বাংলাদেশে অবস্থিত সব শহরের মধ্যে চট্টগ্রাম শহর হচ্ছে সবচেয়ে সুন্দর শহর। যদিও রাজশাহী শহরকে বলা হয় পরিচ্ছন্ন শহর। তবে চট্টগ্রাম শহরের অবস্থান অনন্য। এখানে আছে পাহাড়, নদী ও সমুদ্র। আলোক ঝলমল রাতে যদি কদমতলী থেকে টাইগারপাস রাস্তাটিকে দেখা হয় তবে মনে হবে পাহাড়ের গায়ে দুই স্তরে গাড়ি চলছে। সেই এক অদ্ভূত সৌন্দর্য যা অন্য কোনো শহরে আশা করা যায় না। এ কারণে চট্টগ্রাম শহরকে বলা হয় প্রাচ্যের সুইজারল্যান্ড।
আমরা যারা নিত্য যাপন করি এ শহরে, তারা হয়তো তা উপলব্ধি করি না। কিন্তু বাইর থেকে বেড়াতে আসা লোকজনের চোখে ধরা পড়ে এ সৌন্দর্য্যমণ্ডিত দৃশ্য। বলা হয়– পাহাড়, নদী ও সমুদ্র– এ তিন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শহর চট্টগ্রাম। শহরের ভেতর দিয়ে চলে গেছে অসংখ্য খাল। বর্ষা মৌসুমে যখন প্রচুর বৃষ্টিপাত হয় তখন পাহাড় বা উচ্চ এলাকা থেকে বৃষ্টির পানি দ্রুত নিচের দিকে গড়িয়ে পড়ে। বিশেষ করে শহরের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া অসংখ্য খালের মধ্যে দিয়ে বৃষ্টির পানি নেমে গিয়ে পড়ে কর্ণফুলী নদীতে। কিন্তু বিভিন্ন সরকারের আমলে বিভিন্ন ক্ষমতাবান লোকেরা খালের পাশে বা খাল দখল করে আবাসস্থল গড়ে তোলার কারণে ছোট হয়ে গেছে খালগুলো। ফলে বৃষ্টির পানি প্রবাহে বাধাপ্রাপ্ত হয়। তাছাড়া ময়লা আবর্জনা ফেলার কারণে অধিকাংশ খাল প্রায় মৃত বলে মনে করা যায়। এই অবস্থায় যখন বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি শুরু হয় তখন ভরাট ও সরু খালগুলো পর্যাপ্ত বৃষ্টির পানি ধারণ করতে পারে না। ফলে বৃষ্টির পানিতে চট্টগ্রাম শহরের অধিকাংশ এলাকা প্লাবিত হয়ে যায়। এরূপ জলাবদ্ধতা নিরসনের লক্ষ্যে বিগত সরকার এক মহাপরিকল্পনা শুরু করেছিল যা এখনো চলমান।
আবার চট্টগ্রামসহ বাংলাদেশের অধিকাংশ শহরে আর একটি বিপজ্জনক যান চলাচল শুরু হয়েছে, যার নাম ব্যাটারিচালিত রিক্শা। রিক্শার সঙ্গে মোটর লাগিয়ে স্থানীয় গ্যারেজে তৈরি করা ব্যাটারিচালিত রিক্শা এখন চট্টগ্রাম পরিবহন ব্যবস্থায় রীতিমত বিপর্যয়রূপে দেখা দিয়েছে। এ জাতীয় রিক্শা বাড়তে বাড়তে এমন এক নাজুক অবস্থায় পৌঁছে গেছে যে, যেখানে ট্রাফিক ব্যবস্থা হুমকির সম্মুখীন। অবৈজ্ঞানিকভাবে তৈরি হওয়া এসব রিক্শা দুর্ঘটনার বড় কারণ। সড়কের শৃঙ্খলা, দুর্ঘটনার ঝুঁকি ও জীবিকা এই তিনটি বিষয় বিবেচনা করে সরকারকে ব্যাটারিচালিত রিক্শা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। একটি আধুনিক শহরে জনসংখ্যার তুলনায় যে পরিমাণ সড়ক থাকা প্রয়োজন ছিল চট্টগ্রাম শহরে সেটা নেই। আবার এসব শহরে দ্রুত, মাঝারি ও ধীরগতির মিলিয়ে প্রায় ১৮ ধরনের যানবাহন চলাচল করে। নতুন করে ব্যাটারিচালিত রিক্শা শহরের সড়কের নৈরাজ্যকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে গেছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মফস্বল শহর ও গ্রামাঞ্চলে ব্যাটারিচালিত রিক্শা ও ভ্যান জীবিকার একটি বড় অবলম্বন হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে তা প্রসারিত হয়ে মেট্রোপলিটন শহর পর্যন্ত চলে আসে। এ সময়ে সরকার যদি কঠোর অবস্থানে থাকতে পারতো তবে এরূপ বিশৃঙ্খলা পরিস্থিতির সৃষ্টি হতো না। কিন্তু ৫ আগস্ট ২০২৪–এ রাজনৈতিক পরিবর্তনের পর আইন শৃঙ্খলার যে শিথিলতা আসে, তার সুযোগে এক শ্রেণির লোক অটো রিক্শা চালিয়ে দ্রুত অধিক আয়ের পথ বেঁচে নেয়। এখন পরিস্থিতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, ট্রাফিক