তখন আমার বালক বয়স। তখন আমার বালকবেলা। এক স্বর্ণালী সন্ধ্যায় কাকা অধ্যাপক সরোজ কুমার বল আমাকে নিয়ে বের হলেন। রিকসা করে গিয়ে নামলেন একটি লাল দালানের সামনে। ভিতরে ঢুকলাম। হীম শীতল বিশাল ঘরখানা। থাকে থাকে বই আর বই। আমি এ প্রথম এতো বই একসঙ্গে দেখলাম। সব ইংরেজি বই। ওটা ছিল আমেরিকান সেন্টার। সে একদিনই। তারপর এখানে আর যাওয়া হয়নি। এটা সম্পর্কে আর কিছু জানাও হলো না। এখন চেড়াগির মোড়ে এর কোনো স্মৃতি চিহ্ন নেই। শুনেছি, এখানে একটা ছোট্ট অডিটোরিয়াম ছিল। এখানেই চট্টগ্রাম গ্রুপ থিয়েটার চর্চার গোড়াপত্তন।
আমার বেশি যাতায়াত ছিল ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে। ওখানেও প্রথম যাই পিতৃব্য অধ্যাপক সরোজ কুমার বলের সঙ্গে। লালদিঘির দক্ষিণ পাড়ে ছিল এর অবস্থান। ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিয়ান ছিল পিতৃব্যের পরিচিত। তিনি আমাকে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন লাইব্রেরিয়ানের সঙ্গে। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে বহুদিন ওখানে গিয়েছি। বই এনেছি। ওখানেও ছিল সব ইংরেজি বই। ইংল্যান্ড থেকে প্রকাশিত বই। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিতে বেশি যাওয়া আসার দুটো কারণ ছিল। একটা কারণ ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরিটা ছিল সেন্ট্রাল এসি। ওখানে গেলে খুব আরাম বোধ করতাম। এছাড়া ওখানে ব্রিটিশ নির্মিত সিনেমা নিয়মিত দেখানো হতো। ইংরেজি সিনেমা। মাসে এক থেকে দু’বার দেখানো হতো। যেদিন সিনেমা থাকত। সেদিন কিংবা আগের দিন লাইব্রেরিয়ান কাকু জানিয়ে দিতেন। প্রচুর সিনেমা এখানে দেখেছি। এখনও যেসব সিনেমার কথা মনে আছে, এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো–গান্ধী, এ প্যাসেজ টু ইন্ডিয়া, শেক্সপিয়রওয়ালা, নাইট মেট, টিন ড্রাম, গোল্ড রাশ, দি কিড, ডক্টর জিভাগো, লোকাল হিরো, মডার্ন টাইমস, ব্ল্যাকমেইল, দি ফ্রেঞ্চ লেফটেন্যান্ট ওমেন উল্লেখযোগ্য। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি থেকে বই আনতে হলে মেম্বার হতে হতো। প্রতিটি মেম্বার একসঙ্গে তিন/চার খানা বই বাড়িতে নিয়ে আসা যেত। আমাকে আমার কাকা অধ্যাপক সরোজ কুমার বল মেম্বার করে দিয়েছিলেন। আমি বই আনতাম বাসায়। ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরির পথচলা শুরু হয় ১৯৫৮ সালে। এখানে ১২ হাজারের অধিক বই ছিল। প্রতি বছর দু’হাজার নতুন বই আসত। আবার দু’হাজার পুরাতন বই তুলে নেওয়া হতো। এসব পুরাতন বই বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে উপহার হিসেবে দেওয়া হতো। ইংল্যান্ডে প্রকাশিত প্রায় ৫০ রকমের পত্রিকা এখানে পাঠকের জন্য রাখা থাকত। নানা ধরনের রেফারেন্স বই পাওয়া যেত। একারণে এখানে বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র–শিক্ষকদের যাতায়াত বেশি ছিল। পাঠাগারের সময়সূচি ছিল বিকেল বেলা। সন্ধ্যা অবধি খোলা থাকত।
