একটা সময় ছিল যখন চট্টগ্রাম ছিল খেলোয়াড় তৈরির উর্বর ভূমি। সেই ৭০, ৮০, ৯০ কিংবা দুই হাজারের দিকেও চট্টগ্রামের ক্রীড়াবিদরা রাজত্ব করেছে সারা দেশে। তখন একটা ট্রায়ালের জন্য ডাকা হলে ফুটবল কিংবা ক্রিকেটে শত শত খেলোয়াড় এসে হাজির হতো। দল গঠন করতে কঠিন পরীক্ষায় পড়তে হতো নির্বাচকদের। কাকে রেখে কাকে নেবেন? শুধু তাই নয় দেশের অন্যান্য জেলা বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের জেলা গুলোকে খেলোয়াড় ধার দিতো চট্টগ্রাম জেলা। কত বড় বড় নাম। আকরাম, নান্নু, নোবেল, শহীদ, আজম, নাফিজ, আফতাব, নাজিম, তামিম আরো কত কি। তেমনি ফুটবলে সেই আশীষ ভদ্র, টিপু, সুনীল, এফ আই কামাল, ফরহাদ, কায়সার, আসকর বাবু, আসাদ, আনোয়ার, জাহেদ পারভেজ, আরমান আজিজ এবং সবশেষ মামুনুল। এরা যে কেবলই জাতীয় দলের জার্সি গায়ে খেলেছে তা কিন্তু না। দাপটের সাথে খেলেছে। এদের অনেকেই অধিনায়কত্ব করেছে। কিন্তু ২০০০ সালের পর থেকে চট্টগ্রাম থেকে খেলোয়াড় সৃষ্টির রাস্তাটা অনেকটাই বন্ধ হয়ে যায়। এরপর সময় যতই গড়িয়েছে ততই যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে জাতীয় দলের জন্য চট্টগ্রামের খেলোয়াড়দের দরজা। দেশের অপরাপর জেলা গুলো যেখানে এগিয়ে যাচ্ছে সেখানে দেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ জেলা চট্টগ্রাম ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে। এখন আমরা সেই ‘এখানে এক নদী ছিল জানলনাতো কেউ’ গানের মত কেবলই স্মৃতি রোমন্থন করে বেড়াই। আমাদের আকরাম ছিল, আশিষ ছিল, নান্নু ছিল সে সব বলে যেন রূপকথা শুনাই। আর আপসোস করি। কেন পাচ্ছি না মান সম্মত খেলোয়াড়। নানা কথা বলি। কিন্তু কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নিতে পারি না। যার কারণে ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে চট্টগ্রাম।
একটা সময় চট্টগ্রামের খেলাধুলার প্রাণকেন্দ্র এম এ আজিজ স্টেডিয়াম জরাজীর্ণ ছিল। ঠিকমত বসার জায়গা ছিল না। কিন্তু খেলোয়াড়ে ভরপুর ছিল। মাঠে মান সম্মত খেলা ছিল। কালের বিবর্তনে এখন এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে চোখ ধাঁধানো দালান হয়েছে। চকচকে তকতকে অফিস হয়েছে। শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ হয়েছে। কোট টাই পরা কর্মকর্তা হয়েছে। কিন্তু আসলটা হারিয়ে গেছে। এখন খেলা হচ্ছে নামে। কিন্তু কাজে আসছেনা কিছুই। বেরিয়ে আসছেনা কোন খেলোয়াড়। এখন কর্মকর্তা বেসে রাজনীতিবিদ এসেছে, কালো টাকার মালিক এসেছে। কিন্তু ক্রীড়া সংগঠকরা হারিয়ে গেছে। যারা এসেছে তাদের কাছে খেলা আয়োজনের চাইতে নিজের ভিজিটিং কার্ডে একটা পদবী বেশি যোগ করতে পারাটাই লক্ষ্য। আর তাতেই পিছিয়ে যাচ্ছে ক্রীড়াঙ্গনে চট্টগ্রাম।
