অর্থনৈতিক উন্নয়ন, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে সুপ্রাচীনকাল থেকে চট্টগ্রামের রয়েছে এক উজ্জ্বল ইতিহাস। সমুদ্র বন্দরের কারণে চট্টগ্রামকে বলা হতো Gate way of the east, সুপ্রাচীনকাল থেকেই চট্টগ্রাম ব্যবসা বাণিজ্যের আন্তর্জাতিক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠতে শুরু করে। ব্রিটিশ ভারতে ভৌগোলিক অবকাঠামোগত কারণে চট্টগ্রামে আসাম–বেঙ্গল রেলওয়ের হেডকোয়ার্টার স্থাপন, পাকিস্তান আমলের বৃহৎ শিল্প সমূহ, বহুজাতিক শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, বাঙালি মালিকানাধীন প্রধান ব্যাংক ও বীমার সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থাপিত হয়। তৎকালীন পুর্বপাকিস্তানের আমদানি ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রকের দপ্তর রেজিষ্ট্রার অব জয়েন্ট স্টক কোম্পানির অফিস চট্টগ্রামেই ছিল। ৫০ বা ৬০ দশকে ভারতমুখী আন্তর্জাতিক বিমানগুলো যোগাযোগের জন্য চট্টগ্রাম বিমান বন্দর ব্যবহার করতো। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চট্টগ্রাম দেশের বৃহত্তম প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর। আমদানি ও রপ্তানি এবং সংখ্যাগরিষ্ট শিল্পায়ন সংশ্লিষ্ট কার্যক্রমের ফলে অধিকাংশ রাজস্ব আদায় চট্টগ্রামের মাধ্যমে হয়ে থাকে। খ্রিষ্ঠপূর্ব ৪র্থ অব্দে চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে বিদেশী পর্যটকদের আগমন, বাণিজ্য এবং যোগাযোগ স্থাপিত হয়ে আসছে। বর্তমান আধুনিক বাণিজ্য ব্যবস্থার সময়েও চট্টগ্রাম সমুদ্র বন্দর দেশের প্রধান প্রাকৃতিক সমুদ্র বন্দর।
আমরা জানি চট্টগ্রাম, বন্দর নগরী, চট্টগ্রাম বাণিজ্য নগরী, চট্টগ্রাম শিল্প নগরী এবং চট্টগ্রাম বাংলাদেশে সিংহদ্বার হিসেবে বিবেচিত। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা এই যে অপরিকল্পিত উন্নয়নের কারণে চট্টগ্রাম তার আসল সৌন্দর্য হারিয়ে শ্রীহীন অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। শিল্পনগরী বা বাণিজ্য নগরী বা বন্দর নগরী যে নামে ও অলংকারে ভূষিত হোক না কেন প্রতিটি সরকার চট্টগ্রামকে উপেক্ষার দৃষ্টিতে দেখেছে। আমলাতান্ত্রিক ষড়যন্ত্রের কারণে চট্টগ্রাম হয়েছে তার ন্যায্য অধিকার হতে বঞ্চিত। ভৌগোলিক অবস্থান ও বন্দর সুবিধার কারণে চট্টগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠলেও ষড়যন্ত্রের কবলে পড়ে দিনে দিনে শিল্পগুলো হয়েছে রুগ্ন। চট্টগ্রামে শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহে গ্যাস সংযোগ দিতে সব সময়ে আমলাদের অনীহা লক্ষ্যণীয়। ঢাকায় শুধু গাজীপুরে যে পরিমাণ গ্যাসের ব্যবহার হয় চট্টগ্রামের কেজিডিসিএল এ তার অর্ধেক পরিমাণ গ্যাসের সরবরাহ করতে তাদের অনীহা বা ষড়যন্ত্র লক্ষ্যণীয়। এভাবে ক্রমান্বয়ে আমলারা এবং বিভিন্ন সরকারের শাসনকালে চট্টগ্রামকে এক প্রকার শ্রীহীন করে রেখেছে। তবুও আমরা চট্টগ্রামের উন্নয়নের জন্য চট্টগ্রামের ন্যায্য স্বার্থের জন্য প্রতিনিয়ত লিখেই চলেছি।
