প্রথম পর্বের পর
‘আঁর বউয়রে আঁই হাসাইয়ম’ গানে একালের গ্রামীণ জনপদের কতিপয় কুটিল নারীদের কথা বর্ণিত। তারা স্বামী-স্ত্রীর যে কোন ব্যাপারে অনধিকার চর্চা করে এবং স্ত্রীকে স্বামীর বিরুদ্ধে ‘কুতাল’ (কুমন্ত্রণা) দেয় এই স্বামী-স্ত্রীর সংসার ভেঙে দেওয়ার সংকল্পে। স্বামী এসব কুটিল নারীর উপর খুবই ক্ষিপ্ত। তাদের উদ্দেশ্যে স্বামীর বক্তব্য হলো, আঁর (আমার) বউয়রে (বউকে) আঁই (আমি) হাসাইয়ম (হাসাব)… খাবাইয়ম (খাওয়াব)… তোরা কিল্লাই (কী কারণে) নাক গলচ (গলাস)? আমার স্ত্রী-সন্তানদের কষ্টের সময়, আমার দুঃখের দিনে তোদেরকে তো পাওয়া যায় না। তোরা তো আমাদের জন্য ‘বাআরগ্গা’ (পর)।
আঁর বউয়রে আঁই হাসাইয়ুম আঁই কাঁদাইয়ম
আঁই খাবাইয়ম আঁই পিধাইয়ম
তোরা কিল্লাই নাক গলচ?
আঁই কোয়ান দিন বাআরে গেলে বউ পোয়াগুন কষ্ট পাইলে
কনে কি আর এক মুটা চইল উধার দেয়চ?
রথে হাতে মিন্নত গরি দুঁড়িধাঁড়ি ঘুরিফিরি
বউয়র সুগরলাই,
চাঁই চিতি গজ্জি বিয়া হউরত দিয়া এন সুন্দর বউ
দির নারে দুঁড়াই।
তোরা ত কথার চতুর চুদুর ভুদুর
দুঃখর সমত কঁডে থঅচ?
আঁরা আঁরা বউ জামাই খাই ন খাই পড়ি থাই
বাআরগ্গা তোরা কন?
ন আবি আর ফরত ফরত আঁর ঘরত
চৈধ্যগুষ্টির ঘর ভাইংগ্যা দোষপন।
ঘুচুর ঘুচুর আবি যাবি পান চাবাবি
কুতাল ছাড়া কাম ন পঅচ।
তোরার ঘরত রাইত বেএন্যা কি হাজন্যা
ন দেইর না কি কি কাণ্ড হর,
কার ফেদায় চায় তোরার মিক্যা ঢাক্যা পাইক্যা
কনে কনদি কেএন গরর
কই দির আগে থাইকতে কাম ন বাইত্যে
টেবটেবি ত ন দেখছ।
‘সাম্পান মাঝি সাম্পান বায় আগর মত পেসিঞ্জার ন পায়’ গানে চট্টগ্রামের প্রাচীন ঐতিহ্য সাম্পান ও সাম্পান মাঝির দুর্দশার চিত্র অঙ্কিত। ইঞ্জিল চালিত নৌকার প্রচলনেই এই দুর্দশা। এই নৌকা সাম্পানের চেয়ে অনেক বেশি দ্রুতগতিসম্পন্ন। জোয়ার ও ভাটা যেদিকেই হোক না কেন তা অনায়াসে চলতে পারে এবং সাম্পান যে-পথ এক ঘন্টায় অতিক্রম করে উক্ত নৌকা সে-পথ বিশ মিনিটে পার হয়। একারণে যারা সাম্পানে চড়তো তারা নৌকার যাত্রীতে পরিণত হতে শুরু করে। ফলে সাম্পানের প্যাসেঞ্জার কমে যায় এবং সাম্পান মাঝির আয় হ্রাস পায়। এভাবে সাম্পানের গুরুত্বও কমে যেতে থাকে।