যখনকার সময়কে বলা হয়ে থাকে চট্টগ্রামের খেলাধুলার স্বর্ণযুগ সে সময় আউটার স্টেডিয়ামের খোলা মাঠে খেলে আকরাম নান্নুরা দেশ সেরা হয়েছে। জাম্বুরি মাঠে সকাল বিকাল অনুশীলন করে খেলোয়াড় হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে অনেকেই। প্যারেড মাঠ, কিংবা এখনকার শিশু পার্ক বা রেডিসনের জায়গায় অপেক্ষায় থাকতো অনেকেই অনুশীলন করার জন্য। রেলওয়ে পলোগ্রাউন্ড কিংবা সেন্ট প্লাসিডস স্কুল মাঠেও সে এলাকার খেলোয়াড়রা অনুশীলন করে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করেছে খেলা অঙ্গনে। এখন সে সব মাঠ আর নেই। হারিয়ে গেছে। যেটুকু আছে সেগুলো এখন খেলার চাইতে মেলা বা খেলা বহির্ভূত আয়োজন হয় বেশি। তখন একজনের ব্যাট দিয়ে খেলেছে অনেকেই। একজনের বুট ধার করে খেলতো একাধিক ফুটবলার। ড্রেসিং রুম কী জিনিস দেখেনি। এখন শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ড্রেসিং রুম হয়েছে। ব্যাট, গ্লাভস, বুট আর বাহারি জার্সি হয়েছে। কিন্তু হারিয়ে গেছে খেলা।
সে সময় ক্লাব চালাতো ক্রীড়া সংগঠকরা। সবাই মিলে এক হয়ে। আর এখন ক্লাব চলে গেছে ব্যক্তির পকেটে। তিনিই সর্বেসর্বা। এখন আর আমাদের ক্লাব নেই। এখন হয়েছে আমার ক্লাব। তাই এখন আর সবাই মিলে দল করে না। ক্লাবের মালিক একজনকে দায়িত্ব দিয়ে দেন। যাকে চট্টগ্রামের ক্রীড়াঙ্গনের ভাষায় বলা হয় কন্ট্রাক্টর। সে কন্ট্রাক্টর কী করছেন সে খবর আর নেই। ফলে যা হবার তাই হচ্ছে। যিনি কন্ট্রাক্টর তিনি তো ব্যবসা করবেনই। আর সে ব্যবসায়ীর খপ্পরে পড়ে শেষ চট্টগ্রামের খেলাধুলা। এখন ফুটবল, ক্রিকেট আর হকির মত ইভেন্টের জাতীয় দলে নেই চট্টগ্রামের কোনো প্রতিনিধিত্ব। অথচ একসময় এই চট্টগ্রামের খেলোয়াড়রাই মাঠ মাতিয়েছে। কিন্তু কালের পরিক্রমায় সব যেন হারিয়ে নিঃস্ব হতে বসেছে চট্টগ্রাম।
এ প্রসঙ্গে সাবেক কৃতী ফুটবলার এবং ক্রীড়া সাংবাদিক দেবাশীষ বড়ুয়া দেবু জানান একসময় ঢাকার মাঠ মাতিয়ে রাখতো চট্টগ্রামের ফুটবলাররা। আশির দশকে চট্টগ্রামের প্রায় ৩০০ জন ফুটবলার ঢাকার শীর্ষ লিগে খেলতেন। তখন উপজেলা পর্যায় থেকে প্রচুর খেলোয়াড় চট্টগ্রামের লিগে খেলতে আসতেন। বিভিন্ন লিগ,টুর্নামেন্ট নিয়মিত হতো। মাঠও ছিল প্রচুর এবং মেলামুক্ত। সেখানে অবলীলায় প্র্যাকটিস করতেন ফুটবলাররা। তিনি উল্লেখ করে বলেন, বড় তিনটি মাঠ প্যারেড,জাম্বুরি এবং