এ কথা সত্যি যে, ঐতিহ্যগতভাবে চট্টগ্রাম ভূ–প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যে পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর নগরী। এই নগরীকে আন্তর্জাতিক মানে উন্নীত করার অনেক অবারিত সম্ভাবনা রয়েছে। জাতীয় অর্থনীতির ৮০ শতাংশের বেশি আয় চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে অর্জিত হয়। এ কারণেই চট্টগ্রামকে বলা হয় জাতীয় অর্থনীতির হৃৎপিণ্ড। আমদানি–রপ্তানির ক্ষেত্রেও ৮০ শতাংশ কার্যক্রম পরিচালিত হয় চট্টগ্রাম থেকেই। এই চট্টগ্রাম থেকে সরকার টেক্স নিয়ে যাচ্ছে। দেশের উন্নয়নের স্বার্থে চট্টগ্রাম বন্দরের অগ্রগতি জরুরি। বিশেষজ্ঞরা বলেন, বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দর দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ব্যস্ততম সমুদ্র বন্দর। সমৃদ্ধির স্বর্ণদ্বার চট্টগ্রাম বন্দরকে বলা হয় বাংলাদেশের প্রবেশদ্বার।
প্রতিবছর এর উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এবং রাজস্ব প্রবৃদ্ধি দেশের বার্ষিক জিডিপিকে সমৃদ্ধ করে থাকে। এ বন্দর আজ দেশের অর্থনীতির প্রাণভোমরা। দক্ষিণ এশিয়ায় সমমানের বন্দর সমূহের তুলনায় চট্টগ্রাম বন্দরে কর্মরত কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বেতনভাতা ও অন্যান্য সুবিধাদি নিত্যন্তই অপ্রতুল। বন্দর কর্মীদের মজুরী আন্তর্জাতিক মানের হওয়া উচিত ছিলো। সার্বক্ষণিক ঝুঁকি নিয়ে তাদের কর্মস্থলে নিয়োজিত থাকতে হয় কিন্তু নেই কোন ঝুঁকিভাতা। পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যে জানা যায়, নিজেদের সক্ষমতা বাড়াতে, নতুন ধরনের পণ্য খালাসের সুবিধা প্রদান করতে আর পণ্য ওঠানামার সময় কমিয়ে সেবার দক্ষতা বৃদ্ধি করতে তিলে তিলে নতুন মাত্রায় গড়ে উঠেছে চট্টগ্রাম বন্দর। আজকের বন্দর বিগত দিনের চেয়ে আরও বেশি কর্মক্ষম এবং আগামীর বন্দর হতে যাচ্ছে আরও আকর্ষণীয়, আরও সমৃদ্ধ এবং আরও বেশি কার্যকর। কনটেইনার ওঠানামায় নতুন রেকর্ড গড়েছে চট্টগ্রাম বন্দর। যেহেতু চট্টগ্রাম বন্দর বাংলাদেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্বও এর সঙ্গে জড়িত। তাই বন্দর নিয়ে এবং বন্দরের সমৃদ্ধি নিয়ে আমাদের ভাবতে হবে। একে শক্তিশালী করতে হবে। তবে তা যেন ভেবেচিন্তে দেশের স্বার্থে করি। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টার স্বাভাবিক বাচন ভঙ্গী ও আকর্ষণীয় ভাষা প্রয়োগে আমরা চট্টগ্রামবাসী চমকিত ও আনন্দিত এবং উৎসাহিত। কিন্তু আবার শংকিতও। ইতিমধ্যে দেশের বন্দর ব্যবহারকারি ও বন্দর সংশ্লিষ্ট স্টক হোল্ডার যারা রয়েছেন তাদের সাথে আলাপে এ শংকাবোধ সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের হৃৎপিণ্ড এ বন্দর পরিচালনার ভার যদি আমরা বিদেশি বেনিয়াদের হাতে তুলে দিই তবে আমাদের হৃৎপিণ্ড স্থানচ্যুত হচ্ছে কিনা? অতীতেও চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে অনেক ষড়যন্ত্র হয়েছে। আবারও আমরা সেই ষড়যন্ত্রের বলি হচ্ছি কিনা? মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা চট্টগ্রামের লোক। চট্টগ্রামের প্রতি তাঁর ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ রয়েছে। তাঁর ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ থেকেই তিনি এ পরিকল্পনা নিয়েছেন এতে কোনো সন্দেহ নেই। তবে আমরা চট্টগ্রামবাসী সিদুঁরে মেঘ দেখলেই ভয় পাই।
