সংগৃহীত একটি খেলার ছড়া নিচে তুলে ধরা হলো :
ইচকি মিচকি কাইমের দারা
কাইম গেইয়্যে রাজার পাড়া।
রাজার বউয়ের লম্বা চুল,
কাটতে কাটতে বাইট্টা চুল।
ঘ.
পূর্বেই বলেছি, লোকসাহিত্যের বিশেষ করে আটটি শাখার কথা বিভিন্ন সময়ে উল্লেখ করা হয়: লোকসংগীত, লোকনাট্য, ছড়া, গীতিকা, লোককাহিনী, মন্ত্র, প্রবাদ–প্রবচন ও ধাঁধা। চট্টগ্রামে প্রত্যেকটি শাখার রচনা যেহেতু এখনও পাওয়া যায়, সুতরাং এসব শাখার রচনাসমূহ সংগ্রহ করা প্রয়োজন। লোকসাহিত্য সংগ্রহের ব্যাপারে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত নিয়মগুলো অনুসরণ করে চট্টগ্রামের লোকসাহিত্য বা এই লোকসাহিত্যের প্রাগুক্ত প্রত্যেকটি শাখার রচনা উদ্ধারে লোকসাহিত্য গবেষকরা এগিয়ে আসবেন, এই কামনা করি। [পুনশ্চ: তথ্যসূত্রগুলো এই প্রবন্ধটি আমার কোনো গ্রন্থে প্রকাশের সময় উল্লেখ করা হবে]
লেখক: লোকসাহিত্য ও মুক্তিযুদ্ধ গবেষক।