পলোগ্রাউন্ডে প্রচুর ফুটবলার অনুশীলন করার সুযোগ পেতেন। স্কুল ফুটবলের আয়োজনও নিয়মিত ছিল। মোট কথা চট্টগ্রামের প্রচুর খেলোয়াড় ফুটবলে মনোযোগী ছিলেন। এরফলে চট্টগ্রামের ফুটবল মানও ছিল বেশ উন্নত। তখন জাতীয় দলের পক্ষেও প্রতিনিধিত্ব করেছেন চট্টগ্রামের অনেক খেলোয়াড়। এখন পর্যন্ত চট্টগ্রামের দুই কৃতী ফুটবলার আশীষ ভদ্র এবং মামুনুল ইসলাম মামুন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের অধিনায়কত্ব করে চট্টগ্রামকে গর্বিত করেছেন। আশির দশকের পর আস্তে আস্তে চট্টগ্রামের ফুটবলে ভাটা পড়তে থাকে। মাঠের সংখ্যা ক্রমশ কমতে থাকে।
স্বাধীনতার পর চট্টগ্রাম ক্রিকেট ভালো সংগঠকের হাতে পড়েছিল। চট্টগ্রামের ক্রিকেটকে সংগঠিত করার ব্যাপারে বিশেষ ভূমিকা রাখেন মরহুম শাহেদ আজগর চৌধুরী এবং রাশেদ আজগর চৌধুরী ভ্রাতৃদ্বয়। ১৯৭৬ সালে এমসিসি ক্রিকেট দল চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে দু’দিনব্যাপী প্রদর্শনী ক্রিকেটে অংশ নেয়। এরপর থেকে আস্তে আস্তে ক্রিকেট প্রসার লাভ করতে থাকে চট্টগ্রামে। ১৯৮০ সালে চট্টগ্রামে আজগর ভাইদের নেতৃত্বে শুরু হয় স্টার সামার ক্রিকেট এবং ১৯৮১ সালে স্টার যুব ক্রিকেট টুর্নামেন্ট। তাঁদের অর্থানুকূল্যে দুটি টুর্নামেন্টই চট্টগ্রামে ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। সিনিয়র এবং জুনিয়র ক্রিকেট খেলোয়াড়দের জন্য আয়োজিত এই দুটি টুর্নামেন্টই চট্টগ্রামে ক্রিকেট প্রসারে বিশাল ভূমিকা রাখে। স্টার সামার ক্রিকেটে চট্টগ্রামের বাইরে ঢাকার ক্লাবগুলো এবং কলকাতা থেকেও ইস্টবেঙ্গল,মোহনবাগানের মত দল অংশ নিয়েছে। আজকের ভারত বিখ্যাত ক্রিকেটার সৌরভ গাঙ্গুলিও তাঁর কৈশোরে তিনি যখন ১০ম শ্রেনীর ছাত্র তখন চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামে খেলে গেছেন ইস্টবেঙ্গলের হয়ে। স্টার যুব ক্রিকেট টুর্নামেন্ট চট্টগ্রামে অনেক কৃতী ক্রিকেটারের জন্ম দিয়েছে। এরপর পরই চট্টগ্রাম জেলা দল জাতীয় যুব ক্রিকেটে একচেটিয়া রাজত্ব করেছিল। টানা সাতবার চ্যাম্পিয়নও হয়েছিল চট্টগ্রাম জেলা যুব ক্রিকেট দল। বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন নান্নু এবং ক্রিকেট বোর্ড পরিচালক আকরাম খানের ক্রিকেটার হিসেবে উত্থান কাছাকাছি সময় থেকেই। এর আগে চট্টগ্রামে বসবাস করা শফিকুল হক হীরা বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। নান্নু–আকরামদের সময়কালে চট্টগ্রামের আরো অনেক ক্রিকেটার ঢাকা লিগে নিয়মিত পারফর্ম করতেন। এদের অনেকেই আস্তে আস্তে জাতীয় দলেও স্থান করে নিতে