অতীতে বাণিজ্যের আড়ালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাতে আমাদের স্বাধীনতা হরণ হতে দেখেছি। এটি তার পুনরাবৃত্তি কিনা? ভেবে দেখতে হবে।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন বক্তৃতায় প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস শিক্ষার্থীদের নতুন বিশ্ব গড়ার স্বপ্ন দেখার আহ্বান জানিয়ে বলেছেন, ‘নতুন বিশ্ব গড়ার সক্ষমতা আমাদের আছে, যেটা আমরা গড়তে চাই। তিনি বলেন, এ পৃথিবীর ভবিষ্যত আমাদের প্রত্যেকের হাতে। আমরা যেভাবে বিশ্বকে গড়তে চাই সেভাবেই বিশ্ব গড়তে পারি। আমি যেভাবে বলেছি সেভাবে গড়তে হবে এমন কোনো কথা নেই। আমি আমার কথাটা বলে যাচ্ছি। অন্যরা তাদেরটা বলবে। কিন্তু নিজের মনের একটা স্বপ্ন থাকতে হবে এটাই আমার আবেদন। অর্থাৎ কী ধরনের বিশ্ব চাই, কী ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চাই, কী ধরনের সমাজ চাই, কী ধরনের দেশ চাই–সবকিছু নিয়ে নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে একটা স্বপ্ন থাকতে হবে। কিন্তু স্বপ্ন না দেখে গর্তের মধ্যে ঢুকে গেলাম, যা আছে মেনে নিলাম, তাহলে কিছুই পাল্টাবে না– কিছুই পরিবর্তন হবে না।’ সুতরাং আমাদেরকে পরিবর্তনের দিকে এগুতো হবে পরিবর্তন নিয়ে ভাবতে হবে।
তাঁর এ সফরকালীন সময়ে তিনি দক্ষিণ–চট্টগ্রামবাসীর প্রত্যাশা বহুল প্রতিক্ষিত কালুরঘাট রেল–কাম সড়ক সেতুর ভিত্তিপ্রস্তুর স্থাপন করেন। যেটি তৈরি হলে চট্টগ্রামবাসীর বহু কষ্টের অবসান হবে। পূর্ববর্তী সরকারের সময়ে এ রেল–কাম সড়ক সেতুর জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন ও কোরিয়ার সাথে চুক্তি এবং বাজেটে অর্থ বরাদ্ধ সবই হয়েছিল কিন্তু কেন জানি এটি আলোর মুখ দেখেনি। এখানেও আমলাতন্ত্রের কারসাজি রয়েছে বলে প্রচারিত। এতদিন পর তবুও এটি আলোর মুখ দেখতে পাচ্ছে। দুর্মুখেরা বলছে, এর খরচ নাকি পদ্মা সেতুর সমান। যতই খরচ হোক না কেন আমরা আমাদের কর্ণফুলী সেতুর আম্ভরিক বাস্তবায়ন চাই।
এসব ছাড়াও অনেক গুচ্ছ প্রকল্পের প্রতিশ্রুতি তিনি চট্টগ্রামবাসীকে দিয়েছেন। কালুরঘাটে ডেন্টাল কলেজ ও হাসপাতাল, হাটহাজারী ও কর্ণফুলীতে দু’টি হাসপাতাল, চট্টগ্রাম হার্ট ফাউন্ডেশনের জন্য জমির দলিল হস্তান্তর সহ ডজন খানেক প্রকল্পের সম্ভাবনা ও বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি দিয়ে চট্টগ্রামের মানুষকে আনন্দের সাগরে ভাসিয়েছেন। কিন্তু প্রশ্ন থেকে যায়। এসব প্রতিশ্রুতি কি সত্যি বাস্তবায়ন হবে নাকি অতীতের ন্যায় তা আমলাদের লাল ফাইলে বন্দী হয়ে স্টোর রুমে আশ্রয় লাভ করবে? তবুও আমরা আশাবাদী, অন্তত পক্ষে এ সময়ে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন সম্ভব। তারপরও নৈরাশ্য আমাদেরকে তাড়িয়ে বেড়ায়। যেমন আগামী তিন মাসের মধ্যে যেসব শিল্প কারখানা উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত সে সব কারখানায় দ্রুততম সময়ে গ্যাস সংযোগ প্রদানের জন্য জ্বালানি উপদেষ্টা মহোদয় নির্দেশনা প্রদান করেছেন। প্রতিশ্রুতি প্রদানের পর প্রায় একমাস চলে গেলেও আমলাদের বা সংশ্লিষ্ট বিভাগের পক্ষ হতে এ বিষয়ে বাস্তব ভিত্তিক কোন কার্যক্রম দৃষ্টিগোচর হয়নি। তবে খুবই জোরে সোড়ে ফাইল নাড়াচাড়া হচ্ছে এটি চোখে পড়ে। এ হলো আমাদের দেশের উন্নয়নের ও প্রতিশ্রুতির একটি বাস্তব চিত্র। আমরা আশাবাদী, আমাদের চট্টগ্রামের লোক প্রফেসর ড. ইউনূস। তাঁর সময়ে চট্টগ্রামের উন্নয়নে আমরা আশাবাদী থাকতে চাই।
লেখক: প্রাবন্ধিক; সম্পাদক, শিল্পশৈলী।