চট্টগ্রামে ডেঙ্গুর বিপজ্জনক কসমোপলিটন ভেরিয়েন্ট

ছড়িয়েছে পর্যটক ও রোহিঙ্গাদের মাধ্যমে । রোগীদের ৮৮ ভাগ ডেন-২ ভেরিয়েন্টে আক্রান্ত । চার প্রতিষ্ঠানের গবেষণার তথ্য

আজাদী প্রতিবেদন | শনিবার , ১৯ অক্টোবর, ২০২৪ at ৬:১৩ পূর্বাহ্ণ

চলতি বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্ত ৮৮ ভাগ রোগীর মধ্যে পাওয়া গেছে ডেন২ ভেরিয়েন্টে ডেঙ্গু ভাইরাস। ১১ ভাগ রোগীর মধ্যে পাওয়া গেছে ডেন৩ ভেরিয়েন্ট। এছাড়া গত বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের জিনোম সিকুয়েন্স করে দেখা গেছে, ৫০ ভাগ রোগীর মাঝে বিপজ্জনক কসমোপলিটন ধরন উপস্থিত, যা রোগের তীব্রতা ও জটিলতা বাড়িয়ে দিতে পারে। এছাড়া ডেনএ সিভিয়ারিটি কম, ডেনএ বেশি। ডেন২ এর সাব গ্রুপ বেশি সিভিয়ার সিম্পটম নিয়ে প্রেজেন্ট করে, তাই মৃত্যুর হার বেশি। কসমোপলিটন হচ্ছে ডেন২ এর একটি সাব গ্রুপ।

গত দুই বছর ধরে চট্টগ্রামের ডেঙ্গু রোগীদের নিয়ে গবেষণায় উঠে এসেছে এই তথ্য। এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ ফাউন্ডেশনের তত্ত্বাবধানে চলমান এই গবেষণায় নেতৃত্ব দিচ্ছে আইসিডিডিআর,বি, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ (চমেক) এবং চবি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ। কসমোপলিটন ভেরিয়েন্টের কারণেই চট্টগ্রামে রোগীদের হাসপাতালে ভর্তির হার বেড়ে যাওয়া ও মৃত্যুর হারের ঊর্ধ্বগতি হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।

গবেষণায় দেখা যায়, ২০২৩ সালে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ৬৯ ভাগ রোগীই ডেন২ সেরোটাইপে আক্রান্ত ছিল। আর এ বছর ৮৮ ভাগ রোগী ডেনএ আক্রান্ত। গত বছর চট্টগ্রামে ডেঙ্গু আক্রান্তদের মধ্যে ৬৫ শতাংশ ছিল পুরুষ। ডেঙ্গু রোগীদের প্রতি পাঁচজনে একজন ছিল শিশু। এছাড়া চট্টগ্রামের বেশ কয়েকটি এলাকাকে হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। চট্টগ্রামের ৬০ শতাংশ ডেঙ্গু রোগীর আবাসস্থল পাঁচটি এলাকায়। এগুলোকে গবেষকরা হট স্পট হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। এলাকাগুলো হলো বাকলিয়া, চকবাজার, কোতোয়ালী, ডবলমুরিং ও বায়েজিদ বোস্তামী। এছাড়া গ্রামাঞ্চলের মধ্যে সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, পটিয়া, বোয়ালখালী ও কর্ণফুলী এলাকা থেকে সবচেয়ে বেশি রোগী পাওয়া গেছে। গত বছর ১৫শ রোগীর ওপর পরিচালিত এই গবেষণায় ছিল চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজের মেডিসিন ও পেডিয়াট্রিক নেফ্রোলজি বিভাগ, চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতাল, বিআইটিআইডি, আইসিডিডিআর, বি এবং নেক্সট জেনারেশন সিকোয়েন্সিং, রিসার্চ অ্যান্ড ইনোভেশন ল্যাব। পুরো গবেষণার সমন্বয় ও তত্ত্বাবধানে ছিল স্বাস্থ্য বিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ ও ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন। ইতোমধ্যে ২০০ রোগীর তথ্যউপাত্ত বিশ্লেষণ করা হয়েছে।

