ভারতের কলকাতা থেকে বেড়াতে এসেছিলেন এক সাহিত্যিক বন্ধু। তাকে নিয়ে একদিন আড্ডামুখর চেরাগী পাহাড়ে গিয়েছিলাম। জামালখান ও মোমিন রোডের মোড়ে টিলার ওপর স্থাপনাটির ‘আধুনিকায়ন’ দেখে তিনি হতাশ হয়েছিলেন। বিপ্লবী সূর্যসেন, প্রীতিলতাদের স্মৃতিচিহ্নগুলোকে সংরক্ষণের অব্যবস্থা দেখেও তার মুখ মলিন হয়েছে। রাজধানী ঢাকা এবং কলকাতা থেকেও অনেক প্রাচীন এই চট্টগ্রামের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ইতিহাসের অনেক অনুষঙ্গ। বহু শতাব্দীর স্মৃতি ধরে আছে এই ভূখণ্ড। মোগল, সুলতানী, আরাকানী, ব্রিটিশ আমলসহ নানা সময়ের, নানা যুগের স্মৃতিগুলো আমরা যথাযথভাবে সংরক্ষণ করতে পারিনি।
আমরা হতাশ হই যখন চকবাজার অলি খাঁ মসজিদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাই। এটির আধুনিকায়ন করে আদি আদলটি বদলে ফেলা হয়েছে। হতাশ হই সার্কিট হাউসের পাশে গেলে। ব্রিটিশ আমলের এই নান্দনিক স্থাপনার আশপাশে শিশুপার্কসহ নানা কিছু স্থাপিত হয়েছে। হারিয়ে গেছে সেটির সৌন্দর্য। কোনো প্রাচীন স্থাপনার সান্নিধ্য আমাদের মনে পুরোনো সমাজের সাংস্কৃতিক স্মৃতিকে জাগিয়ে তোলে। যে অঞ্চলে এসব স্থাপিত হয়েছিল, সেই অঞ্চলের জনগোষ্ঠির চাওয়া পাওয়া, আর্থসামাজিক অবস্থা প্রতিফলিত হয়। এগুলো আমাদের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। মানুষের মনে এক ধরনের অনুপ্রেরণা যোগায়। নান্দনিক মূল্যবোধকে সমুন্নত করে। তাই এগুলোর আদি সৌন্দর্যসহ সংরক্ষণ করা জরুরি বলে মনে করেন সচেতন মানুষেরা।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় জাদুঘরের প্রাক্তন ডেপুটি কিউরেটর, প্রয়াত গবেষক শামসুল হোসেন চট্টগ্রামের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন নিয়ে লেখা তাঁর বই ‘ইটারনাল চিটাগং’ এবং ‘মুসলিম মন্যুমেন্ট অব চিটাগাং’ এ মোগল ও সুলতানী আমলসহ প্রাচীন যুগের ছত্রিশটি স্থাপনার কথা উল্লেখ করেছেন। তিনি সেখানে লিখেছিলেন, ‘সরকার যদি জরিপ চালায়, চট্টগ্রামে এরকম আরো স্থাপনা পাওয়া যাবে।’
সরকারের প্রত্নতাত্ত্বিক অধিদপ্তর চট্টগ্রাম বিভাগ গত বছর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী, পটিয়া এবং আনোয়ারা উপজেলায় প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ চালিয়েছে। অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয়ে চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের আঞ্চলিক পরিচালক এ কে এম সাইফুর রহমান বলেন, ‘তিনটি উপজেলায় ৬০টির মতো প্রাচীন স্থাপনা শনাক্ত হয়েছে। এগুলোর ১ হাজার থেকে ১০০ বছরের পুরোনো। আমরা যাচাই বাছাই করে এখান থেকে অনেকগুলোকে সংরক্ষিত স্থাপনার তালিকাভুক্ত করতে প্রস্তাব পাঠাব।’