সক্ষম হন। চট্টগ্রাম ক্রিকেটের রমরমা সময় তখন। ১৯৮৭ সালে আকরাম খানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ আইসিসি ট্রফি জয়ের পর চট্টগ্রাম ক্রিকেটে নতুন করে প্রাণের সঞ্চার হয়। ২০০৫ সালে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট বিজয়টি আসে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এই চট্টগ্রাম স্টেডিয়াম থেকেই। তবে এই সময় পুরো দেশেই ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা আর প্রসারের ফলে অন্যান্য জেলাগুলোও ক্রিকেটে এগিয়ে যেতে থাকে। চট্টগ্রাম তাই আগের মতো একচেটিয়া প্রাধান্য বিস্তার করতে পারছে না এখন। বর্তমান সময়ে দেশে সর্বোচ্চ জনপ্রিয়তায় থাকা ক্রিকেট চট্টগ্রামে স্থানীয়ভাবে যেন থমকে আছে।
চট্টগ্রামের ক্রিকেট নিয়ে বিশিষ্ট ক্রীড়া সাংবাদিক এ কে এম সাইফুল্লাহ চৌধুরী বলেন, চট্টগ্রাম বাংলাদেশ ক্রিকেটের উর্বর ভূমি। কারণ স্বাধীনতার পর ঢাকার বাইরে চট্টগ্রামেই বয়স ভিত্তিক ক্রিকেটের প্রথম নার্সিং হয়। ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক ফ্লেভারও দিয়েছে চট্টগ্রাম স্টার সামার ক্রিকেটের মাধ্যমে। চট্টগ্রাম ক্রিকেটের উন্নয়নে এটা ছিল প্রথম সোপান। খেলাও হতো বেশ প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক। এই টুর্নামেন্টের বাইরেও বিভিন্ন নামে আরো বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের আয়োজন ছিল। তাতে করে এখানকার খেলোয়াড়রা বেশি খেলার সুযোগ পেত। এসময় যুব ক্রিকেটে চট্টগ্রাম ছিল বাংলাদেশের নামকরা একটি দল। সাত সাতবার চ্যাম্পিয়ন হয়েছে চট্টগ্রাম জেলা। নির্মান স্কুল ক্রিকেটও তখন ভূমিকা রেখেছিল ক্রিকেট উন্নয়নে। সিনিয়র ক্রিকেটেও চট্টগ্রাম জাতীয়ভাবে চারবার চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গৌরব অর্জন করে। জাতীয় দলে একসময় চট্টগ্রামের সাতজন ক্রিকেটারও খেলেছে। নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেট সংগঠকের কারণে চট্টগ্রাম এ সময় এগিয়ে থাকার সুযোগ লাভ করে। ২০০০ সালে বাংলাদেশ টেস্ট মর্যাদা পাওয়ার পর পরিস্থিতি পাল্টে যেতে থাকে। জাতীয় ক্রিকেটে চট্টগ্রামের ভূমিকা ক্রমশ মলিন হতে থাকে। বাংলাদেশে ক্রিকেটের জনপ্রিয়তা বেড়ে যাওয়ায় চট্টগ্রামের বাইরের জেলাগুলোতে ক্রিকেট চর্চা বাড়তে থাকে। এদিকে চট্টগ্রাম যায় পিছিয়ে। কারণ আগেকার নিবেদিতপ্রাণ ক্রিকেট সংগঠকরা সরে যেতে থাকেন। ক্রিকেট বোর্ডের প্রচুর টাকার হাতছানি এবং ক্রিকেটে রাজনৈতিক প্রভাব বাড়তে থাকায় ঐ সংগঠকরা পিছিয়ে যান। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বরা ক্রিকেটের পদগুলো দখল করতে থাকেন। ক্রিকেট বোর্ডের মাধ্যমে কোচের দায়িত্ব পাচ্ছেন তারা যারা ক্রিকেটকে আসলেই কিছু দিতে পারছেন না। এভাবেই চট্টগ্রাম ক্রিকেটের পতন শুরু হতে থাকে।