লালদিঘির দক্ষিণ পাড়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের একেবারে লাগোয়া আরেকটি লাইব্রেরি ছিল। এটি শহর চট্টগ্রামের প্রাচীনতম পাবলিক লাইব্রেরি। এর তত্ত্বাবধান করে সিটি কর্পোারেশন। তাই এটি আমাদের কাছে সিটি কর্পোারেশন পাঠাগার নামে পরিচিত ছিল। ১৯০৪ সালে পাবলিক লাইব্রেরি নামে চট্টগ্রাম পৌরসভার প্রথম ভবন আন্দরকিল্লায় গ্রন্থাগারটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯২৩ সালে গ্রন্থাগারটি বর্তমান স্থান লালদিঘির দক্ষিণ পাড়ে স্থানান্তর করা হয়। শহর চট্টগ্রাম বললাম চট্টগ্রামে এর চাইতেও প্রাচীন পাঠাগার আছে। এসবের অবস্থান যদিও গ্রামীণ জনপদে। যেমন একটি হলো কানুনগোপাড়া বান্ধব পাঠাগার। এটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯০২ সালে। বৃটিশ বিরোধী আন্দোলনের সঙ্গে এ পাঠাগারের সংস্পৃক্ততা ছিল। বৃটিশশাসিত একটি ছোট্ট অজপাড়া গাঁয়ে প্রতিষ্ঠিত এ অভূতপূর্ব পরিকল্পনা বাস্তবায়নে যে মহৎ ব্যক্তিরা নিঃস্বার্থভাবে জমিদান করেছিলেন, তাঁরা হলেন–নিশি দত্ত, কিমোরীমোহন দত্ত, শশী কুমার দত্ত, বঙ্গ দত্ত, কাশীমোহন দত্ত, দেবেন্দ্রলাল দত্ত, অটল বিহারী দত্ত, ফণীন্দ্রলাল দত্ত প্রমুখ। পাঠাগারের হল ঘরটি নির্মাণ করা হয় ১৯৪৫ সালে। এ প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সমাজতাত্ত্বিক ডক্টর অনুপম সেন লিখেছেন, ‘এই পাঠাগারটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, রত্নগর্ভার জ্যেষ্ঠপুত্র স্যার আশুতোষের প্রিয় ছাত্র রেবতী রমণ ও তাঁর সঙ্গীরা। স্থানীয় দত্ত পরিবারের সদস্যরা পাঠাগারের জন্য জমিদান করেন। পরবর্তী পর্যায়ে পাঠাগারের সাথে সম্পৃক্ত হন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্কশাস্রের প্রসিদ্ধ অধ্যাপক ডক্টর বিভূতিভূষণ দত্ত, ভারতের প্রসিদ্ধ ইতিহাসবিদ ডক্টর কালিকা রঞ্জন কানুনগো, সুবিমল দত্ত (ভারতের নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর) এবং বিনোদবিহারী দত্ত জ্ঞানতাপস। এরাঁ প্রত্যেকেই ছিলেন উনবিংশ শতাব্দীর রেনেসাঁস চেতনায় উদ্বুদ্ধ।’
যাই হোক, সিটি কর্পোারেশন পাঠাগারের প্রতিষ্ঠাকালীন নাম ছিল পাবলিক লাইব্রেরি। এটির প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন বিপিন চন্দ্র গুহ। ত্রিপুরা চরণ চৌধুরী নামে একজন পাঠাগারপ্রেমিক কলকাতায় প্রবাসী ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠিত চট্টল প্রসূন লাইব্রেরির সমস্ত বই এবং আসবাবপত্র এখানে এনে পাঠাগারটিকে সমৃদ্ধ করেছিলেন। কবি শশাঙ্ক মোহন সেন নিজস্ব সংগ্রহশালা থেকে এখানে অনেক বই এবং সাময়িকী দান করেছিলেন। ১৯২৭ সালে তৎকালীন মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নূর আহম্মদ, ভাইস চেয়ারম্যান যোগেন্দ্র চন্দ্র গুহ এবং ত্রিপুরা চরণ চৌধুরীর উদ্যোগে এই লাইব্রেরিটা মিউনিসিপ্যালিটির অন্তর্ভূক্ত হয়। এখানে প্রায় অর্ধ লক্ষের বেশি বই, সাময়িকী আছে। আমরা মাঝে–মাঝে এখানেও ঢুকতাম। বেশি সময় থাকতাম না। তখন এখানকার ব্যবস্থাপনাটা কেমন জানি ভুতুরে ভুতুরে মনে হতো। এখানে অনেক প্রাচীন দুষ্প্রাপ্য বই এবং সাময়িকী আছে। এখানে বাংলা–ইংরেজি সাহিত্যের কয়েক শত বছরের পুরনো বই, কলকাতা থেকে প্রকাশিত গ্যাজেট, সাময়িকী, পত্র–পত্রিকা, প্যাটেন্টসহ ব্রিটিশ আমলের বিভিন্ন দলিল ছিল। উইলিয়াম শেক্সপিয়রের বিখ্যাত ট্রাজেডি ‘রোমিও অ্যান্ড জুলিয়েট’ প্রকাশিত হয়েছিল ১৫৯৪ সালে, কারো কারো মতে ১৫৯৭ সালে। ১৭৬০ সালে চিত্রকর্মসহ এর সংস্করণ বের হয়। এ ধরনের