চট্টগ্রামে অনেক প্রাচীন স্থাপনা রয়েছে। সেগুলোর বেশিরভাগই সংরক্ষিত পুরাকীর্তির তালিকায় নেই। অনেক স্থাপনা ক্ষয়মান। পরিত্যক্ত অবস্থায় বিলুপ্তির পথে। রক্ষণাবেক্ষণের উদ্যোগ নেই। সে সম্পর্কে এ কে এম সাইফুর রহমান বলেন, ‘সরকার আগের চাইতে অনেক বেশি সচেতন। কিছু কিছু পুরো স্থাপনা রক্ষণাবেক্ষণের কারণেই কিংবা বর্তমানে ব্যবহার উপযোগী করতে গিয়ে স্থানীয়রা সংস্কার করে। ধরেন কোনো একটা পুরোনো দালান এখন লাইব্রেরি হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। কতগুলো একেবারে ব্যবহার অনুপযোগী এবং পরিত্যক্ত হয়ে পড়ছে, সেগুলোকে আমরা সংরক্ষণের জন্য অগ্রাধিকারভিত্তিতে আগে প্রস্তাব দিই। যেভাবেই হোক, আমাদের ঐতিহ্যগুলোকে রক্ষা করা খুবই জরুরি। এ ব্যাপারে সরকারের মধ্যেও অনেক সচেতনতা বেড়েছে। ’
চট্টগ্রাম জাতিতাতাত্ত্বিক জাদুঘরের উপপরিচালক আতাউর রহমান বলেন, বাঁশখালির হামিদ বকশি মসজিদ, মিরসরাইয়ের শমসের গাজির কেল্লা, হাটহাজারীর উপজেলার আলাওল মসজিদ, ফতেপুর পাথরের শিলালিপি, বোয়ালখালী উপজেলার কধুরখিল উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম মূলভবন, কধুরখীল পার্বতী চরণ দিঘি, চকবাজারের ওয়ালীবেগ খান মসজিদ (অলি খাঁ মসজিদ) এবং আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদকে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর সংরক্ষিত পুরাকীর্তি বলে ঘোষণা দিয়েছে। তবে এইসব ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ করা হয়নি। এগুলো ছাড়াও চট্টগ্রাম জেলার বিভিন্ন উপজেলায় শতাধিক অসংরক্ষিত পুরাকীর্তি ছড়িয়ে আছে।
শামসুল হোসাইনের বইতে সুলতানি আমলে স্থাপিত হাটহাজারীর ফকিরের মসজিদ, সীতাকুণ্ডের হাম্মাদিয়া মসজিদ ও চট্টগ্রাম নগরের বদর আউলিয়ার মাজারের কথাও উল্লেখ আছে। মুঘল আমলে নির্মিত চট্টগ্রামের বিশেষ স্থাপনাগুলো হলো আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদ, মালখার মসজিদ, ওয়ালী বেগ খান মসজিদ, হামজারবাগ মসজিদ, হামজারবাগ গেট ও সমাধি, মোল্লা মিসকিন মসজিদ ও সমাধি, কদম মোবারক মসজিদ, বায়েজিদ বোস্তামী মসজিদ, চট্টেশ্বরী মন্দির, সীতাকুণ্ডের শাহজানির মাজার। ব্রিটিশ আমলে নির্মিত ঐতিহাসিক উল্লেখযোগ্য স্থাপনাগুলো হলো চট্টগ্রাম আদালত ভবন, জেনারেল হাসপাতাল, সেন্ট্রাল রেলওয়ে বিল্ডিং, রেলওয়ের কাঠের বাংলো, পুরাতন রেলওয়ে স্টেশন, কর্ণফুলী রেলওয়ে সেতু (কালুরঘাট সেতু) এবং পুরাতন সার্কিট হাউস।
হাটহাজারীর বড়দিঘির সুলতানী আমলের নসরত শাহ মসজিদ, মোগল আমলের পোস্তার পাড় ও হাজি মসজিদের মূল স্থাপনার কোনো চিহ্নই নেই। নগরের ‘মাদার ডেইটি’ নামে পরিচিত চট্টেশ্বরীতে প্রায় আড়াইশ বছরের পুরোনো মন্দিরটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় ধ্বংস করে দিয়েছিল হানাদার পাকিস্তানী সৈন্যরা।
আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদ: আন্দরকিল্লা শাহী জামে মসজিদের স্থাপত্য ও গঠন মোগল রীতি অনুযায়ী তৈরি। সমতল ভূমি থেকে প্রায় ৩০ ফুট উপরে ছোট্ট পাহাড়ের ওপর মসজিদটির অবস্থান।
নকশা অনুযায়ী মূল মসজিদটি ১৮ গজ (১৬ মিটার) লম্বা, ৭.৫ গজ (৬.৯ মিটার) চওড়া এবং প্রতিটি দেয়াল প্রায় ২.৫ গজ (২.২ মিটার) পুরু। পশ্চিমের দেয়ালটি পোড়া মাটির তৈরি এবং বাকি তিনটি দেয়াল পাথরের তৈরি। মসজিদের ছাদ মধ্যস্থলে একটি বড় গম্বুজ এবং দুটি ছোট গম্বুজ দ্বারা আবৃত।
১৬৬৬ সালে নির্মিত এর চারটি অষ্টভূজাকৃতির বুরুজগুলোর মধ্যে পেছনের দিকে দুটি বুরুজ বর্তমানে বিদ্যমান। মসজিদটির পূর্বে তিনটি, উত্তর এবং দক্ষিণে একটি করে মোট ৫টি প্রবেশদ্বার রয়েছে। মসজিদের ভেতরে তিনটি মেহরাব রয়েছে। তবে মাঝের সবচেয়ে বড় মেহরাবটিই এখন ব্যবহৃত হয়।
চট্টগ্রামে মুসলিম বিজয়ের স্মারক এই ঐতিহাসিক ও ঐতিহ্যবাহী স্থাপনাটি সেই আগের সৌন্দর্য বর্তমানে নেই। গত কয়েকশ বছর ধরে এই মূল কাঠামোর চারদিকে এর পরিধি বেড়েছে। মসজিদের চৌহদ্দিতেই তিনদিকে হয়েছে বিশাল বিশাল বিপনী কেন্দ্র। ফলে এটির সৌন্দর্যহানি হয়েছে। সময়ের বিবর্তনে, দিন দিন মুসল্লির সংখ্যার বাড়াতে মসজিদের বিস্তৃতি ঘটলেও এর আদি সৌন্দর্যটুকু ঢাকা পড়েছে।
চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবন: চট্টগ্রামের প্রথম আদালত ভবনের অবস্থাও এরকম। এটি এখন সরকারি মহসিন কলেজের সম্পত্তি। মুঘল ও ঔপনিবেশক স্থাপত্য বৈশিষ্ট্যে বিশিষ্ট এই ভবনটি দেয়ালে ও ছাদে বড় বড় ফাটল দেখা দিয়েছে। রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থা নেই। এর পলেস্তারা খসে পড়েছে। চারদিকে আগাছা। ২০১৩ সালে এটি ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিলে ঐতিহ্যসচেতন মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হন। ভাঙার কাজ স্থগিত রাখলেও এটিকে ধ্বংস থেকে রক্ষার কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি।
চন্দনপুরা জামে মসজিদ : চন্দনপুরা জামে মসজিদ নামে পরিচিত ১৫টি গম্বুজ সম্বলিত দৃষ্টিনন্দন মসজিদ–ই–সিরাজ উদ–দৌলা ১৬৬৬ সালে শায়েস্তা খাঁর সৈন্যরা চট্টগ্রাম দখলের পর দীর্ঘদিন ধরে নির্মিত হয়। কিন্তু পরবর্তীতে সড়ক সমপ্রসারণ আশপাশের জায়গায় নানা স্থাপনা হওয়ায় এটির সৌন্দর্য ব্যাহত হয়। স্থাপত্যশৈলীর অন্যতম প্রধান শর্ত হলো এর চারপাশে খোলা জায়গা (স্পেস) রাখা। এরকম খোলা জায়গা না থাকলে স্থাপনাটি নান্দনিকতা ফুটে ওঠে না।