ফুটবল, ক্রিকেটের বাইরে এ্যাথলেটিক্স, দাবা, হকি,ব্যাডমিন্টন,ভলিবল,বাস্কেটবল,টেবিল টেনিস, সাঁতার, হ্যান্ডবল, কাবাডি ইত্যাদিরও চর্চা হয় চট্টগ্রামে। আগে বার্ষিক ক্রীড়া সূচি না থাকলেও বর্তমানে এসব খেলাধুলার বর্ষপঞ্জি ছক অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তাতে করে একটা ধারাবাহিকতা বজায় থাকছে। স্বাধীনতার পর পর এসব খেলাধুলার কোন কোনটির উজ্জ্বল ভূমিকা থাকলেও বর্তমানে অনেক খেলার খুব বেশি উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। অ্যাথলেটিক্সে একসময় চট্টগ্রামের বেশ নামডাক থাকলেও বর্তমানে তা অনেক মলিন হয়ে গেছে। বছরব্যাপী অ্যাথলেটিক্স চর্চার সুযোগ সুবিধা এখানে নেই। নেই কোন অ্যাস্টোটার্ফের ব্যবস্থা যেখানে অ্যাথলেটদের প্রশিক্ষণ চলবে। সবচেয়ে বড় কথা আগের সময়কার নিবেদিতপ্রাণ সংগঠক নেই। অথচ চট্টগ্রামের অফিস দলগুলোও একসময় এ্যাথলেটদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতো। এখন তাদের ভূমিকাও মিয়ম্রাণ।
দাবাতে চট্টগ্রামের কিশোর তরুণরা স্বাধীনতার পরপর না হলেও পরবর্তীতে বেশ ভালো ফলাফল করেছে। চট্টগ্রামের ইয়াসমিন বেগম এবং তনিমা পারভিন জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সুনামের সাথে দেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তবে এনাদের পরে আর কেউ তেমন উঠে আসেনি। অপ্রতুল সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এখনকার দাবাড়ুরা নিজেদের চর্চার উপর ভরসা করে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। বর্তমানে বাংলাদেশ দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন চট্টগ্রামের ক্রীড়া সংগঠক সৈয়দ শাহবুদ্দিন শামীম। এটি চট্টগ্রামের দাবাঙ্গনের জন্য সুখকর বিষয়।
ব্যাডমিন্টন চট্টগ্রামে জনপ্রিয় খেলা হলেও এ খেলায় চট্টগ্রামের ধারাবাহিকতা নেই। কখনো ভালো কখনো মন্দ এইভাবে চলছে এখানকার ব্যাডমিন্টনের যাত্রা। সারা বছরে একটি লিগ অনুষ্ঠান, আবার সে লিগে বিভিন্ন ক্লাবের হয়ে চট্টগ্রামের বাইরের খেলোয়াড়দের খেলে যাওয়া চট্টগ্রামের ব্যাডমিন্টন উন্নতিতে ভূমিকা রাখছে না। সম্প্রতি চট্টগ্রামের ছেলে এস এস এম সিফাতউল্লাহ গালিব বাংলাদেশের হয়ে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক ইভেন্টে কৃতিত্বপূর্ণ ফলাফল করে চট্টগ্রামের মুখকে উজ্জ্বল করেছেন।
