চট্টগ্রামে কয়েক লাখ মানুষ পানিবন্দি

বন্যায় ডুবে গেছে খাগড়াছড়ির দেড় শতাধিক গ্রাম ।। ফটিকছড়িতে বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি ।। মীরসরাইয়ে অর্ধলক্ষ মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে ।। সীতাকুণ্ডে ভেঙে গেছে বেড়িবাঁধ

আজাদী ডেস্ক | শুক্রবার , ২৩ আগস্ট, ২০২৪ at ৬:১৭ পূর্বাহ্ণ

ভারী বৃষ্টিপাত ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামে কয়েকলাখ মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। ১০টি উপজেলার ৯৪ টি ইউনিয়ন বন্যার কবলে পড়েছে। ফটিকছড়ি, মীরসরাই, সীতাকুণ্ড, হাটহাজারী, কর্ণফুলী, পটিয়া, বোয়ালখালী, বাঁশখালী ও লোহাগাড়া উপজেলার উক্ত ৯৪ টি ইউনিয়নে পানিবন্দী হয়ে পড়েছে ৪৫ হাজার ৯৪৬ টি পরিবার।

এদিকে বন্যায় বিপর্যয়ের মুখে পড়েছে খাগড়াছড়ি। নদী ভাঙন ও পাহাড়ি ঢলে চট্টগ্রামে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফটিকছড়ি উপজেলা। এ উপজেলার হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছে। কোমরসমান পানিতে ডুবে গেছে নাজিরহাটস্থ ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। মীরসরাইয়ে অর্ধলক্ষ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছে। সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের সিকদার খালের বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়েছে। এতে পাশের কয়েকটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে।

আমাদের খাগড়াছড়ি প্রতিনিধি জানান, রেকর্ড বৃষ্টিপাতের কারণে প্লাবিত হয়েছে খাগড়াছড়ির গ্রাম থেকে শহর। সমপ্রতিকালে খাগড়াছড়ি শহর না ডুবলেও বৃহস্পতিবার সকাল থেকে সেই রের্কডও ভেঙেছে। শহরের ভেতরে প্রবেশ করছে বন্যার পানি। সকাল থেকে শহরের আদালত সড়ক, মাস্টারপাড়া, মিলনপুর, বায়তুশরফসহ খাগড়াছড়ি পৌর শহরের সাতটি সড়ক এখন পানির নিচে। জেলা সদরের বেশীর এলাকার মানুষ পানিবন্দি। বুধবার পানি কমে যাওয়ায় খাগড়াছড়ি জেলা সদরের আশ্রয় কেন্দ্র থেকে আসা পরিবার কেন্দ্রগুলো বাড়ি ফিরেছিল। তবে বৃহস্পতিবার ভোর থেকে পুনরায় বন্যার পানি প্রবেশ করতে শুরু করে। ভারত থেকে আসা পাহাড়ি ঢলের কারণে মাইনী নদীর পানি বেড়ে দীঘিনালার মেরুং , বোয়ালখালি ও কবাখালি ইউনিয়নের ৫০ গ্রাম প্ল্যাবিত হয়। বন্যার পানিতে ডুবে গেছে সড়ক, কৃষি জমি ও পুকুর। খাবার ও বিশুদ্ধ পানির সংকটে পরেছে দুর্ভোগে পরেছে সাধারণ মানুষ।

খাগড়াছড়ি পৌর শহরের বাসিন্দা আরাফুলত ইসলাম,মাঈন উদ্দিন ও মো.বেলাল হোসান বলেন,’ এতো পানি গত ১০ বছরেও দেখি নাই। শহরের মধ্যে সাধারণ পানি উঠে না। এবার শহরের প্রধান সড়কগুলোতে পানি উঠে গেছে।

এদিকে পাহাড়ি ঢলে দীঘিনালালংগদু সড়কের হেড কোয়াটার এলাকায় সড়ক ডুবে যাওয়ার রাঙামাটির লংগদুর সাথে সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে গেছে। ডুবে গেছে মেরুং বাজার।

জেলা প্রশাসক মো: সহিদুজ্জামান জানান, খাগড়াছড়ি পৌরসভায় ১৮টিসহ পুরো জেলায় ৯৯টি আশ্রয় খোলা রাখা হয়েছে। আশ্রিতদের জন্য শুকনা খাবারের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

ফটিকছড়িতে হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি

ফটিকছড়ি প্রতিনিধি জানান, ফটিকছড়ি উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির আরো অবনতি হয়েছে। উপজেলার হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দী অবস্থায় রয়েছেন।

নাজিরহাটে চট্টগ্রামখাগড়াছড়ি আঞ্চলিক মহাসড়ক, সুয়াবিলে কাজিরহাটনাজিরহাট মহাসড়ক, পাইন্দং এ গহিরাহেয়াকো সড়কে বন্যার পানিতে চলাচলে বিঘ্ন ঘটে। এছাড়াও কাজিরহাট থেকে সরাসরি যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। দুর্গত পরিবারগুলো আশ্রয়কেন্দ্রে ছুটছে। তবে যোগাযোগব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় বহু দুর্গম এলাকার প্রকৃত চিত্র এখনো পাওয়া যায়নি।