অলি খাঁ মসজিদ : চকবাজারে মুঘল আমলে ১৭১৪ থেকে ১৭১৯–এর মধ্যে নির্মিত ছয় গম্বুজের ওয়ালী বেগ খান মসজিদ। এটি অলিখাঁর মসজিদ নামে পরিচিত, সেটিরও চারপাশে তিনতলা সমপ্রসারণ করা হয়েছে। রাস্তা সমপ্রসারণের কারণে এর একটি অংশ ভেঙে নতুন করে নির্মাণ করা হয়েছে। হযেছে নতুন তোড়ন। ফলে আগের কাঠামো অক্ষুণ্ন থাকেনি। চকবাজারের মোড় চট্টগ্রাম শহরের ব্যস্ততম জায়গার একটি। এখানে সারা দিন যানবাহন, মানুষের ভিড় লেগেই থাকে। সড়ক সমপ্রসারণের জন্য তিন চারটি ব্যস্ত সড়কের মোড়ে অবস্থিত এই মসজিদটি স্থানান্তর বা পুননির্মাণ অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। যে কারণে এটি হারিয়েছে তার ধ্রুপদী সৌন্দর্য।
পরীর পাহাড় বা বর্তমান আদালত ভবন : পরীর পাহাড়শীর্ষে অবস্থিত প্রায় দেড়শ বছরের প্রাচীন চট্টগ্রাম আদালত ভবনেরও কাহিল অবস্থা। এর চারপাশে নির্মিত অসংখ্য স্থাপনায় ঢাকা পড়ে গেছে সুরম্য ভবনটি। এই ভবনের আসল সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনতে সরকারি চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে বিভিন্ন মহলের নানা স্বার্থের টানাপোড়েনে। পরীর পাহাড়ের শীর্ষ অবস্থিত নান্দনিক আদালত ভবনটি সামনে আগে যে বড় খোলা অঙ্গন ছিল, তা এখন দেখা যায় না। এটিকে ঘিরে ধরেছে হাজার হাজার আইনজীবীর দপ্তর সম্বলিত অনেক ভবন। এটি একটি গিঞ্জি এলাকায় পরিণত হয়েছে। অথচ চট্টগ্রাম শহরের একসময়ে অন্যতম দর্শনীয় স্থান ছিল এটি।
পুরাতন সার্কিট হাউস ভবন : একই অবস্থা দাঁড়িয়েছে চট্টগ্রামের ঐতিহ্যবাহী ও দৃষ্টিনন্দন বর্মী–বাংলা স্থাপত্যে নির্মিত সার্কিট হাউজ ভবনটির। চারপাশে অবাঞ্ছিত সব নির্মাণ আর ব্যর্থ অনুকৃতির আড়ালে এই নান্দনিক স্থাপত্যকর্মটি প্রায় ঢাকা পড়ে গেছে। নষ্ট হয়ে গেছে এর পরিপার্শ্বের পরিকল্পিত ভূদৃশ্য। পুরাতন সার্কিটা হাউসের চারপাশে তারই আদলে নতুন সার্কিট হাউস হয়েছে। এর চারপাশে ছিল দৃষ্টিনন্দন মাঠ। সেই মাঠে দখল করে হযেছে শিশু পার্ক। বর্তমানে অবশ্য সেই শিশুপার্কটি উচ্ছেদের সিদ্ধান্ত নিয়েছে প্রশাসন। তাতে মনে হচ্ছে কিছুটা হলেও ব্রিটিশ আমলের এই স্থাপনার সৌন্দর্য ফিরে আসবে।
সীতাকুণ্ডের ছোট কুমিরায় সুলতানী আমলে নির্মিত হাম্মাদিয়া মসজিদ কর্তৃপক্ষ পাঁচশতাধিক বছরের পুরোনো ভবনটিকে সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেয়নি। তার বদলে তারা মসজিদটিতে তিনতলা সমপ্রসারিত অংশ নির্মাণ করে তিন দিক থেকে সুন্দর এই পুরাকীর্তিটি দেখার পথে বাধার সৃষ্টি করেছে। জানা যায়, মসজিদের প্রবেশ পথে কালো বেসল্ট পাথরের শিলালিপিটি খারাপভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এটির ওপর সবুজ রঙ করা হয়েছে, এবং আরবি শিলালিপির কিছু অংশ পাঠের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
