টেস্ট ক্রিকেটে ব্রায়ান লারা হিরো। তাঁর দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিং সবাইকে মুগ্ধ করত। স্বাভাবিকভাবে সব আলো ছিলো তার উপর। তবে একই সময়ে আরেকজন ব্যাটসম্যান নিখুঁতভাবে তার দায়িত্ব পালন করতেন। তিনি শিবনারায়ণ চন্দরপাল। পারফরম্যান্সের তুলনায় তিনি ছিলেন আন্ডাররেটেড। বিএনপিতে ডা. শাহাদাত হোসেনের অবস্থাও অনেকটা চন্দরপলের মতো। গত সতের বছর যিনি পাদপ্রদীপের নিচে সে অর্থে না থেকেও চট্টগ্রাম শহর বিএনপিকে আগলে রেখেছেন। অনেকটা চন্দরপলের মতো। কোনো ধরনের ভাঙন বা মনোমালিন্যের চিড় তিনি ধরতে দেননি সাংগঠনিক ব্যবস্থাপনায়।
ডা. শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রাম মহানগর বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ও সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন বিগত স্বৈরাচারী আওয়ামীলীগ সরকারের আমলে। গণতন্ত্রের পক্ষে সোচ্চার এই নেতাকে তাই বারবার কারাবরণ করতে হয়েছিল। একের পর এক হয়রানিমূলক মামলায় তাঁর স্বাভাবিক জীবন ব্যহত হয়েছে। নিজ চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান থেকেও তাঁকে পুলিশ ভ্যানে উঠতে হয়েছিল বারবার। জুলাই অভ্যুত্থান যখন তুঙ্গে তখন তাঁর বাসভবনে আগুন লাগিয়ে দেয় রাজনৈতিক দুর্বৃত্তরা।
তরুণ প্রজন্মের আইকন ডা. শাহাদাত হোসেন চট্টগ্রামে বেশ জনপ্রিয় তাঁর মেধা ও চারিত্রিক দৃঢ়তার জন্য। তাঁর উত্থান চট্টগ্রামবাসীর দীর্ঘদিনের আক্ষেপ ঘুচিয়েছে। একজন উচ্চ শিক্ষিত রুচিবান নেতার খোঁজ মেলে তাঁর মধ্যে। গত বছরের পাঁচ অগাস্ট স্বৈরাচার আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর বছরের শেষের দিকে আদালতের রায়ে দিকপালহীন চট্টগ্রাম নগরের দায়িত্ব কাঁধে নেন ডাক্তার শাহাদাত হোসেন। আগের মেয়রের ফেলে যাওয়া জঞ্জাল পরিস্কারের বিশাল বোঝা কাঁধে নেন তিনি। প্রবাদে আছে, ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’। দায়িত্ব নেওয়ার পরপর তিনি তাঁকে চেনাতে শুরু করেছেন তাঁর দুরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা দিয়ে। নিরন্তর ছুটে চলছেন নগরের এ–প্রান্ত থেকে ও– প্রান্তে।
গত দশ বছরে চট্টগ্রাম শহরের সবচেয়ে অবহেলিত ছিলো সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত স্কুল–কলেজ ও প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়। স্কুল–কলেজগুলোতে শিক্ষক নিয়োগে নগ্ন দলীয়করণ ও অযোগ্য লোকজনের আধিক্যের ফলে পড়ালেখার পরিবেশ বিঘ্নিত হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিকের ফলাফল তলানিতে নেমে যায়। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা জড়িয়ে পড়ে রাজনৈতিক ক্যাচালে। ডাক্তার শাহাদাত হোসেন দায়িত্ব বুঝে নিয়ে সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত স্কুল–কলেজগুলোতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেন। বড় পরিসরে অমর একুশে বইমেলা চট্টগ্রাম আয়োজনে তিনি অনন্য ভূমিকা পালন করেন। বইমেলা উপলক্ষে মাসব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়ে ওঠে শিক্ষার্থীদের জন্য মেধা বিকাশের মঞ্চ। সিটি কর্পোরেশন পরিচালিত স্কুল–কলেজের শিক্ষার্থীরা নব উদ্যমে অংশগ্রহণ করেন বইমেলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে। এক কথায় নতুন মেয়র তাঁর ব্যক্তিত্বের গুণে প্রাণচাঞ্চল্য ফিরিয়ে আনেন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মাঝে।
দেশের অন্যান্য সিটি কর্পোরেশনের তুলনায় চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের স্বাতন্ত্র্য হলো শিক্ষা ও চিকিৎসায়। স্কুল–কলেজের পাশাপাশি চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন প্রতিষ্ঠা করেছিলো একটি বিশ্ববিদ্যালয়। প্রাইভেট ইউনিভার্সিটি এক্ট–২০১০ এর অধীনে পরিচালিত এই বিশ্ববিদ্যালয় ইতোমধ্যে দেশের মানুষের কাছে একটি মানসম্মত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে বেশ সুনাম অর্জন করেছে। এই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাজার হাজার গ্র্যাজুয়েট দেশের আইন, শিক্ষা, প্রশাসন, ডেভেলপমেন্ট ও অন্যান্য সেক্টরে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো জনগণের টাকায় প্রতিষ্ঠিত