বন্যায় কোমরসমান পানিতে ডুবে গেছে নাজিরহাটস্থ ফটিকছড়ি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙ। গতকাল বেলা ৩টার দিকে সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়হালদা খালের পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রশিদাপুকুর পাড এলাকা দিয়ে হু হু করে পানি ডুকে পড়ছে। এ পানিতে আশপাশের এলাকাসহ নাজিরহাট বাজারে কোথাও হাঁটুসমান আবার কোথাও কোমরসমান পানি জমে জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেঙের বাহিরে কোমর সমান পানি এবং স্বাস্থ্য কমপ্লেঙের ভিতরে হাঁটু সমান পানি জমেছে। এতে সমস্যায় পড়েছে রোগী ও রোগীর স্বজন, ডাক্তার, নার্স ও কর্মকর্তা কর্মচারীরা। নিচতলায় পানি জমাতে চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে হাসপাতালের দ্বিতীয় তলায়।

মীরসরাইয়ে মানুষের সীমাহীন দুর্ভোগ

মীরসরাই প্রতিনিধি জানান, টানা বৃষ্টি ও ফেনী দিয়ে ভারত থেকে আসা পানির তোড়ে মীরসরাই উপজেলার কয়েকটি ইউনিয়নের হাজার হাজার মানুষ দুর্ভোগের কবলে পড়েছেন। উপজেলার করেরহাট ইউনিয়নের পশ্চিম জোয়ার, অলিনগর, কাটাগাং, ধূম ইউনিয়নের গনকছরা, আজমনগর, শুক্কুইরবাড়িয়া হাট এর অন্তত অর্ধলক্ষ মানুষ বাড়িঘর ছেড়ে বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে আশ্রয় নিয়েছেন। খৈয়াছরা ইউনিয়নের ফেনাফুনি, সৈদালী, পোলমোগরা সহ কয়েকটি গ্রাম ও তলিয়ে গেছে। এছাড়া ইছাখালী, ওচমানপুর, মঘাদিয়া, দুর্গাপুর , কাটাছরা ইউনিয়নের অনেক গ্রাম, রাস্তাঘাট হাটবাজার তলিয়ে গেছে পানিতে। গনকছড়া গ্রামের ভুক্তভোগী আব্দুল আলীম ( ৬০) বলেন, আমার এই ৬০ বছরের জীবনে এমন পানি আর কখনো দেখিনাই। ৮৮ এর বন্যায়ও এতো পানি উঠে নাই উপজেলার বারৈয়ারহাট শান্তিরহাট সড়ক, গনকছড়া সড়ক, কাটাগাং সড়ক সহ অনেক রাস্তা পানির নীচে তলিয়ে গেছে।

এই বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মাহফুজা জেরিন বলেন আমি ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি গ্রাম পরিদর্শন করেছি। এই মুহুর্তে ও আমি করেরহাটের কাটাগাং গ্রামে আছি। ইতিমধ্যে ৫০ মেট্রিক টন চাল বরাদ্দ নেয়া হয়েছে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে ও অনেকে এগিয়ে এসেছেন। আবার সেনাবাহিনী এবং উপজেলা প্রশাসনের যৌথ উদ্যোগে নিরাপদ আশ্রয়, পর্যাপ্ত খাবার, স্পীড বোট সহ প্রয়োজনীয় সকল উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

ইতিমধ্যে প্রবল বর্ষণের ফলে ডুবে গেছে ঢাকাচট্টগ্রাম মহাসড়ক এর কয়েকটি অংশ। জোরারগঞ্জ হাইওয়ে থানা পুলিশের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সোহেল সরকার বলেন, মহাসড়কে পানির কারণে যান চলাচল বন্ধ। পানি কমে গেলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।

সীতাকুণ্ডে বেড়িবাঁধ ভেঙে গেছে

সীতাকুণ্ড প্রতিনিধি জানান, সীতাকুণ্ডের বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের সিকদার খালের বেড়িবাঁধ পানি স্রোতে ভেঙে গিয়েছে। এতে পাশের কয়েকটি গ্রাম পানিতে তলিয়ে গেছে। এছাড়া অতি বর্ষণের কারণে সীতাকুণ্ডে পাহাড়ি ঢলে ডুবে গেছে উপজেলার উত্তরাংশের ছয়টি ইউনিয়নের বেশির ভাগ এলাকা। এসব এলাকা হাঁটু থেকে কোমরসমান পানিতে তলিয়ে গেছে। জলাবদ্ধতায় ১৫০ হেক্টর ফসল পানির নিচে তলিয়ে গেছে।

গতকাল দুপুরে অতিবৃষ্টিতে উপজেলার বাঁশবাড়িয়া ইউনিয়নের শিকদার খালের বেড়িবাঁধের একটি অংশ ভেঙে গেছে। পানির চাপে খালটির ওপর থাকা স্লুইসগেটও ভেঙে গেছে। বেড়িবাঁধের ভেতরের অংশের কৃষিজমিগুলো কোমরসমান পানির নিচে তলিয়ে গেছে। ওই এলাকায় বাড়িঘরও পানিতে ডুবে রয়েছে।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কে এম রফিকুল ইসলাম বলেন, বাঁশবাড়িয়া বেডিবাঁধের কিছু অংশ ভেঙে যাওয়ার বিষয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে কথা হয়েছে। বৃষ্টি বন্ধ হলে দ্রুত সংস্কারের জন্য তাগাদা দেয়া হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন ইউনিয়নে কৃষির ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে সার্বিক কী পরিমাণ ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা নিরূপনের চেষ্টা করছি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম থেকে ফেনী গেল অর্ধশতাধিক সাম্পান
পরবর্তী নিবন্ধউপদেষ্টাদের বন্যার্তদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান ইউনূসের