চট্টগ্রামের ঐতিহাসিক স্থাপনাগুলোর এমন দুরবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে প্রকৌশলী দেলোয়ার হোসেন মজুমদার বলেন, ‘চট্টগ্রামের প্রাচীন স্থাপনাগুলো প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের নজরে পড়ে না। এই অধিদপ্তরের একটা দপ্তরওতো নেই এই চট্টগ্রামে। কীভাবে তারা এগুলোর দেখভাল করবে। জাতিতাত্ত্বিক জাদুঘরের যিনি দায়িত্বে আছেন তারতো এগুলো নজরে আসার কথা নয়।’ প্রাচীন স্থাপনাগুলো সংস্কার বা সংরক্ষণ না করার পেছনে স্বার্থান্বেষী মহলও দায়ী বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বলেন সম্পদ লুটপাটের ইচ্ছায় অনেকে এগুলোর প্রতি নজর দেয় না।
প্রাচীন স্থাপনাগুলো ধ্বংস করা কিংবা এগুলো পরিবর্তন করা আইনবিরোধী কাজ। পুরাকীর্তি আইন ১৯৬৮ (১৯৭৬ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী, মানব সভ্যতার যেকোনো প্রাচীন (ন্যুনতম একশ বছর পুরোনো) পণ্য, স্থাপত্য, এবং যুদ্ধ, রাজনীতি ও সংস্কৃতির বিবরণকে পুরাকীর্তি বলা যেতে পারে। কোনো ঐতিহাসিক স্থানের ক্ষতি বা পরিবর্তন সাধন এ আইনে কঠোরভাবে নিষিদ্ধ। কিন্তু আইনের প্রতি আমরা সবসময় উদাসীন। আমাদের উদাসীনতার কারণেই চট্টগ্রামে সুলতানী, মুঘল ও ব্রিটিশ উপনিবেশিক আমলে নির্মিত বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা ধ্বংসের মুখে এসে দাঁড়িয়েছে।
বর্তমানে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী উপজেলার বড়উঠান ইউনিয়নে দেয়াঙ পাহাড়ের বিশ্বমুড়া এলাকায় প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও অনুসন্ধান কাজ চলছে। এ কাজ শেষ হলে আমাদের চোখের সামনে অতীতের আরও এক গৌরবময় অধ্যায় উন্মোচিত হবে। এটা বড় আনন্দের খবর। এ ব্যাপারে আনোয়ারার পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয় খনন কাজ বাস্তবায়নের সদস্য সচিব মোস্তফা কামাল যাত্রা বলেন, ‘পণ্ডিত বিহার বিশ্ববিদ্যালয়ের খনন কাজ ইতিহাসের এ উজ্জ্বল অধ্যায় উম্মোচিত হবে। পরিকল্পনা আছে এখানে একটি জাদুঘর স্থাপিত হবে এবং এখানে যেসব প্রত্নচিহ্ন পাওয়া যাবে সেগুলো জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকবে। কিন্তু কথা হচ্ছে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হতে কতদিন লাগবে। খনন প্রকল্পের কাজ শেষ হলে ওরা চলে যাবে। এতদিন যেটা মাটির তলায় সংরক্ষিত ছিল এখন তা উম্মুক্ত হয়ে ঝুঁকিতে ছিল। এটা এখন ছেলে মেয়েদের খেলার জায়গায় পরিণত হয়েছে। বৃষ্টি হলে পানির নিচে তলিয়ে যাবে। দেখা যাবে এখান থেকে ইটগুলো সব খুলে খুলে নিয়ে গেছে। কোনো প্রহরার ব্যবস্থা নেই।’