চট্টগ্রামে পাওয়া কসমোপলিটন লিনিয়েজ বাংলাদেশে নতুন। বাংলাদেশের অন্য সব অঞ্চল থেকে পাওয়া আগেকার প্রকরণগুলো থেকে চট্টগ্রামে পাওয়া প্রকরণটি উল্লেখযোগ্যভাবে ভিন্ন। ফাইলোজেনেটিক বিন্যাস তথা তুলনামূলক বিশ্লেষণে পাওয়া যায়, এই প্রকরণগুলো মিয়ানমার এবং ভারতে প্রবাহিত হচ্ছে। গবেষকগণ ধারণা করছেন পর্যটক ও রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশকারীদের মাধ্যমে এই বিপজ্জনক প্রকরণটি দেশে অনুপ্রবেশ করেছে। এই প্রকরণ ডেঙ্গুর তীব্রতা ও মৃত্যুহার বাড়িয়ে দেয়। এই জিনোম সিকুয়েন্সগুলো জিনোমের উন্মুক্ত বৈশ্বিক তথ্যভান্ডার জার্মানির গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভ অন শেয়ারিং অল ইনফ্লুয়েঞ্জা ডেটায় (জিআইএসএআইডি) গৃহীত হয়েছে। এছাড়া এই গবেষণার দুটি গবেষণাপত্র ইউরোপিয়ান জার্নাল অব মাইক্রোবায়োলজি অ্যান্ড ইমিউনলজি এবং আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিনে গৃহীত হয়েছে।

২০২৪ সালে চলমান এই প্রকল্পে আইসিডিডিআর,বির বিজ্ঞানী ড. মুস্তাফিজুর রহমানের নেতৃত্বে পরিচালিত চট্টগ্রাম অঞ্চলে এই গবেষণাদলে আছেন চমেক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুস সাত্তার ও ডা. আবুল ফয়সাল মো. নুরুদ্দিন চৌধুরী, চবি জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়টেকনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. আদনান মান্নান এবং এসপেরিয়া হেলথ রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও চমেকের মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আবদুর রব। গবেষকগণ মনে করেন, ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়ার কারণ অনুসন্ধান ও নিয়মিত পর্যবেক্ষণের জন্য জিনোম সিকুয়েন্স অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এসব তথ্য গুরুত্ব সহকারে সরকার গ্রহণ করলে পরবর্তী বছরে ডেঙ্গু প্রতিরোধে আগাম ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

চমেক মেডিসিন বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আবদুস সাত্তার বলেন, শিক্ষিতের হার শহরের তুলনায় গ্রামে কম। সেজন্য তাদের মাঝে সচেতনতাও কম। ডেঙ্গুর প্রকোপ গ্রামেও ছড়িয়ে পড়েছে। এখন সবার উচিত জ্বর হলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। অনেক সময় সাধারণ জ্বর মনে করে আমরা ঘরে চিকিৎসা নিয়ে থাকি। পরে যখন আমাদের কাছে আসে তখন অনেক সময় দেখা যায়, রোগীকে চিকিৎসা দিয়ে বাঁচানো সম্ভব হয় না। সবার আগে সচেতনতা এবং জ্বর উঠলে দ্রুত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া।

চমেক মেডিসিন বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. আবদুর রব আজাদীকে বলেন, কসমোপলিটন হচ্ছে ডেন২ এর একটি সাব গ্রুপ। এই প্রথম চট্টগ্রাম তথা বাংলাদেশে এটা শনাক্ত হয়েছে। মিয়ানমার ও ভারতে এটা আগেই শনাক্ত হয়েছিল। এই গ্রুপের বৈশিষ্ট্য হলো এটায় মৃত্যুর হার, হাসপাতালে বা আইসিইউতে ভর্তি হার অনেক বেশি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধকিং আলী গ্রেপ্তার
পরবর্তী নিবন্ধরাষ্ট্র সংস্কারের পরই জাতীয় নির্বাচন