একটি প্রাচীন সংস্করণ এই চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পাবলিক লাইব্রেরিতে ছিল। এছাড়াও গ্রন্থাগারটিতে সাড়ে তিনশত বছরের পুরানো দুইটি বইয়ের পাশাপাশি, শত বছরের পুরনো তিনশতের অধিক বই ছিল। প্রাচীন এসব সংগ্রহের টানে লাইব্রেরিতে ছুটে আসতেন পাঠক এবং গবেষক। ওই অমূল্য সম্পদ দর্শনের প্রত্যাশায় আমরাও ওমুখো হতাম বারে বারে। পাঠাগারটি ওসব যক্ষের ধনের মতো আগলে রেখেছিল। ২০১৭ সালে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পাবলিক লাইব্রেরির শতবর্ষী ও ঐতিহাসিক পুরনো তিনতলা ভবনটি ভেঙে ফেলা হয়। ২০২০ সালে গ্রন্থাগারটি একুশের প্রথম কবিতার কবি মাহবুব উল আলম চৌধুরীর স্মরণে ‘মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পাবলিক লাইব্রেরি’ নামকরণ করে নতুনভাবে পথচলা শুরু করে। নবযাত্রা শুরুর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে খ্যাতিম্যান সমাজবিজ্ঞানী প্রফেসর ড. অনুপম সেন সিটি কর্পোরেশন পাবলিক লাইব্রেরিটিকে প্রাচীনতম গ্রন্থাগার আলজেরিয়ার মত উল্লেখ করেছিলেন।
‘মাহবুব উল আলম চৌধুরী চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন পাবলিক লাইব্রেরি’র মত এমন করে আগলে রেখেছে অনেক দুষ্প্রাপ্য বই ও সাময়িকী শহর চট্টগ্রামে আরেকটি গ্রন্থাগার। এর নাম চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার। মুসলিম হলের লাগোয়া এই গ্রন্থাগারটি আমাদের অনেকের কাছে পাবলিক লাইব্রেরি নামে পরিচিত। ‘চট্টগ্রাম মুসলিম ইনস্টিটিউট ১৯৫৯’ অধ্যাদেশ বলে ১৯৬৩ সালে চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণগ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৮৯ সালে এটি নতুন করে বহুতল ভবন হবার পর আবার জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করা হয়। এ সময়ে এক বিশাল বই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ঢাকার অনেক প্রকাশক তাদের প্রকাশিত বই নিয়ে মেলায় হাজির হয়। তখন এর নামকরণ হয় চট্টগ্রাম বিভাগীয় সরকারি গণগ্রন্থাগার।
কোর্ট বিল্ডিং এর উল্টোপাশে রঙ্গম সিনেমা হলের পাশে একটি পাঠাগার ছিল। নাম ছিল আবদুর রহমান স্মৃতি পাঠাগার। এর আগে অন্য প্রসঙ্গে লম্বা–চওড়া বিশাল দেহী চুরুট মুখে জহিরুল ইসলাম ছুট্টু নামের যে লোকটির কথা বলেছি যথাসম্ভব তাঁরই পিতৃ–পুরুষের নামে প্রতিষ্ঠিত হবে এটি। তাঁকে যে পত্র–পত্রিকা নির্বিচারে সংগ্রহ করতে দেখেছি, তিনি খুব সম্ভব এসব আবদুর রহমান স্মৃতি পাঠাগারের জন্য করতেন। আবদুর রহমান স্মৃতি পাঠাগার তেমন পরিচিত ছিল না। তবু এটি একটি উল্লেখযোগ্য পাঠাগার। মনে আছে, সাহিত্যিক–সাংবাদিক রাশেদ রউফ পরিচালিত স্বকাল’র এক বা একাধিক সাহিত্যবাসর উপলক্ষে এখানে গিয়েছিলাম। এসব গ্রন্থাগারে ছাত্রাবস্থায় আমরা এসে নিজেকে জ্ঞানের আলোয় আবিষ্কার করি। পাঠাগার মানুষের মননে জ্ঞানের আলো ছড়ায়। এছাড়াও আমার স্মৃতির শহর চট্টগ্রামে আরও অনেক পাঠাগার ছিল। এর কোনো কোনোটি আজও আছে। কোনোটি নেই।
তথ্যসূত্র : হাজার বছরের চট্টগ্রাম, দৈনিক আজাদী, ৩৫ বর্ষপূর্তি বিশেষ সংখ্যা, বোধন শতবার্ষিকী অভিজ্ঞান, সম্পাদক সরোজ কুমার বল, প্রকাশক বান্ধব পাঠাগার, চট্টগ্রাম।
লেখক : প্রাবন্ধিক, কথাসাহিত্যিক, নাট্যকার।