পুরোনো স্থাপনাগুলো কোনো না কোনোভাবে আমাদের স্মৃতি ও ঐতিহ্যের ধারক। এগুলোর ঐতিহাসিক মূল্য আছে বলে তিনি উল্লেখ করে বলেন, এগুলোর প্রতি যত্নশীল নই। চট্টগ্রামের রহমতগঞ্জে যতীন্দ্রমোহন সেনের বাড়িটা বাংলা কলেজ হিসেবে অনেকদিন ছিল। এটা রক্ষা করতে মামলা পর্যন্ত হয়েছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কিছুই হলো না।’ প্রাচীন স্থাপনাগুলো রক্ষা করতে কিছুতেই যথেচ্ছ ব্যবহার করা যাবে না, এগুলোকে আধুনিকায়ন করা থেকে বিরত থেকে প্রাচীনত্বকে টিকিয়ে রাখতে হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। এ জন্য সরকারকেই উদ্যোগ নিতে হবে, মানুষকে হতে হবে ঐতিহ্যপ্রিয় এবং সচেতন। চট্টগ্রামে জরুরি ভিত্তিতে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের একটি দপ্তর চালু করাও প্রয়োজন বলে তিনি উল্লেখ করেন।
মুসলিম মনুমেন্ট অব চিটাগাং বইয়ের ভূমিকায় লেখক শামসুল হোসাইন লিখেছেন, ‘চট্টগ্রামের প্রাচীন মুসলিম স্থাপতগুলো বঙ্গ সীমান্তের দক্ষিণ–পূর্বতম প্রান্তের এক সুদূর ভূমিতে একটা নতুন ধর্মবিশ্বাসের সূত্রপাত আর বিস্তার লাভের অকথিত কাহিনিগুলোকে মূর্ত করে তোলে। এগুলো কখনোই যথোচিত স্বীকৃতি এবং মনযোগ পায়নি। অথচ পুরাবস্তু এবং সাধারণ উত্তরাধিকার হিসেবে প্রাচীন স্থাপত্যগুলো সমাজে পারস্পারিক বন্ধনের চেতনাকে জোরদার করে।’ তবে সবার আগে জরুরি ভিত্তিতে সেগুলোকে সংরক্ষণ এবং এগুলোর আদি রূপ অক্ষুণ্ন রাখার প্রয়াস নিতে হবে বলে চট্টগ্রামবাসী মনে করেন।
চট্টগ্রাম শহরের ও আশেপাশের পুরাকীর্তির একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা: ১. বদর পাতি বা বদর আউলিয়ার মাজার, ২. ছুটি খাঁ জামে মসজিদ, ৩.বায়েজিদ বোস্তামির দরগাহ্, ৪. আন্দরকিল্লাহ শাহী জামে মসজিদ, ৫. কদম মোবারক মসজিদ, ৬. মসজিদ–এ–সিরাজউদ্দৌলাহ্ (চন্দনপুরা মসজিদ), ৭. চন্দনপুরা নাচঘর, ৮. কেন্দ্রীয় রেলওয়ে ভবন (সিআরবি), ৯. দারুল আদালত (সাবেক আদালত ভবন), ১০ চট্টগ্রাম আদালত ভবন, পরীর পাহাড়, ১০. চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ, ১১. চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল ভবন, ১২. পুরাতন রেল স্টেশান ভবন, ১৩. ফিরিঙ্গি বাজার ভূমি অফিস ভবন, ১৪. আওয়ার লেডি অব দা হোলি রোজারি ক্যাথিড্রাল (পাথরঘাটা গির্জা), ১৫. পি. কে. সেনের সাততলা (ভবন), ১৬. এন. এন. পাল ভবন, নন্দনকানন, ১৭. মালুমের কাঠের ভবন, ১৮. রেলওয়ের কাঠের বাংলো, ১৯. ওয়ার সিমেট্রি, ২০. কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, ২১. চট্টেশ্বরী মন্দির, ২২. কৈবল্যধাম, ২৩.চন্দ্রনাথ মন্দির, সীতাকুণ্ড, ২৪. বিরুপাক্ষ মন্দির, সীতাকুণ্ড, ২৫. স্বয়ম্ভুনাথ মন্দির, সীতাকুণ্ড, ২৬. হাম্মাদিয়া মসজিদ, সীতাকুণ্ড, ২৭. আওয়াল মসজিদ, হাটহাজারি ২৮. ফতেপুর শিলালিপি, হাটহাজারি, ২৯. ইউরোপীয় ক্লাব।
লেখক: কবি, কথাসাহিত্যিক ও সাংবাদিক।