ব্রিটিশ বিরোধী বিপ্লবী এবং একাত্তরের প্রতিরোধ যোদ্ধা পুলিশের স্মৃতি বিজড়িত দুটি ভবন নিয়ে গড়ে তোলা ‘পুলিশ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর’ এর উদ্বোধন করা হয়েছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বৃহস্পতিবার নগরীর দামপাড়া পুলিশ লাইনসে এ জাদুঘরের উদ্বোধন করেন।
গত ২৫ মার্চ দৈনিক আজাদীতে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়েছে, ব্রিটিশ স্থাপত্য শৈলীতে নির্মিত পাশাপাশি দুই লাল ভবন। দুই ভবনের প্রথমটি ছিল ব্রিটিশ পুলিশের অস্ত্রাগার, ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে এক দল বিপ্লবী সেই অস্ত্রাগার দখল করে ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন। উড়িয়ে দিয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের পতাকা। রচিত হয়েছিল ‘চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের’ ইতিহাস। আবার ১৯৭১ সালের মার্চে ইতিহাসের আরেক যুগ সন্ধিঃক্ষণে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালি পুলিশ সদস্যরা দ্বিতীয় লাল দালান থেকে প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করেছিলেন। শহীদ হয়েছিলেন অন্তত ৮২ জন পুলিশ সদস্য। প্রায় ছয় হাজার বর্গফুট আয়তনের এ জাদুঘরে তৎকালীন ব্রিটিশ স্থাপত্য ঠিক রাখা হয়েছে। এখানে ঠাঁই পেয়েছে ১৯৩০ সালে মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে গঠিত ‘ইন্ডিয়ান রিপাবলিকান আমির্র সদস্যদের ছবি, ব্যবহৃত অস্ত্র এবং তাদের ব্যবহৃত পোশাকসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র। বিপ্লবী মাস্টার দা সূর্য সেনের ফাঁসির মঞ্চের একটি রেপ্লিকাও রাখা হয়েছে এ জাদুঘরে। জাদুঘরের একটি অংশে আছে বঙ্গবন্ধু কর্নার, যেখানে বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক জীবনের চট্টগ্রামের অংশটির পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত বিভিন্ন স্মারক ও নথি স্থান পেয়েছে। পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ পুলিশ সুপার এম শামসুল হকের স্মারক হিসেবে তার র্যাংক ব্যাজ, পোশাকসহ ব্যবহৃত বিভিন্ন জিনিস এবং শহীদ আরআই আকরাম হোসেনের স্মারক হিসেবে তার ব্যবহৃত রেডিওটি এ জাদুঘরে সংগৃহীত আছে। স্থান পেয়েছে অন্যান্য শহীদ পুলিশ সদস্যের অস্ত্র ও জিনিসপত্র।
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় যে, মহান মুক্তিযুদ্ধে আমাদের পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের অবদান অপরিসীম। বাংলাদেশ পুলিশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবোজ্জ্বল সময় হলো ১৯৭১ সাল। ২৫ শে মার্চের কালরাত্রিতে হানাদার বাহিনীর সদস্যরা যখন আমাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে, সেই রাতে প্রথম হামলা চালানো হয় রাজারবাগ পুলিশ লাইনে। কিন্তু একজন পুলিশও সেদিন ভয়ে মাথা নত করেনি। অকুতোভয় পুলিশ সদস্যরা সেদিন নির্ভীকচিত্তে ঝাঁপিয়ে পড়ে হানাদার বাহিনীর অত্যাধুনিক অস্ত্রের বিরুদ্ধে। অপারেশন সার্চলাইট নামে খ্যাত এই বীভৎস রাতের জন্য পাকিস্তানিরা পূর্ব থেকেই তাদের নীল নকশা এঁকেছিলো। প্রতিদিন অসংখ্য সেনাবাহিনী, অস্ত্র-শস্ত্র আসতো পশ্চিম পাকিস্তান থেকে। অথচ এ দেশের মানুষ কিছুই বুঝে উঠতে পারে নি। আর ঠিক এরকম একটি ভয়াল রাতেই আমাদের অকুতোভয় পুলিশ বাহিনী পিছু না হটে যুদ্ধের জন্য নিজেদের প্রস্তুত করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ব্যবহৃত বাতিল ৩০৩ রাইফেল দিয়ে সেদিন বীরসন্তানরা হানাদার বাহিনীর বিপরীতে তীব্র প্রতিরোধ তুলে ধরেছিলো। যদিও পাক বাহিনীর ভারী অস্ত্রের গোলায় সেদিন ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছিল সবকটি পুলিশ ব্যারাক। শহীদের অমিয় সুধা পান করেছিলেন অসংখ্য নির্ভীক দেশপ্রেমিক ভাই।
বঙ্গবন্ধু পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের এই আত্মত্যাগ স্মরণ করেন শ্রদ্ধাবনত চিত্তে। ‘পুলিশ জনগণের বন্ধু’ এই কনসেপ্টটি সবার অন্তরে ঢুকিয়ে দিয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। তিনি পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘একটা কথা আপনাদের ভুললে চলবে না। আপনারা স্বাধীন দেশের পুলিশ। আপনারা বিদেশি শোষকদের পুলিশ নন- জনগণের পুলিশ। আপনাদের কর্তব্য জনগণের সেবা করা, জনগণকে ভালোবাসা, দুর্দিনে জনগণকে সাহায্য করা। আপনাদের বাহিনী এমন যে, এর লোক বাংলাদেশের গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে রয়েছে। আপনাদের নিকট বাংলাদেশের মানুষ এখন একটি জিনিস চায়। তারা যেন শান্তিতে ঘুমাতে পারে। তারা আশা করে, চোর, বদমাইশ, গুণ্ডা, দুর্নীতিবাজ যেন তাদের ওপর অত্যাচার করতে না পারে। আপনাদের কর্তব্য অনেক।’
বঙ্গবন্ধুর এই আহ্বান বাংলাদেশের পুলিশ সদস্যরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করে যাচ্ছেন। তাঁরা তাঁদের সক্ষমতার ভেতরে থেকে যথাযথ চেষ্টা করে যাচ্ছেন জনগণের বন্ধু হয়ে মানুষের প্রত্যাশা পূরণ করতে। ‘শুধু পুলিশ সদস্য হিসেবে নয় একজন মানুষ হিসেবেও মানবিক গুণাবলির সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের প্রত্যেক সদস্য আজ জনগণের বন্ধু হিসেবে কাজ করছেন ও জনগণের প্রত্যাশা পূরণে অনন্য ভূমিকা রাখছেন।’
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বিজড়িত এই অস্ত্রাগারের ইতিহাস জনগণের সামনে তুলে ধরার প্রয়াসে জাদুঘর নির্মাণের জন্য সিএমপি কমিশনারকে আমরা ধন্যবাদ জানাই। এই জাদুঘরের মাধ্যমে জাতির ইতিহাসকে উজ্জ্বল করে রাখা হচ্ছে।