রীতিনীতির কোন তোয়াক্কা না করে স্বল্প সময়ে অধিক অর্থ আয় করার জন্য নাবালক বয়সী, স্বল্প বয়সী, মধ্য বয়সী বা বৃদ্ধ বয়সী লোকেরা এ ব্যাটারিচালিত রিক্শাকে আয়ের পথ হিসেবে বেছে নিয়েছে। কারণ এ রিক্শায় যাত্রীর কোনো অভাব নেই। কিন্তু জনগণ কেন এরূপ রিক্শায় চড়তে চায়? কারণ এ যান তিন চাকার টেক্সির সমগতিতে চলে। তবে ভাড়া সিএনজি টেক্সির তুলনায় অনেক কম। একটি সিএনজি টেক্সি একশত টাকার কমে কোনো প্যাসেঞ্জার নিতে চায় না। অথচ তার অর্ধেক ভাড়ায় একই সময়ে মোটর রিক্শা করে নির্দিষ্ট গন্তব্যে পৌঁছা যায়। এ কারণে মোটর রিক্শার জনপ্রিয়তা অধিক। কর্তৃপক্ষ বাস্তব এই সত্যটিকে উপলব্ধি করতে চায় না। আবার রিক্শা চালকের সংখ্যা বাড়লো কেন? এটারও সামাজিক একটি প্রেক্ষাপট আছে।
৫ আগস্টের পর আইন শৃঙ্খলা ব্যবস্থায় শিথিলতা আসে। তাছাড়া বিপুল সংখ্যক কলকারখানা বন্ধ হয়ে গেছে। বেশকিছু গার্মেন্টস শিল্পও বন্ধ। নির্মাণ শিল্প অনেকাংশে সংকুচিত হয়েছে। এসব শিল্প কারখানায় নিয়োজিত শ্রমিকেরা স্বল্প শ্রমে প্রচুর আয় করার জন্য ব্যাটারিচালিত রিক্শাকে বেছে নিয়েছে। এই রিক্শার মূল সমস্যা হলো–নিয়ন্ত্রণহীন গতি, ব্রেকিং সিস্টেমের দুর্বলতা, রিক্শার কাঠামোগত দুর্বলতা। কিছুদিন পূর্বে ব্যাটারিচালিত রিক্শা সম্পর্কে এক নিবন্ধে বলেছিলাম যে, সিটি কর্পোরেশন যদি এসব রিক্শা চালককে অতি স্বল্প সময়ের ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করে স্বল্প ফিতে লাইসেন্স দেয়ার ব্যবস্থা করে, তবে সিটি কর্পোরেশনেরও আয় বাড়বে এবং দক্ষ চালকও পাওয়া যাবে। তাতে দুর্ঘটনাও কমে আসবে। সিটি কর্পোরেশনের অনেকগুলো ভাল কাজের মধ্যে এরূপ একটি কাজ যদি অন্তর্ভুক্ত হয় তবে সিটি কর্পোরেশনের সুনাম আরো বৃদ্ধি পাবে। এখন ব্যাটারিচালিত রিক্শার সাথে চট্টগ্রাম শহরের অরক্ষিত খালের সম্পর্ক কী? প্রকৃতপক্ষে পাহাড়, নদী ও সমুদ্র এ তিন প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত শহর হয় চট্টগ্রাম। ফলে এই শহরের পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা ও অন্যান্য শহরের তুলনায় ভিন্ন। শহরের বিভিন্ন প্রান্ত দিয়ে এবং শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে অসংখ্য খাল। আবার এই খালগুলো অসংখ্য রাস্তার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে। এসব রাস্তা দিয়ে দ্রুত গতিতে যখন ব্যাটারিচালিত অটো রিক্শা চলে তখন দুর্ঘটনার সম্ভাবনা থাকে।
গত ১৮ এপ্রিল একটি পরিবার ব্যাটারিচালিত অটোরিক্শায় আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে যাওয়ার সময় অটোরিক্শাটি উল্টে খালে পড়ে যায়। মা ও দাদি উঠে আসতে পারলেও স্রোতে ভেসে যায় সঙ্গে থাকা শিশুটি। রাত আটটার দিকে হিজড়া খালে এ ঘটনা ঘটে। শিশুটির মরদেহ পরদিন প্রায় চার কিলোমিটার দূরে চাক্তাই খালে পাওয়া যায়। রিক্শা পড়ে যাওয়ায় স্থানটিতে খালের উপর কোনো বেস্টনী ছিল না। পূর্বে নাকি ঐ স্থানটিতে বেষ্টনী ছিল। খালের কাজ করতে গিয়ে বেষ্টনী সরিয়ে ফেলা হয়েছে। এ ঘটনার পরবর্তীতে চট্টগ্রাম শহরের প্রায় খাল বেষ্টিত রাস্তায় বেস্টনী বসানো হয়েছে। এ পর্যন্ত ছয় বছরে চট্টগ্রাম শহরের খাল–নালায় পড়ে অন্ত ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। এরূপ মৃত্যু কারো কাম্য নয়।
লেখক: প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ, গাছবাড়ীয়া সরকারি কলেজ, চট্টগ্রাম।