অন্যান্য খেলাগুলো চট্টগ্রামে নিয়মিত অনুষ্ঠিত হচ্ছে। স্বাধীনতার পরের অবস্থা থেকে বর্তমানে হয়তো কিছুটা ভালো হয়েছে এসব খেলাধুলা চর্চা। তারপরও প্রয়োজনীয় সুযোগ সুবিধা এসব খেলাধুলাকে একটা নির্দ্দিষ্ট গন্ডিতে আবদ্ধ করে ফেলেছে। একটা লিগ নির্ভর এসব খেলাধুলা খুব বেশি এগিয়ে যেতে পারছে না। তা জাতীয় পর্যায়ের খেলাধুলায় অংশ নিতে গেলেই বোঝা যায়। একটা দুটো ম্যাচ জেতার পর তাদের আর খুঁজে পাওয়া যায় না। আবার লিগে সফলতা পাওয়ার জন্য বিভিন্ন ক্লাব ভাড়া করা বাইরের খেলোয়াড় এনে চট্টগ্রামের পক্ষে খেলিয়ে দেয়। এটা চট্টগ্রামের খেলোয়াড় তৈরিতে বড় বাধা। চট্টগ্রামের খেলোয়াড়রা সুযোগ না পাওয়াতে এসব খেলায় চট্টগ্রামের খুব বেশি উন্নতি হয় না।
বর্তমানে বেশ কিছু নতুন খেলা চট্টগ্রাম ক্রীড়াঙ্গনে সংযুক্ত হয়েছে। জুডো কারাতে খেলার প্রচলন আগে থাকলেও এর সাথে যুক্ত হয়েছে উশু, তায়কোয়ানডোর মত ইভেন্ট। এসব খেলা স্বাধীনতার পর পর শুরু না হলেও বর্তমানে তা অনুষ্ঠিত হচ্ছে বেশ আড়ম্বরে। এর মধ্যে আরো আছে খো খো, চুকবল, সেপাকটাকরো, ক্যারম, রাগবি, আরচ্যারী প্রভৃতি। এই অপ্রচলিত খেলাধুলার কিছু কিছুতে চট্টগ্রাম জাতীয় পর্যায়ে ভালো করছে। চট্টগ্রামে এসব খেলার নিয়মিত চর্চা এবং সুযোগ সুবিধার উপর নির্ভর করছে তারা কতটুকু এগিয়ে যাবে।
চট্টগ্রামে মেয়েদের ক্রীড়ার কথা এলেও তাতে হতাশ হতে হবে। কিছু কিছু ইভেন্টে মেয়েরা অংশ নিচ্ছে তাদের ব্যক্তিগত আগ্রহের কারণে। যেমন দাবা, জুডো, কারাতে ইত্যাদি। বিচিছন্নভাবে দেখা যায় কিছু মেয়ে ব্যাডমিন্টন বা ভলিবল খেলছে। স্বাধীনতার পর মেয়েদের এ্যাথলেটিক্সে দেখা গেলেও এখন তাদের সংখ্যা হাতে গোনা। রক্ষণশীল চট্টগ্রামে এখন কিন্তু অনেক বাবা মাই চান মেয়েদের খেলাধুলায় পাঠাতে। কিন্তু তাদেরকে যে মাঠে নিয়ে আসবেন এমন সংগঠক নেই বললেই চলে। তার উপর আছে পর্যাপ্ত সুযোগ সুবিধার অভাব। ঢাকায় মেয়েদের ফুটবল ক্রিকেট নিয়ে যে মাতামাতি, চট্টগ্রামে তার কিছুই এখনো দেখা যাচ্ছে না। কিছু ব্যক্তিগত উদ্যোগে মেয়েরা এ খেলায় হয়তো আছে যা উল্লেখ করার মতো নয়। ক্রিকেট, ফুটবলে চট্টগ্রামের মেয়েদের যথেষ্ট সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে না। সব মিলিয়ে খেলাধুলায় চট্টগ্রামের মেয়েদের একালটাকে হতাশার বলতে হবে।