সাম্পান মাঝি সাম্পান বায়
আগর মত পেসিঞ্জার ন পায়।
নৌকার মাথিত ইঞ্জিল দেখি মানুষ গেইএ হেইখ্যা ঝুখি
স’রে স’রে আইবু যাইবু দেরি গইত্যু কনে চায়।
জোয়ার ভাডা যেমিখ্যা যক বোডর ইঞ্জিলে
সাম্পানর এক ঘন্টার পথ টানের বিশ মিনিডে
বুলি পেরেসানি দিলে মাঝির পেরেসানি দিলে।
উগ্যা দু’য়া ভাড়া মারি বই থাকে খুঁডা গারি
পাঁচ ছয়জন লই ন ছাড়িলেমাঝি ভাইউর ন পোষায়।
‘মেজ্যান দিএ মেজ্যান দিএ ঐতারত’ গানে একালের গ্রামীণ জনপদের মেজবানে ধনী-দরিদ্রের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। এই গানে বলা হয়েছে, কোন অবস্থাসম্পন্ন পরিবার কর্তৃক আয়োজিত মেজবানে গরিবদেরকে ‘মেইট্যা বছি’-তে (মাটির থালা) ও ধনীদেরকে সুন্দর বিছানায় ‘বাসনত’ (চিনামাটির বাসনে) খাবার দেওয়া হলো। ধনীদেরকে ‘ঢালি ঢুলি’ (ভালোমতো পরিবেশনের মাধ্যমে বেশ যত্ন-আত্তি করে) এবং গরিবদেরকে বেশ হিসেব করে খাবার পরিবেশন করা হলো। গরিবদেরকে খাবার পরিবেশনের এক পর্যায়ে বলা হলো, আর দেওয়া যাবে না। আবার পরিবারটির বড় ঘরে ‘ছাপ কইয্যা’-দের (উল্লেখযোগ্য ধনীদের) ‘ছঅলর কোরমা’ (ছাগলের কোর্মা) দিয়ে মেহমানদারী করা হলো। অন্যদিকে ‘যারা কামগরনি ডেক মাজনি’ (যারা মেজবানের কাজের মানুষ) ‘মিন্নুত গরি মইল্লো’ (প্রচুর পরিশ্রম করলো) তারা খাওয়ার সময়ে মাংসের বদলে পেলো হাড়।
মেজ্যান দিএ মেজ্যান দিএ ঐতারত
গরিবুল্যাই মেইট্যা বছি, ডঁর মানচুল্যাই বাসনত,
কি সোন্দয্যা বিছানত।
তারা কেঅরে খাবার ঢালি ঢুলি, পান্নি পুছার লইলো,
কেঅরে খাবার মাপিঝুপি আদ্দিতাম নঅ কইলো,
ওরে কন নিয়তে ঢংগর মেজ্যান চাইত রইএ আল্লারত।
আঁই চুপ্পে গরি খাপ্যুয়াই চাইলাম দেইলাম এক কাণ্ড,
ছঅলর কোরমা আল্গা রাঁধি রাই দিএ ভাণ্ড,
ই ইন ছাপ কইয্যা মিসকিনঅলে পেটপুরাই খার বড় ঘরত।
যারা কামগরনি ডেক মাজনি মিন্নুত গরি মইল্লো,
খাইবুর অত্তত তারার পাতত্ ফেরা হাড্ডি পইল্লো,
দুঃখে গব্যাইয়া ন চনি তারা বন্যাই গরের ফজরত।
তিন.
