লাইসেন্সবিহীন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের তালিকা বা এ সম্পর্কিত কোন তথ্য নেই স্বাস্থ্য বিভাগে। ফলে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় এ ধরনের ঠিক কত সংখ্যক স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান লাইসেন্স ছাড়া অবৈধভাবে পরিচালিত হচ্ছে, স্বাস্থ্য বিভাগ এ সংক্রান্ত সুনির্দিষ্ট তথ্য প্রদানে অপারগ।
যদিও লাইসেন্স প্রাপ্ত, লাইসেন্স নবায়নকৃত ও লাইসেন্স পাওয়ার অপেক্ষায় থাকাসহ সর্বোপরি লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিষয়ে তথ্য থাকার কথা জানিয়েছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। লাইসেন্সবিহীন স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের তথ্য না থাকার কথা স্বীকার করে সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি আজাদীকে বলেন, যেসব প্রতিষ্ঠান লাইসেন্সের জন্য আবেদন করে বা করেছে, সেসব প্রতিষ্ঠানের তথ্য আমাদের কাছে রয়েছে। আবেদন করেনি, এমন প্রতিষ্ঠান সম্পর্কে তথ্য আগে থেকেই ছিল না।
এদিকে, এতদিন এ সংক্রান্ত কোন তথ্য না থাকলেও লাইসেন্সবিহীন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার চিহ্নিত করতে এবার তোড়জোড় শুরু হয়েছে। নগরীর চট্টেশ্বরী রোডের সিটি হেলথ ক্লিনিক নামে বেসরকারি একটি হাসপাতাল লাইসেন্সবিহীন ও অবৈধ হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর এ তোড়জোড় শুরু করেছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। লাইসেন্সবিহীন ও অবৈধভাবে পরিচালিত এ হাসপাতাল বুধবার রাতে সিলগালা করে দেয়া হয়। লাইসেন্সবিহীন ও অবৈধভাবে পরিচালিত স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের (চসিক) দ্বারস্থ হচ্ছে স্বাস্থ্য বিভাগ। ওয়ার্ড ভিত্তিক বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানের তালিকা চেয়ে চসিককে চিঠি দেয়ার কথা জানিয়েছেন সিভিল সার্জন। তিনি বলেন, আমাদের লোকবল খুবই অপ্রতুল। যার কারণে ইচ্ছে থাকলেও এ ধরণের তালিকা বা তথ্য সংগ্রহ করা আমাদের জন্য কঠিন। চসিকের লোকবল রয়েছে। তাই আমরা চসিকের সহায়তা নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। মহানগর এলাকায় বেসরকারি স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্ড ভিত্তিক তালিকা চেয়ে চসিককে আমরা চিঠি দিতে যাচ্ছি। ওয়ার্ড ভিত্তিক তালিকা পেলে আমাদের কাছে থাকা লাইসেন্সের জন্য আবেদন করা স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর তালিকার সাথে মিলিয়ে দেখবো। এতে লাইসেন্সবিহীন প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করা সহজ হবে।
অভিযান চলবে: লাইসেন্সবিহীন ও অবৈধ স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান চিহ্নিত করতে জেলা প্রশাসনের সহায়তায় নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়ে অভিযান পরিচালনা করা হবে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি। তিনি বলেন, অভিযানে অনিয়ম ও দোষ-ক্রুটি পাওয়া গেলে লাইসেন্স থাকা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেয়া হবে।
বেসরকারি ল্যাবে অনুমোদনহীন কক্ষ বন্ধ : গতকাল বৃহস্পতিবার নগরীর সল্টগোলা ক্রসিং এলাকায় নিউ চাঁদের আলো নামের একটি বেসরকারি ল্যাবে অনুমোদনহীন কয়েকটি রুম বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। পরির্দশনে গিয়ে ডাক্তারের চেম্বারের সাথে থাকা রোগীর শয্যাসহ এসব কক্ষ বন্ধের নির্দেশ দেন সিভিল সার্জন। এ তথ্য নিশ্চিত করে তিনি আজাদীকে বলেন, ল্যাবটিতে ডাক্তারের চেম্বারের সাথে কয়েকটি কক্ষে শয্যা রাখা ছিল। যেখানে রোগীদের রেখে চিকিৎসা দেয়া হতো। অনুমোদন না থাকায় এসব কক্ষ বন্ধ করে দেয়া হয়।
৭ শতাধিক আবেদন : মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলার আওতাধীন বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন ও নতুন লাইসেন্স পেতে ৭ শতাধিক (৭৬৯টি) আবেদন জমা পড়েছে। ২৩ আগস্ট পর্যন্ত অনলাইনে এসব আবেদন জমা পড়েছে বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় সূত্র নিশ্চিত করেছে।