মানুষকে বইমুখী করে তোলার জন্য বইমেলার রয়েছে এক অসামান্য ভূমিকা। সকল বয়সের মানুষের জন্য এখানে থাকে উপযুক্ত বইয়ের পর্যাপ্ত কালেকশন। বাঙালি নাকি জতিগতভাবে আরাম ও প্রমোদপ্রিয়। জ্ঞানান্বেষণের উদ্দেশ্যে লাইব্রেরিতে গিয়ে বইপড়া ও বই সংগ্রহ করার ইচ্ছা ও সুযোগ অনেকেরই হয় না। মেলা উপলক্ষ্যে প্রমোদ ও বইকেনা দু’টোই একসাথে হয়ে যায়। মেলায় যেসব দুর্লভ বই হাতের নাগালে পাওয়া যায় অন্য অনেক সময়েই তা খুঁজে পাওয়া মুশকিল হয়ে পড়ে। যে কোনো মেলায় সমবেত হওয়ার মননগত প্রবণতা আছে বাঙালির। মেলায় মিলিত হওয়ার যে আনন্দ তা অন্যত্র পাওয়া যায় না। অধ্যাপক মাহমুদুল বাসার তাঁর এক প্রবন্ধে বলেন, বইমেলায় বই কেনার গরজেই শুধু মানুষরা আসেন না, আসেন সাংস্কৃতিক পীঠস্থান, উৎসবে মিলিত হওয়ার আনন্দে। তারপর বইও কেনেন। যাঁরা মেলা থেকে বই কেনেন, তাঁরা কেউ কেউ হয়তো কোনোদিনও বই বিপণিতে গিয়ে বই কিনতেন না। এইটা বইমেলার গুরুত্ব।
চট্টগ্রামে বইমেলার আয়োজন নিয়ে এক সময় নানা রকম সংকট ছিল। মাত্র কয়েক বছর আগে সেই সংকটের কিছুটা হলেও সুরাহা হয়। চট্টগ্রামের কবি, সাহিত্যিক, বইপ্রেমী ও সংস্কৃতিকর্মীদের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের উদ্যোগে বর্তমানে অনুষ্ঠিত হচ্ছে ‘একুশের অভিন্ন বইমেলা’। ফেব্রুয়ারি মাসে ভিন্ন ভিন্নভাবে না করে অভিন্ন আয়োজনে বইমেলা করার দাবি ছিল সবার। সকলের দাবির কারণে সাবেক সিটি মেয়র আ জ ম নাছির উদ্দীন এ উদ্যোগ গ্রহণ করে প্রশংসা কুড়িয়েছেন। সেই ধারাবাহিকতায় এই অভিন্ন বইমেলা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে ফেব্রুয়ারি মাসে বর্তমান সিটি মেয়র রেজাউল করিম চৌধুরীর পৃষ্ঠপোষকতায়।
তবে ফেব্রুয়ারি মাসের পর নগরে নানা সময়ে ছোটোখাটো বেশ কয়েকটি বইমেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এরমধ্যে ‘শেখ রাসেল বইমেলা’ একটি। গত বছর থেকে শুরু হয়েছে ‘শেখ রাসেল বইমেলা’। ১৮ই অক্টোবর শেখ রাসেলের জন্মদিনকে উপলক্ষ্য করে এই মেলা গত বছর অনুষ্ঠিত হয়েছে ৫ দিনব্যাপী, চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমির গ্যালারি ভবনে। সারা বাংলাদেশে শেখ রাসেলের নামে এই প্রথম বইমেলার উদ্যোগ নিয়েছে ‘বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি’। সহযোগিতায় ছিল ‘চট্টগ্রাম একাডেমি’। এবারও সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রেখে ‘শেখ রাসেল বইমেলা’র আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়া হয় অন্তত দুমাস আগে থেকে। এবার অনুষ্ঠিত হচ্ছে ৬ দিনব্যাপী, ১৩ই অক্টোবর থেকে ১৮ই অক্টোবর। চট্টগ্রামের