অনেকে মনে করেন চট্টগ্রামের খেলাধুলায় একাল–সেকালে খুব একটা পার্থক্য নেই। আগে প্রাতিষ্ঠানিক কিছু ছিল না। এখন কিছু কিছু করে হচ্ছে। খেলাধুলার জন্য অন্যতম প্রয়োজন নানা রকম স্থাপনা। ১৯৫২ সালে গড়ে উঠা চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামের পর এখানে দীর্ঘদিন আর একটি স্টেডিয়াম হয়নি। যার ফলে এখনো চট্টগ্রাম স্টেডিয়ামকেই সব খেলাধুলার চাপ সইতে হচ্ছে। আগে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট এই স্টেডিয়ামে নিয়মিত হলেও এখন জহুর আহমেদ চৌধুরী স্টেডিয়াম হওয়াতে সেখানেই হচ্ছে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। সম্প্রতি বাকলিয়া স্টেডিয়াম তৈরি হলেও পরিপূর্ণ ব্যবহার করা হচ্ছে না। চট্টগ্রামের জনসংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে স্টেডিয়াম বা মাঠের সংখ্যা এখানে খুব বাড়েনি। আবার আগেকার সময়ে ঘরের সামনে একটু উঠোন বা মাঠ থাকতো। বর্তমানের ফ্ল্যাট কালচার এই ছোট ছোট মাঠের বিলুপ্তি ঘটিয়েছে। ফলে আজকের শিশু কিশোর খেলার জন্য কোন মাঠ পাচ্ছে না।
মেয়েদের জন্য গড়া সাগরিকার মহিলা ক্রীড়া কমপ্লেক্স শহর থেকে দূরে অন্য এক প্রান্তে। সেখানে গিয়ে যে মেয়েরা খেলবে সে সুযোগ নেই। বলা যায় মেয়েরা ব্যবহারই করতে পারছে না তাদের জন্য নির্ধারিত এই স্থাপনাটি। সবেধন নীলমনি সিজেকেএস জিমনেশিয়াম কোন আধুনিক স্থাপনা নয়। পঁচিশ বছরের কাছাকাছি হচ্ছে এটার বয়স। অনেকটা জীর্ণশীর্ণ দশা এর। চট্টগ্রামে শীঘ্রই আধুনিক জিমনেশিয়াম তৈরি সময়ের দাবি হয়ে উঠেছে। এবার চট্টগ্রামের রাইফেল ক্লাবে ভ্যাপসা গরমের মধ্যে অনুষ্ঠিত হয়েছে ৩৯তম জাতীয় টেবিল টেনিস প্রতিযোগিতা। খেলোয়াড়দের প্রচণ্ড কষ্ট করে এই খেলায় অংশ নিতে হয়েছিল। যা ছিল অমানবিক।
চট্টগ্রামের অন্যতম মাঠ আউটার স্টেডিয়াম। এখানে খেলেই চট্টগ্রামের আকরাম–নান্নুর মতো অনেক খেলোয়াড় শীর্ষে উঠে এসেছেন। কিন্তু সেই মাঠটির করুণ অবস্থা চট্টগ্রামবাসীকে আহত করেছে। সম্প্রতি চট্টগ্রাম জেলা প্রশাসন আউটার স্টেডিয়ামকে খেলা উপযোগী করে তোলার বড় উদ্যোগ নিয়েছেন।
গুরুত্বের দিক দিয়ে রাজধানী ঢাকার পরে বন্দরনগরী এবং বাণিজ্যিক রাজধানী বলে খ্যাত চট্টগ্রামের স্থান। কিন্তু খেলাধুলার ক্ষেত্রে সেকালের মতো একালেও চট্টগ্রাম জেলা অনেক পিছিয়ে। যদিও অনেক কিছু যুক্ত হয়েছে তবুও বলতে হবে খেলাধুলার প্রয়োজনীয় এবং আধুনিক সুযোগ সুবিধার অনেক কিছু নেই এখানে। অপ্রতুল সুযোগ সুবিধা এবং দক্ষ নিবেদিতপ্রাণ ক্রীড়ানুরাগী সংগঠক ছাড়া ক্রীড়াক্ষেত্রে চট্টগ্রাম কোনভাবে এগিয়ে যেতে পারবে না। এমন হলে সেকালের মতো চট্টগ্রামের একালটাও খুব বেশি ভালো তা বলা যাবে না।
লেখক : ক্রীড়া প্রতিবেদক, দৈনিক আজাদী