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ছাড়াও চট্টগ্রামের লোকগানের নানা শাখায় গান রচনা করেন সৈয়দ মহিউদ্দিন। এখানে মাইজভাণ্ডারি ও মরমি শাখায় তাঁর গান রচনার কথা উল্লেখনীয়। তিনি মাইজভাণ্ডারি তরিকার ভক্ত ও এই তরিকার মুরশিদের শিষ্য হওয়ায় মাইজভাণ্ডারি গান রচনা করেন, তা সহজেই অনুমেয়। উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার মাইজভাণ্ডার গ্রামে উনিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সাধক সৈয়দ আহমদুল্লাহ (১৮২৬-১৯০৬) মাইজভাণ্ডারি তরিকার প্রবর্তন করেন। তরিকাটি সংগীতাশ্রয়ী হওয়ায় এই তরিকাভিত্তিক গান রচয়িতা আস্কর আলী পণ্ডিত, আবদুল হাদি কাঞ্চনপুরী, আবদুল গণি কাঞ্চনপুরী, রমেশ শীল, বজলুল করিম মন্দাকিনী প্রমুখের উত্তরসূরি হিসেবে সৈয়দ মহিউদ্দিন মাইজভাণ্ডারি গান রচনা করেন। তবে একথা বলা বাহুল্য যে, দীর্ঘকাল ধরে প্রচলিত লোকসুরে অগণিত মাইজভাণ্ডারি গান গাওয়া হলেও সৈয়দ মহিউদ্দিন তাঁর রচিত মাইজভাণ্ডারি গানে মৌলিক সুর সংযোজন করেন। তাঁর রচিত ও সুরারোপিত মাইজভাণ্ডারি গানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য: ১০ই মাঘ আর ২২শে চৈত্র/আশেকগণে ঈদ করে ভাই/আশেকগণে ঈদ করে, আহমদের ‘আ’ লইয়া রহমানের ‘র’ লাগাইয়া/জিন্দা প্রেমের ‘জি’ মিশাইয়া ‘আরজি’ করিলে/ইনশাআল্লাহ কবুল হবে তিলে তিলে প্রভৃতি। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য মরমি গান: আইতে নিজে কান্দিলি যাইকে কান্দাবি স্বজন/দুই কান্দনের বাঁধনে তোর জীবন-মরণ প্রভৃতি।
বরাত:
সৈয়দ মহিউদ্দিন ওরফে মহি-আল-ভান্ডারীর সাথে আলোচনা ও তাঁর কাছ থেকে উপাদান সংগ্রহ।
চট্টগ্রামের লোকগান, শামসুল আরেফীন, দৈনিক পূর্বকোণ, ১১ ফেব্রুয়ারি ২০১৬।
বাঙলাদেশের লোককবি ও লোকসাহিত্য, প্রথম খণ্ড, শামসুল আরেফীন, বলাকা প্রকাশন, ফেব্রুয়ারি ২০০৭।
চট্টগ্রামের আঞ্চলিক গান ছাড়াও চট্টগ্রামের লোকগানের নানা শাখায় গান রচনা করেন সৈয়দ মহিউদ্দিন। এখানে মাইজভাণ্ডারি ও মরমি শাখায় তাঁর গান রচনার কথা উল্লেখনীয়। তিনি মাইজভাণ্ডারি তরিকার ভক্ত ও এই তরিকার মুরশিদের শিষ্য হওয়ায় মাইজভাণ্ডারি গান রচনা করেন, তা সহজেই অনুমেয়। উত্তর চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি থানার মাইজভাণ্ডার গ্রামে উনিশ শতকের প্রায় মাঝামাঝি সাধক সৈয়দ আহমদুল্লাহ (১৮২৬-১৯০৬) মাইজভাণ্ডারি তরিকার প্রবর্তন করেন। তরিকাটি সংগীতাশ্রয়ী হওয়ায় এই তরিকাভিত্তিক গান রচয়িতা আস্কর আলী পণ্ডিত, আবদুল হাদি কাঞ্চনপুরী, আবদুল গণি কাঞ্চনপুরী, রমেশ শীল, বজলুল করিম মন্দাকিনী প্রমুখের উত্তরসূরি হিসেবে সৈয়দ মহিউদ্দিন মাইজভাণ্ডারি গান রচনা করেন।