এই বিশ্ববিদ্যালয়ের মালিকানা লুট হয়ে যায় স্বৈরাচার সরকারের সাবেক মন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের হাতে। ডাক্তার শাহাদাত হোসেন মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের অল্পকিছু দিনের মধ্যে আদালতের রায়ে কর্পোরেশনের স্বতন্ত্র এই প্রতিষ্ঠানের মালিকানা পায়। বর্তমানে তাঁর বলিষ্ঠ নেতৃত্বে প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় সুন্দরভাবে পরিচালিত হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা প্রশাসনিক জটিলতা কাটিয়ে উঠতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বরেণ্য শিক্ষক ও ব্যবসায় প্রশাসন অনুষদের ডীন প্রফেসর নছরুল কাদিরকে ভাইস–চ্যান্সেলর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছেন। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশনের পরিচালনায় ফিরে যাওয়ায় শিক্ষক–শিক্ষার্থীর মধ্যে নতুন উদ্যম এসেছে।
চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের সাথে সিটি কর্পোরেশনের সমন্বয়হীনতার কারণে নগরের বিভিন্ন স্থানে অপরিকল্পিতভাবে অনেক স্থাপনা গড়ে উঠেছিল। যার অধিকাংশ নালার উপর। ফলে পানি নিষ্কাশন বাধাগ্রস্ত হতো। গত বছর পর্যন্ত চট্টগ্রামবাসীর সবচেয়ে বড়ো দুঃখের নাম ছিলো জলাবদ্ধতা। আকাশে মেঘের দেখা দিলে নীচতলার বাসিন্দাদের আসবাবপত্র গোছাতে হতো। কারণ অল্প বৃষ্টিতে পানির নিচে তলিয়ে যেতো নগরের গুরুত্বপূর্ণ সব স্পট। ডাক্তার শাহাদাত মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পরপর তিনি সত্বর ব্যবস্থা গ্রহণ করেন জলাবদ্ধতা নিরসন প্রকল্পের কাজ দ্রুততার সাথে শেষ করার। তাঁর এই কৌশলগত পরিকল্পনা ও উদ্যোগের সুফল ভোগ করতে শুরু করেছেন নগরবাসী। এবার টানা চার দিনের বারিবর্ষণে চট্টগ্রামবাসীকে জলের তলে তলিয়ে যেতে হয়নি। ভারী বর্ষণ সত্ত্বেও স্বচ্ছন্দে চলাচল করতে পারছে নগরবাসী।
এতদিন সমন্বয়হীনতার অপর নাম ছিলো চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। মেয়র হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর ডাক্তার শাহাদাত হোসেন তাঁর কর্মদক্ষতা ও নৈপুণ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের সাথে কর্পোরেশনের দেনাপাওনা বিষয়ক অচলাবস্থার অবসান ঘটাতে সক্ষম হয়েছেন দ্রুততম সময়ের মধ্যে। মেয়রের বিচক্ষণতায় একশো কোটি টাকা পৌরকর আদায় করতে সক্ষম হয়েছে চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন। আর্থিকভাবে ধুঁকতে থাকা কর্পোরেশনের জন্য এটা বিশাল এক প্রাপ্তি।
ডা. শাহাদাত পেশায় একজন চিকিৎসক হওয়ায় লাভবান হয়েছে চট্টগ্রামের স্বাস্থ্যখাত। তিনি দেশে প্রথমবারের মতো স্কুল হেলথ কার্ড চালু করেছেন। নগরের পাঁচটি বিদ্যালয় –পাথরঘাটা সিটি করপোরেশন বালক উচ্চ বিদ্যালয়, গুল এজার বেগম সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়, ইমারাতুন্নেসা কিন্ডারগার্টেন, পাঁচলাইশ কিন্ডারগার্টেন এবং কাপাসগোলা সিটি করপোরেশন উচ্চ বিদ্যালয়ে এই সেবা চালু করা হয়েছে। স্কুল হেলথ কার্ড চালু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শিশুদের স্বাস্থ্য রক্ষা শুধু অভিভাবকদের নয়, বরং প্রতিষ্ঠান ও সিটি করপোরেশনেরও দায়িত্ব। এই হেলথ কার্ডের মাধ্যমে শিশুদের নিয়মিত স্বাস্থ্য পরীক্ষা, টিকাদান এবং চিকিৎসা সংক্রান্ত তথ্য সংরক্ষণের মাধ্যমে একটি সুস্থ প্রজন্ম গড়ে তোলা সম্ভব হবে।
ডা. শাহাদাত একজন কাজ পাগল মানুষ। নগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, খাল খনন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা, চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নে উদ্যোগ নেওয়া এবং নগরের স্মাজ–সাহিত্য ও শিল্পাঙ্গনে তাঁর উদ্যমী বিচরণ চট্টগ্রামবাসীর মনে নব আশার সঞ্চার করেছে। একটি বিশ্বমানের গ্রিন ও হেলদি সিটি নির্মাণের লক্ষ্যে তাঁর গৃহীত উদ্যোগ সফলভাবে বাস্তবায়িত হলে চট্টগ্রাম হয়ে উঠবে দেশের মধ্যে একটা মডেল সিটি কর্পোরেশন। ডা. শাহাদাত হোসেন হয়ে উঠবেন সত্যিকার অর্থে একজন জনতার মেয়র।
লেখক : শিক্ষক ও অনুবাদক। সহকারী অধ্যাপক ও হল প্রভোস্ট, বাংলাদেশ আর্মি ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি, কুমিল্লা।