পত্র–পত্রিকা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচারের ফলে সুধীবৃন্দের নজরে আসে ‘শেখ রাসেল বইমেলা’র কর্মসূচি। এটি ছোটোদের জন্য অনন্য আয়োজন। কয়েকটি উল্লেখযোগ্য অধিবেশনের কথা জানিয়ে দিতে চাই এ সুযোগে। ১৩ই অক্টোবর শুক্রবার বিকেল সাড়ে চারটায় বইমেলার উদ্বোধন করবেন ওপার বাংলার প্রখ্যাত ভাষাতাত্ত্বিক পণ্ডিত, প্রাবন্ধিক, নাট্যসমালোচক, শিক্ষাবিদ, শিশুসাহিত্যিক ও গবেষক অধ্যাপক ড. পবিত্র সরকার, প্রধান অতিথি থাকবেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পত্রিকা দৈনিক আজাদীর সম্পাদক এম এ মালেক, সভাপতিত্ব করবেন এ জনপদের প্রখ্যাত সমাজবিজ্ঞানী, সাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, শিক্ষাবিদ ও গবেষক অধ্যাপক ড. অনুপম সেন। বিশেষ অতিথি থাকবেন বাংলাদেশ শিশু একাডেমির মহাপরিচালক শিশুসাহিত্যিক আনজীর লিটন, নিখিল ভারত শিশুসাহিত্য সংসদ, কলকাতা‘র সর্বভারতীয় সম্পাদক, শিশুসাহিত্যিক আনসার উল হক। সন্ধ্যায় পবিত্র সরকারের নতুন বই ‘ছড়া পড়ার ইচ্ছে আছে?’ নিয়ে আলোচনা পর্বে সভাপতি থাকবেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. শিরীণ আখতার এবং আলোচক থাকবেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, ‘শিশুসাহিত্য সারথি’ সম্পাদক কবি সুজন বড়ুয়া। দ্বিতীয় দিন ১৪ অক্টোবর থাকছে ‘বাংলাদেশ শিশুসাহিত্য একাডেমি সম্মাননা’ প্রদান অনুষ্ঠান। এতে সভাপতিত্ব করবেন সাহিত্যিক ড. আনোয়ারা আলম। প্রধান অতিথি থাকবেন পশ্চিমবঙ্গ রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ড. পবিত্র সরকার। সম্মাননা পাচ্ছেন দেশের ৫ কৃতী লেখক : অজয় দাশগুপ্ত, ফারুক হোসেন, আহসান মালেক, কেশব জিপসী ও রমজান মাহমুদ। তৃতীয় দিন ১৫ অক্টোবর রোববার থাকছে লেখক সম্মিলন। এতে সভাপতিত্ব করবেন কবি সাহিত্যিক অধ্যাপক এলিজাবেথ আরিফা মুবাশশিরা, প্রধান অতিথি থাকবেন একুশে পদকপ্রাপ্ত সাহিত্যিক, কালি ও কলম সম্পাদক অধ্যাপক সুব্রত বড়ুয়া। চতুর্থ দিন ১৬ অক্টোবর, সোমবার থাকছে ‘সমকালীন শিশুসাহিত্য’ নিয়ে আলোচনা। এতে সভাপতিত্ব করবেন কবি ও শিশুসাহিত্যিক অজয় দাশগুপ্ত, প্রধান অতিথি থাকবেন একুশে পদকপ্রাপ্ত শিক্ষাবিদ, প্রাবন্ধিক, গবেষক ড. মাহবুবুল হক; বিশেষ অতিথি থাকবেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, শিশুসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক আমীরুল ইসলাম, আলোচক থাকবেন কবি ও শিশুসাহিত্যিক ওমর কায়সার। পঞ্চম দিন ১৭ অক্টোবর থাকছে সেমিনার। বিষয়: ‘শেখ রাসেল বিষয়ক বই’। এতে সভাপতিত্ব করবেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত শিশুসাহিত্যিক; কথাসাহিত্যিক অধ্যাপক রফিকুর রশীদ। মূল প্রবন্ধ পাঠ করবেন প্রাবন্ধিক অধ্যাপক কাঞ্চনা চক্রবর্তী। আলোচক থাকবেন ডাকঘর সম্পাদক কবি হাসনাত আমজাদ, কবি–শিশুসাহিত্যিক, সংগঠক স ম শামসুল আলম। শেষ দিন পঞ্চম দিন ১৮ অক্টোবর থাকছে শেখ রাসেল দিবসের আলোচনা। এতে সভাপতিত্ব করবেন রাঙামাটি বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সেলিনা আখতার। প্রধান অতিথি থাকবেন বাংলা একাডেমি পুরস্কারপ্রাপ্ত লেখক, দেশের খ্যাতিমান কবি আসাদ মান্নান। আলোচক থাকবেন কবি–প্রাবন্ধিক–গবেষক অভীক ওসমান, প্রাবন্ধিক কাজী রুনু বিলকিস প্রমুখ।
শিক্ষার্থীদের বইমুখী করার জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হয়েছে বইমেলায়। শৈলী প্রকাশনের স্টলে তারা পাবে অর্ধেক দামে বই কেনার সুযোগ। এছাড়া রাখা হয়েছে শেখ রাসেল কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা। এখানে যারা অংশ নেবে তারা প্রত্যেকে উপহার হিসেবে পাবে কমপক্ষে ২০০ টাকার বই। প্রতিযোগিতায় বিজয়ী প্রথমকে দেওয়া হবে ৫০০ টাকার বই, ৫০০ টাকা নগদ ও সনদ; দ্বিতীয় জনকে দেওয়া হবে ৪০০ টাকার বই, ৪০০ টাকা নগদ ও সনদ; এবং তৃতীয় জনকে দেওয়া হবে ৩০০ টাকার বই, ৩০০ টাকা নগদ ও সনদ।
প্রজন্মকে বইমুখী করার ক্ষেত্রে শিক্ষক–অভিভাবকদের ভূমিকা পালন করতে হবে। তাছাড়া সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোকে আন্তরিক তৎপরতা চালাতে হবে। মনে রাখতে হবে বইমেলায় হাতের নাগালে একসাথে পাওয়া যায় সাহিত্যের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার। ফলে ছাত্রছাত্রীরা ক্লাসের পড়ার বাইরে নানা স্বাদের বই সম্পর্কে চিন্তা করার সুযোগ পায়। তাদের চিন্তায় জ্ঞানের নতুন তৃষ্ণার জন্ম হয়। সব বয়সের পাঠকরা মেতে উঠতে পারে জ্ঞান–সমুদ্রের সীমাহীন জ্ঞানাহরণে। তাই যত বেশি বই নিয়ে হই চই হবে, আলোচনা হবে, মেলা হবে, প্রদর্শনী হবে; ততই মঙ্গল।
‘আরো বই পড়ুন’ নামে কবি জসীম উদদীনের একটি প্রবন্ধ আছে। এ প্রবন্ধে তিনি বলেছেন, ‘আপনারা বই কিনলে আরো কি হবে জানেন? দেশের লেখকরা বই বিক্রি থেকে পয়সা পাবেন। দেশে একদল স্বাধীন–মত লেখক তৈরি হবে। তখন তারা যা ভাববেন তাই লিখতে পারবেন। দুর্বলের হয়ে, নিপীড়িতের হয়ে লড়াই করতে পারবেন। আপনাদের আশা–আকাঙ্ক্ষার ও আদর্শবাদের তারা রূপ দিতে পারবেন।’ বইমেলা মানুষকে আনন্দমুখী করে। মেলায় গেলে বই কেনা ও পড়ার জন্য তাগিদ অনুভব হয়। এই মেলাকে ঘিরে পাঠক–লেখক–প্রকাশকের যে মিলনমেলা হয়, তার তুলনা হয় না।
লেখক : সহযোগী সম্পাদক, দৈনিক আজাদী।
ফেলো (নম্বর : ৪২২), বাংলা একাডেমি।