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য মতে- এতদিন মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলায় অনুমোদিত বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা ছিল ৫৩৪টি। তবে ২০১৮ সালের শেষ দিকে এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়া শুরু করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। নবায়নের পাশাপাশি নতুন লাইসেন্স প্রদানেও অনলাইনে আবেদন নেয়া হয়। গত ২৩ আগস্ট পর্যন্ত নতুন লাইসেন্স ও নবায়নের ক্ষেত্রে এ আবেদনের সময়সীমা বেঁধে দেয়া হয়। এ সময়সীমার মধ্যে মহানগরসহ চট্টগ্রাম জেলার আওতাধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে মোট ৭৬৯টি আবেদন জমা পড়েছে অনলাইনে। যদিও একই প্রতিষ্ঠান একাধিক আবেদন (একাধিক বছরের) করায় আবেদনকৃত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা কিছুটা কম হতে পারে বলে সিভিল সার্জন কার্যালয় সংশ্ল্লিষ্টরা জানিয়েছেন। আবেদনের সংখ্যা ৭৬৯টি হলেও আবেদনকৃত প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা সাড়ে পাঁচশো থেকে ছয়শো’র মতো হতে পারে বলে তাঁরা মনে করছেন।
সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা গেছে- অনলাইনে আবেদনের পর নতুন লাইসেন্স পাওয়া কিংবা নবায়নে আরো বেশ কয়টি ধাপ বা প্রক্রিয়া শেষ করতে হয়। যেমন- সংশ্ল্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্টসহ অনলাইনে আবেদনের পরপরই আবেদনগুলো আবেদিত হিসেবে দেখানো হয়। এর মধ্য থেকে যাচাই-বাছাই পূর্বক কাগজপত্র ঠিকঠাক থাকা আবেদনগুলো ‘ওয়েটিং ফর ইন্সফেকশন (পরিদর্শন প্রতিবেদনের জন্য অপেক্ষা)’ ক্যাটাগরিতে তালিকাভূক্ত করা হয়। এবং প্রতিষ্ঠানগুলো পরিদর্শন পূর্বক প্রতিবেদন প্রদানে সিভিল সার্জন কার্যালয়কে নির্দেশনা দেয়া হয়। আর পরিদর্শনের জন্য নির্দেশনা দেয়ার আগ পর্যন্ত বাকি আবেদনগুলো দেখানো হয় ‘পেন্ডিং’ হিসেবে।
যাচাই-বাছাইয়ের পর ডকুমেন্ট বা প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিকঠাক দিতে না পারা আবেদনগুলোকে ‘অসম্পূর্ণ’ হিসেবে দেখায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এই ক্যাটাগরিতে যথাযথভাবে আবেদন করতে না পারা প্রতিষ্ঠানগুলোও যুক্ত হয়। আর এই ক্যাটাগরির আবেদনগুলো অনেকটা রিজেক্টেড হিসেবে ধরে নেয়া হয়।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনার প্রেক্ষিতে পরিদর্শন সম্পন্ন করা প্রতিষ্ঠানগুলোর আবেদনসমূহ তালিকাভূক্ত করা হয় ‘পরিদর্শন সম্পন্ন’ (ইন্সফেকশন ডান) ক্যাটাগরিতে। আর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের পরিদর্শন প্রতিবেদন পাওয়ার পর সর্বশেষ ধাপে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স (নতুন বা নবায়ন) অনুমোদন দিয়ে থাকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।
সিভিল সার্জন কার্যালয় হতে প্রাপ্ত তথ্যে দেখা যায়- আবেদন করা প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে গতকাল ১২ নভেম্বর পর্যন্ত লাইসেন্স নবায়ন হয়েছে ২০৭টি প্রতিষ্ঠানের। আরো ৯০টি প্রতিষ্ঠানের পরিদর্শন কার্যক্রম সম্পন্ন করেছে সিভিল সার্জন কার্যালয়। ১০৭টি প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ‘ওয়েটিং ফর ইন্সফেকশন’ পর্যায়ে রয়েছে। পেন্ডিং হিসেবে রয়েছে ২৩২টি। আর এখনো আবেদিত পর্যায়ে রয়েছে ৮৩টি আবেদন। অন্যদিকে মোট আবেদনের মধ্যে কিছু সংখ্যক আবেদন অসম্পূর্ণ হিসেবে ‘রিজেক্টেড’ পর্যায়ে রয়েছে। অসম্পূর্ণ ও পেন্ডিং থাকা আবেদনের বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের নির্দেশনা অনুযায়ী সিদ্ধান্ত নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন ডা. সেখ ফজলে রাব্বি।
প্রসঙ্গত, বেসরকারি হাসপাতাল ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের লাইসেন্স নবায়ন ও অনুমোদনের বিষয়টি আগে স্থানীয় পর্যায়ে বিভাগীয় স্বাস্থ্য পরিচালকের কার্যালয়ে থাকলেও কয়েকবছর আগে সেটি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীনে নিয়ে যাওয়া হয়। এখন কেন্দ্রীয়ভাবে কেবল স্বাস্থ্য অধিদপ্তরই অনলাইনে এসব প্রতিষ্ঠানের লাইসেন্স নবায়ন ও অনুমোদন দিয়ে আসছে। তবে অনলাইনে আবেদন পদ্ধতি চালুর পর লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়ায় ধীরগতি নেমে এসেছে বলে জানিয়েছেন বেসরকারি একাধিক স্বাস্থ্য সেবা প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। যথাসময়ে আবেদন করলেও স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এখনো গত বছরের (২০১৮-১৯ সালের) লাইসেন্স নবায়নের প্রক্রিয়া শেষ করতে পারেনি বলে অভিযোগ প্রতিষ্ঠানগুলোর। আবেদন করেও নবায়নকৃত লাইসেন্স হাতে না পাওয়ায় অভিযানে হয়রানির শঙ্কা প্রকাশ করছেন এসব প্রতিষ্ঠান সংশ্লিষ্টরা। যদিও আবেদন করলে বিষয়টি বিবেচনায় নেয়া হবে বলে জানিয়েছেন সিভিল সার্জন।